বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক কমপ্লেক্স হিসাবে পরিচিত ওপেক্স গ্রুপের কাঁচপুরের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে এই কারখানা কমপ্লেক্সটিকে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম কমপ্লেক্স বলা হয়, যেখানে একসময় ৪০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করত, যদিও গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যা কমে এসেছে। গত ১৮ই অক্টোবর একটি নোটিশে সেখানে থাকা সবগুলো কারখানা বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দেয় ওপেক্স কর্তৃপক্ষ। এভাবেই করোনা মহামারী চলাকালীন বন্ধ হয়ে যায় কারখানাগুলো। বেকার হয়ে পড়ে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষ। করোনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ ৬টি কর্মক্ষেত্রে ৭০ ভাগ শ্রমিক ক্ষতির মুখে পড়ে। অনানুষ্ঠানিক খাতে নিযুক্ত প্রায় ৫ কোটি ২০ লাখ মানুষের জীবিকা হুমকির মধ্যে রয়েছে। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে কিশোরী ও নারীদের ওপর, যেহেতু বাংলাদেশের মোট নারী শ্রমশক্তির প্রায় ৯১ দশমিক ৮ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে। বছর জুড়েই বিভিন্ন সময় রাজপথে নামতে হয়েছে শ্রমজীবীদের। বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাতে নিযুক্ত শ্রমিকরা বছরের একটা বড় অংশ মাঠে ছিল। এর বাইরে অন্যান্য খাতে নিযুক্ত শ্রমিকরা অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিল। বছর জুড়েই তৈরি পোশাক শিল্পে ছিল অস্থিরতা। লকডাউনে সাধারণ ছুটির সাথে তালমিলিয়ে এক ধরনের আতংকজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছিল। এখন করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন পোশাক খাতে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ-বিলস এর গবেষণায় বলা হয়েছে, রেস্টুরেন্ট, নির্মাণ ক্ষেত্র, পরিবহনসহ দেশের ৬টি গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে প্রায় ৭০ ভাগ শ্রমিক করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। গবেষণায় বলা হয়, করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্থ কর্মীদের মধ্যে ৯৮% রেস্টুরেন্ট কর্মী, ৯০% নির্মাণ শ্রমিক, ৯০% পরিবহন শ্রমিক, ৫৯% বন্দর শ্রমিক, ৫৬% তৈরি পোশাক শ্রমিক এবং ৩১% স্বাস্থ্য কর্মীরা রয়েছেন।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর দাবি : দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকরা। একইসঙ্গে আরও কিছু সুযোগ সুবিধা বাড়ানোরও দাবি করেছেন তারা। আর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা ও রাজধানীর বাইরের প্রধান সড়ক শ্রমিকরা অবরোধ করেছে। এতে সাময়িকভাব বন্ধ করতে হয়েছে অনেক গার্মেন্টস। তবে হঠাৎ করে এ ধরণের আন্দোলনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে দেখছেন তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ।
তারা বলছেন, ৩ বছর আগে বেতন বাড়ানো হয়েছে। প্রতি বছর শ্রমিকদের ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হচ্ছে। সরকারি বেতন কাঠামো অনুযায়ী ৫ বছর পর বেতন বাড়ানোর কথা। সেসময় যদি বেতন না বাড়ানো হয় তাহলে আন্দোলন হতে পারে। এখন হঠাৎ করে বেতন বাড়ানোর যে আন্দোলন শুরু হয়েছে তা ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। অবশ্য শ্রমিক নেতারা বলছেন, হঠাৎ করে নয় এটা ধারাবাহিক আন্দোলনেরই অংশ। নভেম্বরের শেষ দিকে মিরপুর এলাকায় গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলনে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা হামলা চালিয়ে বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে আহত করেছে। শ্রমিকদের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া ও মারামারি হয়। বছরের শেষভাগে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাজপথে নামতে হয়েছে শ্রমিকদের।
কঠোর লকডাউনেও শ্রমিকদের হয়রানী : বিগত সময়ে উৎপাদনমুখি কল-কারখানা খোলা থাকলেও গত বছরের মধ্যভাগে দেয়া লকডাউনে তৈরি পোষাক শিল্পের শ্রমিকরা পড়ে বিড়ম্বনায়। ২৩ জুলাই’২১ সকাল ৬টা থেকে শুরু হওয়া বিধি-নিষেধের মধ্যে খাদ্য পণ্য ছাড়া সব শিল্প কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দেয় সরকার। কিন্তু পরবর্তীতে মালিকদের চাপে তা শিথিল করে। তাই ঈদের সময় বাড়ী গিয়েও লকডাউনের মধ্যে শ্রমিকদের পায়ে হেটে চরম ভোগান্তির পেড়িয়ে কর্মস্থলে যোগ দিতে হয়েছে। করোনায় সময় মতো বেতন না পেয়ে শ্রমিকরা যেমন দুবেলা অন্নের জোগানে ব্যর্থ হয়েছে তেমনি ভবিষ্যত দিনের কথা ভেবে তারা শঙ্কিত, আতঙ্কিত। বিভিন্ন কারখানায় ঢালাওভাবে শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। শ্রমিক ছাঁটাইয়ে সরকারের নিষেধাজ্ঞা আর মালিক সংগঠনগুলোর আহ্বান থাকা সত্ত্বেও বেশ কিছু কারখানায় শ্রমিক ছাঁটায়েঁর সংবাদ ব্যথিত করেছে। তৈরী পোশাক শিল্পকারখানার সংকট মোকাবিলায় সরকার পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। কিন্তু এই টাকায় শ্রমিকরা কতটা লাভবান হয়েছেন?
পরিবহনে কর্মবিরতি : সেপ্টেম্বরে ১৫ দফা দাবিতে মালিকপক্ষের ধর্মঘটের কারণে দেড় দিন বন্ধ ছিল বাংলাদেশ কাভার্ড ভ্যান-ট্রাক-প্রাইমমুভারে পণ্য পরিবহন। বাংলাদেশ ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও প্রাইম মুভার পণ্য পরিবহন মালিক অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ট্রাকচালক শ্রমিক ফেডারেশন ১৫ দফা দাবিতে কর্মবিরতি পালনের ডাক দেয়। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ৩৫ ঘণ্টার কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা হলেও দেশের আমদানি রপ্তানি বাণিজ্যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
রাইড শেয়ারের চালকদের আন্দোলন : পুলিশি হয়রানি বন্ধ, অ্যাপসনির্ভর শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতিসহ ছয় দফা দাবি জানায় ঢাকা রাইড শেয়ারিং ড্রাইভারস ইউনিয়ন। তারা বলছেন, রাইড শেয়ারের চালকদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। রাজধানীর বাড্ডায় শওকত আলী নামের এক রাইডার তাঁর মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেন। তার আগে ট্রাফিক সার্জেন্ট এসে শওকতের কাগজপত্র নিয়ে যান। মামলা না দেওয়ার জন্য শওকত পুলিশের কাছে অনুরোধ করেন। তিনি গাড়ির কাগজপত্র ফেরত চান। কিন্তু কাগজপত্র ফেরত না পেয়ে হতাশ ও ক্ষুদ্ধ হয়ে নিজের মোটরসাইকেলে আগুন দেন শওকত। এ ঘটনার প্রতিবাদে পুলিশি হয়রানি বন্ধসহ ছয় দফা দাবিতে আন্দোলনে নামে তারা। দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যাপসনির্ভর শ্রমিকদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, কর্ম-সময়ের মূল্য দেওয়া, সব ধরনের রাইডে কমিশন ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা, মিথ্যা অজুহাতে কর্মহীন করা বন্ধ করা। পাশাপাশি পার্কিংয়ের জায়গা নির্ধারণ, তালিকাভুক্ত রাইড শেয়ারকারী যানবাহনকে গণপরিবহনের আওতায় নিয়ে আগাম কর কেটে রাখা বন্ধের দাবি জানানো হয়।
জুস কারখানায় আগুন মিললো অর্ধশতাধিক শ্রমিকের লাশ : নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের হাশেম ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ কোম্পানির সেজান জুস কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের পর কারখানার ভেতর থেকে আরো অর্ধশতাধিক লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ৮ জুলাই এ ঘটনা ঘটে। তবে অগ্নিকান্ড ও হতাহতের ঘটনাকে ‘কাঠামোগত হত্যা’ দাবি করে ১০টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশ দিয়েছে নাগরিক তদন্ত কমিটি।
পাটকল শ্রমিকদের আন্দোলন : করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর ২০২০ সালের ২ জুলাই রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ২৬টি পাটকলে উৎপাদন বন্ধের নোটিশ টাঙ্গানো হয়। এর ফলে স্থায়ী, বদলি ও দৈনিকভিত্তিক মিলিয়ে এক ধাক্কায় প্রায় ৫৭ হাজার শ্রমিকের কর্মক্ষম হাতকে বেকারের হাতে পরিণত করা হয়েছে। শুধু শ্রমিক নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাটচাষি-পাটশিল্পের ওপর নির্ভরশীল ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দোকানদার ও তাদের পরিবারসহ লক্ষ লক্ষ মানুষ। সরকারী পাটকল বন্ধের সময় বলা হয়েছিল – ৩ মাসের মধ্যে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকজনিত ক্ষতিপূরণসহ সকল পাওনা মিটিয়ে দিয়ে পাটকলগুলো পুনরায় চালু করা হবে। কিন্তু সময় মতো টাকা না পেয়ে গত জুনে আন্দোলনে যায় পাটকল শ্রমিকরা।
শ্রমিকদের ৬ দফা দাবি :
১. রাষ্ট্রীয় পাটকলের বদলি শ্রমিকদের সকল বকেয়া পাওনা অবিলম্বে পরিশোধ করা।
২. নামের ভুল দ্রুত সংশোধন করে অবশিষ্ট স্থায়ী শ্রমিকদের পাওনা অবিলম্বে পরিশোধ করা।
৩. ২০১৯ সালের বকেয়া সপ্তাহের মজুরি দিয়ে দেওয়া।
৪. ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন অনুযায়ী গত ৪ বছরের ছুটি ও ৯টি বোনাস, চিকিৎসা-শিক্ষা ভাতার ডিফারেন্স, বৈশাখী ভাতার টাকা পরিশোধ করা।
৫. বেসরকারি পাটকলে ২০১৫ সালের মজুরি কমিশন বাস্তবায়ন করা।
৬. রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ নয়, আধুনিকায়নসহ চালু করা। ক্যাজুয়াল ভিত্তিতে নয়, বদলি/স্থায়ী হিসাবে পুরনো শ্রমিকদের অগ্রাধিকারে নিয়োগ দেওয়া। তারা বিজেএমসি এবং পাট মন্ত্রণালয়ের সামনে বিক্ষোভ করে ও স্মারকলিপি দেয়।
চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা করার দাবি : বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ফেডারেশন চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১১৭ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া মজুরি বোর্ডের খসড়া সুপারিশের বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। তারা দৈনিক মজুরি ৫০০ টাকা করার দাবি জানিয়েছে। চা শ্রমিকরা বলছেন, ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালিনীছড়া চা-বাগান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে চা শিল্পের যাত্রা শুরু। সেই হিসাবে এই অঞ্চলে চা শিল্পের বয়স ১৭২ বছর। অথচ চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি এখনো ১৭২ টাকা হয়নি। চা-শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বের অদক্ষতায় দীর্ঘদিন ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত চা-শ্রমিকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ন্যায্য মজুরি নির্ধারণে মজুরি বোর্ড গঠনের দাবি তুলেছিলেন। শ্রমিকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালে চা শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি পুনর্র্নিধারণে মজুরি বোর্ড গঠিত হয়।
দেশের ১০ লক্ষাধিক চা-জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চা-শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ন্যূনতম ৫০০ টাকা নির্ধারণ, অতিরিক্ত উৎপাদনের জন্য দ্বিগুণ মজুরি প্রদান, রেশনের পরিমাণ বৃদ্ধি, কৃষিভূমির জন্য রেশন কর্তন বন্ধ, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মানোন্নয়ন করতে হবে।