আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
আশা করি মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার অফুরন্ত মেহেরবানীতে সুস্থ থেকে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। বর্ষপরিক্রমায় রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের বার্তা নিয়ে পবিত্র মাহে রমজান আমাদের মাঝে সমাগত। রাসূলুল্লাহ (সা) এ মাসকে শাহারুন মোবারক তথা বরকতময় মাস বলে অভিহিত করেছেন। মাহে রমজানের রোজাকে ফরজ করার মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতির ইহকালীন ও পরকালীন জীবনের উন্নতি ও কল্যাণের মূলভিত্তি তাকওয়াপূর্ণ জীবন গঠনের অনন্য সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছেন। পবিত্র কুরআন মাজিদের সুরা আল বাকারার ১৮৩ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পার।” আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধি ও আত্মোন্নয়নের ধারাবাহিক প্রশিক্ষণের মাস হলো মাহে রমজান। মানব সমাজের সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ, জনকল্যাণমূলক ও ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে রোজার গুরুত্ব অপরিসীম। সাওম বা রোজা যেমন ক্ষুধায়-কাতর দুঃখী মানুষের প্রতি আমাদের মমত্ববোধ জাগিয়ে তোলে, তেমনি শিক্ষা দেয় সততা, ধৈর্য, একনিষ্ঠতা, ত্যাগ, সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহানুভূতি। আর প্রেরণা জোগায় শোষণ, ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বৈষম্য মুক্ত একটি ইনসাফপূর্ণ সমাজ গড়ার।

রমজান মাস মানবজাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে এক বড় নিয়ামত। আমরা জানি এ মাসে একটি ফরজ ইবাদত করলে অন্য মাসের সত্তরটি ফরজ আদায়ের সাওয়াব পাওয়া যায়, তেমনিভাবে একটি নফল ইবাদত করলে অন্য মাসের ফরজ আদায়ের সমান ফজিলত পাওয়া যায়। এ মাসে এমন একটি রাত (লাইলাতুল কদর) রয়েছে, যে রাতের মর্যাদা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, যে ব্যক্তি ঈমান ও আত্মসমালোচনার সাথে রমজানের রোজা রাখবে, তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও সাওয়াবের নিয়তে রমজানের রাত্রি ইবাদতে কাটাবে তার পূর্বের গুনাহসমূহ মাফ করা হবে। আর যে ঈমান ও আত্মসমালোচনার সাথে কদরের রাত্রি তালাশ করবে তার পূর্বের গুনাহ মাফ করা হবে।” (বুখারি ও মুসলিম)।
রমজান মাস এত বেশি বেশি মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এ মাসে নাজিল করা হয়েছে মানবতার মুক্তির সনদ মহাগ্রন্থ আল কুরআন। পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন “রমজান মাস, এ মাসেই নাজিল করা হয়েছে আল কুরআন যা মানবজাতির জন্য পরিপূর্ণ হেদায়াত ও দ্ব্যর্থহীন শিক্ষা সংবলিত, যা সত্য-সঠিক পথ দেখায় এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য সুস্পষ্ট করে দেয়।” প্রকৃতপক্ষে আল কুরআনই হলো মানব জাতির ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পথ নির্দেশক। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ তা’আলা কোন জাতিকে এ কুরআন দ্বারা সমুন্নত করেন আবার কোন জাতিকে অধঃপতিত করেন।” সুতরাং এ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহর দেওয়া কুরআন অনুযায়ী না চলে মানুষের মনগড়া বিধান দিয়ে চলার কারণে আজ মুসলমানদের এ অধঃপতিত অবস্থা। এ অবস্থার পরিবর্তন করতে হলে আমাদেরকে কুরআন অধ্যয়ন করা, বুঝা ও কুরআনের আলোকে জীবন পরিচালনা করতে হবে। আর কুরআনের বিধিবিধান জানা, বুঝা ও ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়নের কাজকে এগিয়ে নেওয়ার উপযুক্ত সময় এ রমজান মাস।
