নদ-নদী, খাল-বিল, হাওড়-বাওড়ে ভরপুর আমাদের বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে বাংলাদেশ যেমন সমৃদ্ধ তেমনি পানির নীচে বসবাসকারী মাছ আমাদের অন্যতম জাতীয় সম্পদ। বাংলাদেশের মানুষ খাদ্য তালিকায় প্রতিদিন মাছকে রাখে। অনেকটা মনে হয় মাছ ছাড়া জীবন অচল। গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ একটা স্বচ্ছল পরিবারের পরিচয়। প্রতিবছর খাল-বিল, নদ-নদী, হাওড়-বাওড়ে যে মাছ ধরার উৎসব তা ভুলে যাবার মতো নয়। আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে আসলে দেরী না করে বাড়ির মালিক পুকুর থেকে বড় বড় মাছ ধরে এনে সুস্বাদু তরকারী রান্না করে। এমনও হয়েছে বাড়িতে তরকারী নেই, বাড়ির মালিক গোসল করতে যাওয়ার সময় তৌড়ও জাল নিয়ে গিয়ে মাছ ধরে আনত যা তরকারীর অভাব পূরণ করত। জ্যান্ত মাছ যে লাফালাফি করত তা দেখার মতো। অতীতের গর্ভে কালের পরিবর্তনে এ ইতিহাস শুধু ইতিহাস বাস্তবে এ প্রমান পাওয়া যায় না। নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৎস সম্পদ একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নদনদী, খাল-বিল মরে যাওয়ায় প্রচুর পানি না থাকায় পূর্বের মতো মাছ আর পাওয়া যায় না।
মিঠাপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির মাছ রয়েছে অর্থাৎ ১১৭ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়েছে। অন্য একটি তথ্য অনুসারে বিলুপ্ত মাছ প্রজাতির সংখ্যা ৬৪টি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মৎস গবেষনা ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) ২৩ প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তির উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশের দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো এখন আর তেমন দেখা যায় না। যে মাছগুলো পুকুরে চাষ হয় তার স্বাদও তেমন নয়। তেলাপুটি, বাইম, গুচি মাগুর, পাবদা, কেচকি বাজারে অত্যন্ত চড়ামূল্যে পাওয়া গেলেও তা খেতে তৃপ্তিকর নয়। বাংলাদেশে নদ-নদী যেভাবে শুকিয়ে গেছে । গবেষনা ইন্সটিটিউট মাছ উৎপাদন ও বিলুপ্ত প্রজাতির প্রক্রিয়াকরনের মাধ্যমে এ অভাব পূরণের চেষ্টা করছে। অন্য একটি তথ্যে দেখা যায় বেরালি মাছ উত্তর জনপদের একটি সুস্বাদু মাছ। বেরালি মাছ বেরালি ও খোকসা নামেও পরিচিত। এ মাছের আরও ৪টি প্রজাতি রয়েছে যা খাল-বিল, অগভীর নদীতে পাওয়া যায় এখন এটাকে বিপন্ন প্রজাতি হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সরকারী হিসাব মতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন মুক্ত জলাশয় যেমন- নদী, সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, বিল ও প্লাবন ভূমির পরিমান ৩৮ লক্ষ ৯০ হাজার হেক্টর, বদ্ধ জলাশয়, পুকুর মৌসুমী চাষকৃত জলাশয় বাওড় ও চিংড়িঘের, পেনকালচার ও খাচায় মাছ চাষের আওতাধীন জলাশয়ের পরিমাণ প্রায় ৮ লক্ষ ২২ হাজার হেক্টর, সামুদ্রিক জলসীমার পরিমাণ ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার এর সমুদ্র উপকুল ৭১০ কিলোমিটার। ৫২টি নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ার পরও এত পরিমাণ জমিতে মাছের চাষ সঠিকভাবে করতে পারলে এদেশের মানুষকে চড়ামূল্যে মাছ কিনতে হত না। শুধু যদি সমুদ্রের যে অংশ বাংলাদেশের অধীন সেখানে মাছ চাষ করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্জন করতে সক্ষম হবে।