ফযিলতপূর্ণ ও মহিমান্বিত মাহে রমযানে জ্ঞানার্জন, আত্মশুদ্ধি, আত্মগঠন ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নে উল্লেখিত অধ্যয়ন ও অনুশীলনমূলক কাজে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানাচ্ছি-
১. আল কুরআন- তাফহীমুল কুরআন ১৮ ও ১৯ খণ্ড, সুরা আল বাকারা ১৮৩-১৮৫ নং আয়াত, পুরো কুরআন অন্তত একবার অর্থসহ তেলাওয়াত করার চেষ্টা করা।
২. আল হাদিস- তাহারাত, সালাত, সিয়াম ও চরিত্র গঠন সংক্রান্ত অধ্যায়।
ঘ). ইসলামী আন্দোলন: সাফল্যের শর্তাবলী
ঙ). ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি
৪. তা’লিমুল কুরআন- সহীহ তিলাওয়াত শিক্ষার ব্যবস্থাকে পারিবারিকভাবে, মসজিদ ভিত্তিক, পাড়া ও মহল্লা কেন্দ্রিক ব্যাপক রূপ দেয়ার চেষ্টা করা।
৫. মৌলিক বিষয়ে বাছাই করা আয়াত ও হাদিস মুখস্থ করা।
১. মাহে রমজানে পরিবার-পরিজন ও পাড়া প্রতিবেশীকে নিয়ে ভাবগম্ভীর পরিবেশে যথাযথ মর্যাদায় সিয়াম পালন করা।
২. জামায়াতের সাথে ফরয সালাত ও তারাবীহ আদায় করা।
৩. কিয়ামুল লাইল বা সালাতুত তাহাজ্জুদ আদায়ের মাধ্যমে তিলাওয়াতে কুরআনের দুর্লভ সুযোগ কাজে লাগানো।
৪. আল্লাহর গযব থেকে রক্ষা ও তাঁর সাহায্য লাভে কাতর কণ্ঠে দোয়া করা।
৫. নেতৃবৃন্দসহ সকল মজলুম মানুষের মুক্তির জন্য বেশি বেশি আল্লাহর দরবারে ধরনা দেওয়া।
৬. সদস্য, কর্মী, সাধারণ সদস্য বৃদ্ধির কাজ এ মাসে অন্য মাসের তুলনায় ব্যক্তিকে অধিক সাওয়াবের অধিকারী করবে। তাই জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচার উপায় এবং অধিক পুরস্কার লাভের আশায় এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনে যত্মশীল হওয়া।
৭. পারিবারিকভাবে বা পারিবারিক ইউনিটের উদ্যোগে পাড়া-প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ইফতারির আয়োজন করা।
৮. পরিস্থিতির আলোকে সাংগঠনিকভাবে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করা।
৯. বেশি বেশি দান-সাদাকাহ করা। এ ক্ষেত্রে মজলুম ভাই-বোন, করোনা ভাইরাসের কারণে দুর্দশাগ্রস্থ শ্রমজীবী মানুষ ও নিকট আত্মীয়দের প্রতি খেয়াল রাখা।
১০. হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, জিঘাংসা ও নৈরাজ্যের বিষ ছড়ানোর মোকাবিলায় ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে জান্নাতি আবহ তৈরিতে বলিষ্ঠ ভ‚মিকা পালন করা।
১১. সুদ, ঘুষ, মাদক, জুয়াসহ যাবতীয় ধ্বংসাত্মক পাপাচার থেকে বাঁচার জন্য জনসচেতনতা তৈরি করা।
রমজান মাসে ছাহেবে নেছাব অর্থাৎ ধনী লোকেরা যাকাত আদায় করে থাকেন। সুরা তাওবার ৬০ নং আয়াতে বর্ণিত যাকাত প্রদানের ৮টি খাত হলো- ফকির, মিসকিন, যাকাত আদায়কারী, যাদের চিত্ত আকর্ষণ করা প্রয়োজন, দাস-মুক্তি, ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি, আল্লাহর পথে এবং মুসাফির। বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সমাজকল্যাণমূলক খাতকে আরও গতিশীল করার জন্য যাকাত আদায়ের কাজকে মজবুত করতে হবে। তাই যাকাত প্রদান ও সংগ্রহের ব্যাপারে শাবান মাসে সামর্থবান ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করে তালিকা তৈরি ও টার্গেট নির্ধারণ করে দিয়ে রমজান মাসে যাকাত সংগ্রহ করতে হবে। যাকাত দাতা সদস্যগণ যাকাতের ৫০% ফেডারেশনের কল্যাণ ফান্ডে জমা দিবেন এবং মহানগরী/জেলা/উপজেলা/থানা সংগঠন থেকে যাকাত আদায়ের জন্য সার্বিক প্রচেষ্টা চালাবেন।
আসুন আল্লাহ রাব্বুল আ’লামীনের কাছে আমরা সবাই দোয়া করি, যেন বৈশ্বিক মহামারি “করোনা ভাইরাস” সংক্রমণ থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্ববাসীকে মুক্ত করেন। আর উপরিউক্ত অধ্যয়ন ও অনুশীলনমূলক কার্যক্রম সমূহ বাস্তবায়ন এবং রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানকে যথাযথ মর্যাদার সাথে পালনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মনিয়োগ করি।