সরকারী তথ্য অনুসারে মোট দেশজ উৎপাদিত জি.ডি.পিতে মৎস খাতের অবদান ৩.৫০ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯) দেশের মোট কৃষিজ আয়ের ২৫.৭২ শতাংশ মৎস উৎপাদন খাত থেকে আসে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা) আরও একটি তথ্য থেকে জানতে পারা যায় আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে তালিকায় আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ।
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১৪ লক্ষ নারীসহ ১ কোটি ৯৫ লক্ষ বা ১২ শতাংশের অধিক লোক মৎস খামারের বিভিন্ন কাজকর্মে নিয়োজিত। সরকার যেসব তথ্য দেয় তা শুনতে বেশ মজা লাগে। যেমন ইলিশ আহরণকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম। গত ১০ বছরে স্বাদু পানির মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির হারে ২য় স্থানে। তেলাপিয়া উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশে^ ৪র্থ, এশিয়ার মধ্যে ৩য় স্থান অধিকার করেছে। এত উৎপাদন হওয়া স্বত্তে¡ও বাজারে স্বল্পমূল্যে কি মাছ পাওয়া যায় ? এত ইলিশ আহরণ করার পরও এত চড়ামূল্য কেন আর কেনইবা কৃষক ১ মন ধানের মূল্যে ১ কেজি ইলিশ কিনতে বাধ্য হয়। তবে এটা সত্য যে স্বাদহীন সিলভারকার্প, বিগহেড কার্প, গ্লাসকার্প না হলে সাধারণ নিম্ন আয়ের মানুষ মাছের কোনো স্বাদ পেত না। মাগুর, কৈ মাছ, শিং মাছ এখনও পণ্য হিসাবে মানুষ খায় আর যারা গাড়িবাড়ি শপিংমলের বড় বড় ব্যবসায়ী তাদের কথা ভিন্ন। চিংড়ি মাছ, যেমন মজাদার তেমনি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে চিংড়ি প্রকল্প আগের মতো নেই, নানা সমস্যায় জর্জরিত ফলে বৈদেশিক মুদ্রাও আর তেমন আমাদের জাতীয় আয়ে জমা হয় না।
আশির দশকে আন্তর্জাতিক বাজারে চাহিদা ও অধিক মুনাফার জন্য কৃষি জমি রূপান্তর করে চিংড়ি চাষ শুরু করা হয়। পাটকে বলা হয় সোনালী আশ আর চিংড়িকে বলা হয় সাদা সোনা। এ সাদা সোনার চিংড়ি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশ হিমায়িত চিংড়ি রফতানির প্রতিযোগিতায় নাভিশ্বাস উঠেছে। যশোরের এম.ইউ.সী ফুডসের এম.ডি শ্যামল দাস বলেন ৩৩ বিলিয়ন ডলারের চিংড়ির বিশ্ববাজার যার ৮০ ভাগ ভেনামী দখল করে আছে। আমাদের লড়তে হয় ২০ শতাংশ বাজারের জন্য। বাংলাদেশ ফ্রোজেন ফুডস এক্সপোর্টাল এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে গলদা ও বাগদা চিংড়ি প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় ৩০০-৪০০ কেজি। অপরদিকে ভেনাস চিংড়ি প্রতি হেক্টরে উৎপাদন হয় ৭-৮ হাজার কেজি। স্বাভাবিকভাবেই ভেনাস বাজার দখল করতে সক্ষম হয়েছে। ভেনাস চাষের জন্য জন্য ব্যবসায়ীরা সরকারের নিকট আবেদন করলেও তাতে সাড়া মেলেনি। অবশেষে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভেনাসী জাতের চিংড়ি চাষের অনুমতি দেয়। ২০২০ সালে কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও করোনার কারণে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ চিংড়ি ছাড়া হয়। কাচামালের অভাবে দেশে ১০৫টি হিমায়িত মৎস প্রক্রিয়াজাত ও রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চালু আছে ২৮টি বাকি ৭৭টি বন্ধ হয়ে গেছে। শোনা যায় কিছু ব্যবসায়ী চিংড়ির ওজন নিয়ে কারসাজি করার কারণেও বিশ^বাজার হারিয়েছে। চিংড়ি শিল্পের এ ধস জাতিকে আতঙ্কিত করে তুলেছে, অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে পুরো অর্থনীতি। মৎস অধিদপ্তর ও রফতানী উন্নয়ন ব্যুরোর এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে ৪৭ হাজার ৬৩৫ মেট্রিকটন হিমায়িত চিংড়ি রফতানী হলেও মাত্র ৬ বছরের ব্যবধানে ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে তা ৩০ হাজার ৩৬ মেট্রিকটনে নেমে এসেছে। একই সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে কমে ৩৩৩ ডলার আর ২০২০-২০২১ সালের অর্থবছরে আয়ও কমে ৩২৯ ডলারে ঠেকেছে। এছাড়াও ২০১৪-১৫ সালে ২ লাখ ১৬ হাজার ৪৬৮ হেক্টর জমিতে বাগদা চিংড়ি চাষ হয় অপরদিকে ৪ বছরের ব্যবধানে ২০১৮-১৯ সালে কমেছে ৩১ হাজার ১৬০ হেক্টর জমি। এ থেকে চিংড়ির হালঅবস্থা কেমন তা স্পষ্ট হয়েছে। বাজারে কেন চিংড়ি পাওয়া যায় না বা কেনইবা দাম বেশি তা সহজেই অনুমেয়। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার অবসান করে ভেনাসী জাতের চাষের জন্য সরকার যতবেশী তাড়াতাড়ি পদক্ষেপ নিবে ততই এ শিল্পের জন্য মঙ্গল হবে। জাতীয় অর্থনীতিতে আবার চিংড়ি শিল্প ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
আমাদের দেশের রূপালী মাছ ইলিশের স্বাদ যাতে সাধারণ মানুষ ভোগ করতে পারে তার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শুধুমাত্র মা ইলিশের ডিম পাড়ার সময় মাছ ধরা বন্ধ রাখলেই হবে না, তার সাথে সাথে প্রান্তিক জেলেদের প্রয়োজন পূরণের দিকে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। জালক্রয় করা, জাল মেরামত করা, নৌকা ক্রয় ও মেরামত করা কি শুধু কয়েক কেজি চাল দিয়েই সম্ভব ? আরও যে তাদের অনেক প্রয়োজন সেগুলো কে সমাধান করবে। কিছু কিছু এনজিও জেলেদেরকে টাকা দাদন দিয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ আদায় করে তাদেরকে সর্বশান্ত করে দিচ্ছে। নিজের দেশের প্রয়োজন না মিটিয়ে অন্য দেশে হাজার হাজার টন ইলিশ পাঠানো কি দরকার ছিল ? অবশ্যই বলতে হবে বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হলে নিজেদের প্রয়োজনকে জলাঞ্জলী দিতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত একটি তথ্য অনেকেরই নজরে এসেছে পাশের প্রিয় রাষ্ট্রে মাছ বিক্রেতা চিৎকার করছে স্বস্তা ইলিশ, স্বস্তা ইলিশ নিয়ে যান। হায়রে দেশ প্রেম!
মাছের উৎপাদনের জন্য যেসব গবেষণা কেন্দ্র গবেষণা করছে তাদেরকে আরও বাস্তবমুখী হতে হবে। শুধু উৎপাদন নয় যাতে মাছ স্বাভাবিকভাবে উৎপাদন হয় তার নির্দেশনা দিতে হবে। ৫০ বছর পূর্বে তো এত গবেষনা, মন্ত্রণালয়, অধিদপ্তর ছিল না, তাতে কি মাছের অভাব ছিল ? ধনী গরীব সকলেই প্রচুর পরিমানে মাছ খাওয়ার সুযোগ পেত। আজ সে মাছ গেল কোথায় ? সম্ভবত উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গেছে।
মাছচাষী ও জেলেদের হাজার সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। অভ্যন্তরীন জলাশয় যেমন-খাল-বিল, নদ-নদী, প্লাবন ভূমি, হাওড় প্রভৃতি জলাশয় অবৈধভাবে প্রভাবশালীদের পত্তন প্রদানের ফলে এসব অভ্যন্তরীন জলাশয়কে তারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে দখল করে ফসল চাষের জমিতে রূপান্তরিত করেছে। যুগের পর যুগ ধরে সমস্ত জলাশয় বিল সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল, সেখানে জেলেরা মাছ ধরতো তা আজ আর নেই। জলাশয়ের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। জেলেরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশা গ্রহণ করছে।
আমাদের দেশের যেখানে সেখানে কলকারখানা গড়ে উঠছে। যে সমস্ত কারখানার বিষাক্ত পানি, বর্জ পানিকে বিষাক্ত করে তোলে, ফলে মাছ তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলছে। কৃষি উন্নয়নের শ্লোগানে জমিতে কীটনাশক ঔষধ ব্যবহার করার কারণে মাছ মরে যাচ্ছে। গ্রামের মানুষ জমি থেকে কৈ মাছ পেত তাতে তাদের বাইরে কিনতে হতো না। যে সব মাছ বেঁচে থাকে সেগুলো প্রজনন ক্ষমতা হারিয়ে বংশ বৃদ্ধি করতে পারে না।
জমির অনেক মালিক জমি বৃদ্ধির লক্ষ্যে পুকুর পূর্ণ করে অন্য চাষাবাদ করছে ফলে মাছের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। জলবায়ুর কারণে গ্রীষ্ম মৌসুমে প্রচুর জলাশয়, খাল-বিল শুকিয়ে যাওয়ায় মাছের তীব্র সংকট দেখা দেয়। মাছ চাষীদের বহুবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা সমাধান করতে না পারায় মাছ উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এবং ভবিষ্যতে আরও প্রকট আকার ধারণ করবে। সরকারী ব্যবস্থাপনায় তালিকাভূক্ত যে সব পুকুর লিজ দেয়া হয় তা অত্যন্ত চড়ামূল্য হওয়ার কারণে সাধারণ মানুষেরা নিতে পারে না, ফলে মাছ ব্যবসায়ী হওয়ার সুযোগ পায় না। আবার যদি কেউ পুকুর লিজ নেয় তবে স্থানীয় মাস্তানদের দৌরাত্মের শিকার হতে হয় তাদেরকে। মাস্তান ফি (তাদের ভাষায় বকশিস) না দিলে পুকুর আবাদ করতে দেয় না।
পুকুরে যে মাছের চাষ হয় তার খাদ্য হিসাবে যেসব ফিড কিনতে হয় তাও ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকে না, ফলে সাধারণ চাষী বা প্রান্তিক চাষীরা চরম বিপাকে পড়ে। সরকার ইচ্ছা করলে এসব ফিডের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রতি তীক্ষè নজর রাখতে পারে। আবার অনেক ফিড মাছের জন্য উপযোগী থাকে না ফলে মাছ মরে যায়। ফিডের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য যন্ত্র সহজলভ্য হওয়া দরকার। পুকুরে মাছে ভাইরাস হওয়ার কারণে মাছ মরে যায়। ভাইরাস দূর করার জন্য চিকিৎসক পর্যাপ্ত না হওয়ার কারণে ঔষধ দিতে দেরী হয় ফলে মাছ মারা যায়।
মাছ উৎপাদন করার জন্য মাছের রোগবালাই জানা পুকুর তৈরী করার জন্য যে প্রশিক্ষনের দরকার মাছ চাষীরা সে প্রশিক্ষণ পায়না যার ফলে চরম সংকটের সম্মুখীন হয়। যদিও সরকার মাছ চাষীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে বলে দাবী করে কিন্তু তা প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত। দেশের যেসব এলাকায় পুকুর চাষ করে প্রচুর মাছ উৎপাদনের চেষ্টা হয় তারা মাছ বিক্রয়ের জন্য মাছের বাজার পায় না, ফলে তাদেরকে অন্য জেলায় যেখানে বড় মাছের বাজার বা আড়ত আছে সেখানে যেতে হয়। এতে করে মাছ বিক্রয়ের লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হয়। আবার মাছ সংরক্ষনের জন্য বরফের সংরক্ষনাগার না থাকার কারণেই মাছ রাখতে পারে না। অন্য কোন জেলায় মাছ নিয়ে যাওয়ার জন্য যে যানবাহন দরকার তাও সহজলভ্য না হওয়ায় পানির দরে মাছ বিক্রি করে মাছ চাষীরা সর্বশান্ত হয়।
খাদ্য প্রস্তুতকারী বিভিন্ন কোম্পানীর রাসায়নিক দ্রব্য ও অধিক পরিমাণে এ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে মাছ চাষ এখন শরীরের জন্য ক্ষতির কারণ হয়েছে। মেডিসিন ও বর্জ ব্যবহারের কারণে মাছের উৎভট গন্ধ পাওয়া যায়। আবার মাছের খাদ্যে মুরগীর বিষ্ঠা ব্যবহার করাও স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে।
মাছ চাষীদের স্বাবলম্বী করার জন্য ব্যাংক থেকে কম সুদমুক্ত ঋণ দেয়া সময়ের দাবী
মৎস শ্রমিকেরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। মৌলিক অধিকার থেকে তারা বঞ্চিত। মাছ চাষী বা সরকার তাদের সমস্যা সমাধানে বাস্তবমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে না। মৎস শ্রমিকদের বেতনের নির্ধারিত কোনো স্কেল নেই, তাদের নেই কোনো নিয়োগপত্র বা চাকুরীর নিশ্চয়তা। মালিকেরা নিজেদের ইচ্ছেমত শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ করে। তারা অসুস্থ হলে বা যখন কোন কাজ থাকে না তখন তাদের জন্য কোনো আর্থিক সহযোগিতা করা হয় না। তাদের ছেলে-মেয়েদের শিক্ষা, চিকিৎসারও কোন ব্যবস্থা থাকে না। শ্রমিকেরা কোন দুর্ঘটনার শিকার হলে তাদের মালিক ইচ্ছে হলে কিছু সাহায্য করে যা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারে নগন্য। বিশেষ করে সমুদ্রে যারা মাছ ধরতে যায় তারা অনেক সময় মৃত্যুবরণ করে, তাদের অসহায় পরিবারের জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। শ্রমিকদের মাছ ধরার জন্য কোনো নির্দিষ্ট পোশাক থাকে না ফলে পানিতে থাকা বহু পোকামাকড় এমনকি সাপের বিষাক্ত ছোবলের শিকার হয়। এছাড়াও চর্মরোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়। যে শ্রমিকেরা রোদ বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের প্রচন্ড ঠান্ডাকে উপেক্ষা করে মাছ ধরে অন্যের খাদ্যের জোগান দেয় তারা সুষম খাবারের অভাবে অপুষ্টির শিকার হয় ও অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটায়। অনেক শ্রমিকের বসতভিটা না থাকায় পরের জমিতে আশ্রয় নেয় ফলে প্রতিনিয়ত শ্রমিকদের নানাপ্রকার অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়। সরকারীভাবে শ্রমিকদের কোন প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা থাকে না বলে অনেক সময় অজ্ঞতার কারণে মাছের অনেক ক্ষতি হয়। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা নেই। মৎস সম্পদ আমাদের রূপালী, এ বিভাগকে সকল প্রকার প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করতে, উৎপাদনের ক্ষেত্রে যে সমস্ত সমস্যা আছে তা আরও সুষ্ঠুভাবে তথ্য অনুসন্ধান চালিয়ে দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া ও গবেষণা কেন্দ্রের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি করতে হবে তেমনি গবেষকসহ পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করতে না পারলে দেশীয় প্রজাতি যেমন বিলুপ্ত হবে, তেমনি উন্নয়নশীল দেশের মত মাছ উৎপাদনে নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সক্ষম হবে না। চিংড়ির পরিবর্তে ভেনাস উৎপাদনে মাছ চাষীদেরকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকারীভাবে সকল প্রকার সহযোগিতা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। মাছ চাষীদের সমস্যা দূর করার জন্য বিশেষ কমিটি করে বিশেষ প্রদক্ষেপ নেয়া দরকার।
আমাদের দেশের মানুষের তরকারীর অন্যতম উপাদান মাছ হওয়ায় বাজারে যাতে সস্তাদরে মাছ ক্রয় করতে পারে সেজন্য সিন্ডিকেটের হাত থেকে মাছকে রক্ষা করা জরুরী। মাছ চাষী ও শ্রমিকদেরকে উন্নত মানের মাছ উৎপাদনে ব্যাপক প্রশিক্ষণ দান, মাছ চাষীদেরকে ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ দান, পুকুর ও জলাশয়গুলোকে যোগ্য ব্যক্তিদেরকে লিজ প্রদান, উন্নতমানের মাছের খাদ্যের মান নিশ্চিতকরণ ও মূল্য হ্রাস করণ, সমুদ্রের মাছ চাষী ও শ্রমিকদের জাল, নৌকা মেরামতসহ পরিবারের জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদানের নিশ্চয়তা, ভেনাস উৎপাদন বিলম্ব না করে আগ্রহী সংস্থাগুলোকে সাহায্য প্রদান এবং সমুদ্রে ব্যাপকহারে মাছ উৎপাদনে উদ্যোগ নিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের জন্য মন্ত্রণালয়কে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী বলে দেশের চিন্তাশীল ব্যক্তিদের অভিমত।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন