মহান আল্লাহর সৃষ্ট দুনিয়ায় শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ। যাকে আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। পৃথিবী এক বিশাল কর্মক্ষেত্র। কালের পরিক্রমায় অসংখ্য নবি ও রাসুলের নেতৃত্বে কর্মের নানা স্তর পেরিয়ে বিশ্বসভ্যতা আধুনিক ঐশ্বর্যময় রূপ লাভ করেছে। পৃথিবীতে অধিকাংশ নবী-রাসুল কোন না কোন শ্রম পেশার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাঁদের পরিশ্রমেরই সম্মিলিত যোগফল আজকের পৃথিবী। শ্রমিকের শ্রমকে ভিত্তি করেই সমাজ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে। অগণিত মানুষের যুগ যুগাস্তরের শ্রমেই গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতার সৌন্দর্য। তারা পাহাড়-পর্বত কেটে পথ তৈরি করেছে, নদীর উপর সেতু বানিয়েছে, নির্মাণ করেছে আমাদের ঘরবাড়ি, সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, সুরম্য অট্টালিকা। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উদয়স্ত পরিশ্রম করে কেউ ফলিয়েছে সোনার ফসল, কেউ বুনেছে লজ্জা নিবারণের বস্ত্র, কেউবা জীবনকে সুন্দর ও সুখময় করার জন্য বানিয়েছে ভোগ-পণ্যসামগ্রী। আধুনিক শিল্প বিপ্লব শ্রমের ওপর নির্ভর করে এগিয়ে গেছে উন্নতির পথে।
আধুনিক শিল্পউন্নতি কি?
মহান আল্লাহ প্রদত্ত ও নবি (সা.) প্রদর্শিত জীবন বিধানই আধুনিক। এর বিপরীত যা কিছু তাই পশ্চাৎপদ।
আলোচনার বিষয়:
১. আধুনিক শিল্পউন্নতির যুগ
২. শ্রমিক সমস্যা
৩. ইসলামী সমাধান
১.আধুনিক শিল্পউন্নতির যুগ:
আধুনিক শিল্পের উন্নতির যুগে কি কি হয়েছে; আধুনিক শিল্পউন্নতির এ যুগে শ্রমিকের
সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়েছে।
শ্রমিকের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে।
শ্রমিকের স্বাধীনতা অধিকার ও শ্রমমান নির্ধারণ হয়েছে।
শ্রমিকের স্বাধীনতা ইত্যাদি কাগজে কলমে ঠিক করা হয়েছে, লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
সেমিনার সিম্পোজিয়াম আলোচনা চলছে।
শ্রমিকের সংজ্ঞা: বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী শ্রমিক কারা? সাধারণত বিভিন্ন শিল্প কারখানায় যারা কাজ করেন তাদেরকে শ্রমিক বলে। তবে এবিষয়ে আলোচনা করতে হলে সর্বাগ্রে শ্রমিকের সংজ্ঞা তুলে ধরা দরকার।
১.শ্রমিক হলো সেই ব্যক্তি যিনি কায়িক বা শারীরিক পরিশ্রম করেন অর্থাৎ যিনি কাজ করেন তিনিই শ্রমিক।
২.অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী‘শ্রমিক হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি একটি বিশেষ ধরনের কাজ বা বিশেষ উপায়ে কাজ করেন।’
৩.অর্থনীতি শাস্ত্র অনুযায়ী যিনি মজুরের বিনিময়ে কাজ করেন তিনিই শ্রমিক।
৪.বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর (২০১৩ সালের সংশোধনীসহ) প্রথম অধ্যায়ের ২য় ধারায় ৬৫
অনুচ্ছেদের সংজ্ঞা অনুযায়ীÑ শ্রমিক অর্থ শিক্ষাধীন কোন ব্যক্তি, তাহার চাকরির শর্তাবলী প্রকাশ্য বা উহ্য যে ভাবেই থাকুক না কেন, যিনি কোনো প্রতিষ্ঠানে বা শিল্পে সরাসরিভাবে বা কোন ঠিকাদার, যে নামেই অভিহিত হইক না কেন, এর মাধ্যমে মজুরি বা অর্থের বিনিময়ে কোন দক্ষ, অদক্ষ, কায়িক, কারিগরী, ব্যবসা উন্নয়ন অথবা কেরানীগিরির কাজ করার জন্য নিযুক্ত হন তিনিই শ্রমিক। কিন্তু প্রধানত প্রশাসনিক, তদারকি কর্মকর্তা বা ব্যবস্থাপনামূলক কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ইহার অন্তর্ভুক্ত হইবেন না।
শ্রম আইনে শ্রমিকের নিম্নোক্ত সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে:
কোন প্রতিষ্ঠান বা শিল্পে দক্ষ বা অদক্ষ ব্যক্তিকে মজুরির বিনিময়ে বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করলে সেই নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে শ্রমিক বলে। তবে যারা ব্যবস্থাপনা বা প্রশাসনিক কাজে নিযুক্ত হন তারা শ্রমিকের অন্তর্ভুক্ত হবেন না। [ধারা-২(৬৫)]
অর্থাৎ যারা মজুরির বিনিময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন তাদেরকে শ্রমিক বলে। বাস্তবে শিল্প উন্নত দেশগুলো শ্রমিকের মৌলিক অধিকার পালনে বেশ তৎপর। তারা শ্রমিকাধিকার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন নীতিমালা পালন করে থাকেন।
শিল্পউন্নতির যুগে শিল্পের শ্রেণিবিভাগ করা হয়েছে: শিল্প খাতে তিন শ্রেণির প্রতিষ্ঠান আছে
ক. বৃহদায়তন শিল্প।
খ. ক্ষুদ্র শিল্প।
গ. কুটির শিল্প।
বাংলাদেশের শিল্প প্রতিষ্ঠান সবগুলোর কাঠামো এক রকম নয়। এর মাঝে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে যারা আমদানি কৃত আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেন। এখানে জেনে রাখা ভালো যে, বৃহদায়তনের (মাঝারি সহ) শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের শিল্পখাতের আয়ে প্রায় ৬৫% এবং ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প ৩৫% অবদান রাখে। কাজের ধরন ও প্রকৃতির ভিত্তিতে শ্রমিকদের বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়েছে। শ্রম আইনের ৪ ধারায় উক্ত শ্রেণিবিভাগ উল্লিখিত হয়েছে।
১. শিক্ষাধীন শ্রমিক: কোন শ্রমিককে যদি প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে নিয়োগ করা হয় এবং প্রশিক্ষণার্থী হিসেবে ভাতা প্রদান করা হয় তাহলে তাকে শিক্ষাধীন শ্রমিক বলে। [ধারা-৪(২)]
২. বদলী শ্রমিক: কোন স্থায়ী বা শিক্ষানবিশ শ্রমিকের সাময়িক অনুপস্থিতির সময় যে সকল শ্রমিকের নিয়োগ করা হয় তাদেরকে বদলী শ্রমিক বলে। [ধারা-৪(৩)]
৩. সাময়িক শ্রমিক: কোন শ্রমিককে কোন প্রতিষ্ঠানের সাময়িক ধরনের কাজে নিয়োগ করলে তাকে সাময়িক শ্রমিক বলে। [ধারা-৪(৪)]
৪. অস্থায়ী শ্রমিক: যে সকল শ্রমিকদের অস্থায়ী ধরনের কাজে নিযুক্ত করা হয় এবং যাদের কাজ সীমিত সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাদেরকে অস্থায়ী শ্রমিক বলে। [ধারা-৪(৫)]
৫. শিক্ষানবিশ শ্রমিক: যে শ্রমিককে কোন প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী পদে নিয়োগ করা হয়েছে কিন্তু শিক্ষানবিশকাল শেষ হয়নি তাকে শিক্ষানবিশ শ্রমিক বলে। [ধারা-৪(৬)]
৬. স্থায়ী শ্রমিক: যে শ্রমিককে কোন প্রতিষ্ঠানের স্থায়ী পদে নিয়োগ করা হয়েছে কিন্তু শিক্ষানবিশকাল সস্তোষজনকভাবে শেষ করেছেন তাকে স্থায়ী শ্রমিক বলে। [ধারা-৪(৭)]
শিল্পউন্নতির যুগে শ্রমিকের স্বাধীনতা ও শ্রমমান নির্ধারণ করা হয়েছে:
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও) এর মতে “স্বাধীনভাবে কাজ করার মূলনীতি, কাজ করার অধিকার এবং শ্রমমানকে গুরুত্বের সাথে দেখা উচিত।” এই আইনটি সকল ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। একটি দেশ বা সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ নির্বিশেষে সকলেরই এই নিয়মাবলীগুলোতে সমর্থন রয়েছে। এই শ্রমমান গুণগত দিক থেকে বিচার করা হয়, পরিমাণগত দিক থেকে নয়। এছাড়াও এতে কর্মপরিবেশ, মজুরি, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার মান নির্দিষ্ট করা থাকে। এই আইনগুলো এমনভাবে করা হয়নি যাতে করে উন্নয়নশীল দেশগুলো যেসকল সুবিধা ভোগ করে আসছে, তাতে কোন ক্ষতি হয়। এই শ্রমমান হচ্ছে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকার এবং এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দলিল দ্বারা স্বীকৃত। এছাড়াও দ্যা কনভেনশন অন দ্যা রাইটস অফ দ্যা চাইল্ড (সিআরওসি) এর ১৯৩ টি সদস্য এবং আইসিসিপিআর এর ১৬০ টি সদস্য দল এই শ্রম মানকে সমর্থন করে।
মূল শ্রম মানগুলো নিম্নরূপ:
সমিতির স্বাধীনতা: শ্রমিকরা স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়নে যোগদান করতে পারবে এবং এই ট্রেড ইউনিয়নগুলো হবে সম্পূর্ণরূপে সরকার এবং তাদের নিয়োগকর্তাদের প্রভাবমুক্ত।
যৌথ দরকষাকষি করার অধিকার: শ্রমিকরা সম্মিলিতভাবে বা পৃথকভাবে নিয়োগকারীদের সঙ্গে দরাদরি করতে পারবে।
সব ধরনের জোরপূর্বক শ্রমের উপর নিষেধাজ্ঞা: সকল প্রকার দাসত্ব থেকে শ্রমিকদের নিরাপত্তা রয়েছে এবং এমনকি জেলখানাতেও শ্রমিকদের দ্বারা জোরপূর্বক কোন কাজ করানো যাবে না।
শিশুশ্রম দূরীকরণ: শিশুদের জন্য কাজ করার একটি ন্যূনতম বয়স এবং নির্দিষ্ট শর্তের প্রয়োজনীয়তা বাস্তবায়ন।
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতা: সমান কাজের জন্য সবাই সমান বেতন পাবে।
বেশ কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে খুব কম সংখ্যক আইএলও সদস্য দেশই সবগুলো নিয়মাবলী অনুমোদন দিয়েছে। এখনও এই অধিকারগুলো ইউডিএইচআর দ্বারা স্বীকৃত এবং এগুলো একটি আন্তর্জাতিক আইনের অংশ। এই আইনগুলো ছাড়াও শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে আরো ইস্যু রয়েছে। যেমন
শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের অধিকার
একটি নির্দিষ্ট স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা প্রদান
দৈনন্দিন কিছু সময়ের জন্য বিরতি
বৈতনিক ছুটি এবং আরও অনেক সুবিধা
২। শ্রমিক সমস্যা:
আধুনিক শিল্পউন্নতির যুগে শ্রমিক সমস্যা: শ্রম আইনে স্পষ্ট করে উল্লেখ্য আছে, কোন শ্রমিককে দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি শ্রম করানো যাবে না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে শ্রমিকের ইচ্ছায় ওভারটাইম বা অতিরিক্ত সময় কাজ করানো যাবে। তবে সে ক্ষেত্রে শ্রমিককে দুই ঘণ্টার বেশি ওভারটাইম করানো যাবে না। এমনকি শ্রমিকের সম্মতি থাকলেও। উল্লেখ করা আছে, ওভারটাইমের জন্য শ্রমিককে দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। অর্থাৎ কোন অবস্থাতেই কোন শ্রমিককে দশ ঘণ্টার বেশি শ্রম করানো যাবে না এবং ওভারটাইমের জন্য দ্বিগুণ মজুরি দিতে হবে। এ সবই আইনের বইয়ের গল্পকথা। বাস্তবের অবস্থাটা একেবারেই ভিন্ন। এখনো বহু শিল্প কারখানায় বিশেষ করে তৈরি পোশাক কারখানাগুলোতে একজন শ্রমিককে ১৪ ঘণ্টা থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করানো হয়। কখনো কখনো আরও বেশি। কিন্তু সেই সব শ্রমিক কখনো দ্বিগুণ মজুরি পায় না। শ্রম আইনেও উল্লেখ আছে, উপরিউক্ত আইন ভঙ্গ করলে মালিককে শাস্তি পেতে হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো মালিক এই অবৈধ কাজের জন্য শাস্তি পেয়েছে বলে শোনা যায়নি।
পুরো বাংলাদেশে প্রায় ছয় কোটি শ্রমিকের জন্য শ্রম আদালত রয়েছে মাত্র সাতটি। যার তিনটিই ঢাকায়, দুটি চট্টগ্রামে। খুলনা ও রাজশাহীতে রয়েছে একটি করে। সেই সব আদালতেও শ্রমিকেরা তাদের দুর্ভোগের জন্য ন্যায্য বিচার ঠিকমতো পায় না। তা ছাড়া এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে যাতায়াতের অসুবিধার জন্যও তাদের ভোগান্তি পোহাতে হয়। একটি ঘটনা উল্লেখ না করলেই নয়।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার একটি বিড়ি কারখানায় কাজ করেন জরিনা বানু। টানা ১৫ বছর কাজ
করার পর ২০১৫ সালে সাত মাসের বেতনসহ অন্যান্য পাওনা পরিশোধ না করেই তাকে চাকরিচ্যুত করে দেয় মালিক। পঞ্চাশোর্ধ্ব এই নারীকে শ্রম আইন অনুসারে পাওনা আদায় করতে রাজশাহীতে গিয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা করতে হয়। মামলাটি করেন তিনি ওই বছরের নভেম্বর মাসে। কিন্তু অনেক দিনেও তার মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। অথচ নিয়মানুযায়ী ৬০ দিনের মধ্যে তার মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। শ্রম আইনে শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কতখানি প্রয়োগ হচ্ছে বা হয়, তার মাত্র একটি উদাহরণ জরিনা বানু। (শ্রম আদালত নেই চার বিভাগে, দৈনিক সমকাল, ঢাকা, ০১ মে ২০১৮)।
শ্রমিকরা ছুটি থেকে বঞ্চিত:
শ্রম দিবসে সরকারি ছুটি থাকলেও সে ছুটি ভোগ করেন কেবল সরকারি শ্রমিকেরা। কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকেরা সে সুবিধা ভোগ করলেও রোজকার মতো শ্রম বিক্রি করতে হয় দৈনিক মজুরিতে নিয়োগপ্রাপ্ত বহু শ্রমিকদের। কাঁচা ইট টেনে যে শ্রমিকদের হাতে দগদগে ঘা হয়ে যায়, তারা জানে না শ্রম দিবস কি! খুব ভোরে উঠে যে শিশুটির বই খাতা ফেলে মায়ের ওষুধ কিনতে চায়ের দোকানে দিন শুরু করতে হয়, সে জানে না, তার জন্য কোন আট ঘণ্টার শ্রম দিবস নেই। সন্তানের অবহেলায় যে পিতা বয়সের ভারে নুইয়ে পরতে পরতেও সংসারের খরচ জোগাতে রিকশার প্যাডেল চেপে সকাল সন্ধ্যা মাথার ঘাম পায়ে ফেলেন, তার জন্য কোন শ্রম দিবস নেই। আগুনের ওপর দাঁড়িয়ে লোহা গলাতে যে শ্রমিকের মুখ সারাক্ষণই লাল হয়ে জ্বলছে, তার কাছে শ্রম দিবস বলে কিছু নেই।
তা ছাড়া শ্রমিকে শ্রমিকে অবস্থানগত বৈষম্য আমাদের সমাজে বহুল প্রচলিত। পোশাক-আশাকে দুরন্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে কাজ করা সরকারি কর্মচারী, করপোরেশন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা নিজেদের অনেক উঁচু মানের শ্রমিক মনে করেন। তাদের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের ব্যবধান আকাশ-পাতাল। সাধারণ শ্রমিকদের ভাগ্য নির্ধারণে নীতিমালার ব্যবস্থা সাধারণত মালিক পক্ষ ও উঁচু মানের শ্রমিকরাই করে থাকেন। খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমিকেরা যেমন মালিকের সামনে মাথা নিচু করে কথা বলেন, তেমনি উঁচু মানের শ্রমিকদের সঙ্গেও তাদের সম্পর্ক একই রকম। দুই শ্রেণির শ্রমিকদের মাঝে বেতন বৈষম্যও আরও একটি বড় সমস্যা। উৎপাদনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত নয় অর্থাৎ যারা দাপ্তরিক কাজ করেন, তাঁদের সঙ্গে সরাসরি উৎপাদনে সম্পৃক্ত শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টিতেও রয়েছে চরম বৈষম্য। সাধারণ শ্রমিকদের চেয়ে উঁচু মানের শ্রমিকদের বেতন অনেকাংশে বেশি।
তা ছাড়া উঁচু মানের শ্রমিকদের অনেকেরই গাড়ি-বাড়ি, প্রভিডেন্ট ফান্ড বা ভবিষ্যৎ তহবিলসহ রয়েছে নানান রকম অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এসবের কোন সুবিধাই নেই। বরং অনিরাপদ ও প্রতিকূল পরিবেশে ধুলো-আবর্জনায় কাজ করে তাদের অনেকেই রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। সরকারি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে পেনশনের ব্যবস্থার কথা বিবেচনা করা হলেও সাধারণ শ্রমিকদের বেলায় তা আকাশ কুসুম ভাবনা। পোশাক ও শিল্প খাতে নারী শ্রমিকের অবদান বেশি হলেও বেতনের বেলায় নারী শ্রমিকেরা হচ্ছেন বৈষম্যের শিকার। কৃষি, পরিবহন, নৌপরিবহন, মিল কারখানা, দৈনিক মজুরিতে কর্মজীবী মানুষ, শিশু শ্রমিক, নারী শ্রমিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে বেতন বৈষম্য ও সামাজিক অবস্থানগত বৈষম্য।
যত দিন পর্যন্ত শ্রমিকে শ্রমিকে বহুবিধ বৈষম্য দূরীকরণ করা না হবে, তত দিন পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের মানব সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণে সকলকে আরো সূ²ভাবে শ্রম আইন প্রতিষ্ঠা ও প্রণয়নে নজর দিতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পর্যাপ্ত শক্তিশালী হতে হবে। সর্বস্তরের শ্রমজীবী মানুষের আইনি সেবা প্রাপ্তিকে সহজ করতে হবে। সমাজতন্ত্রী ও পুঁজিবাদীদের থেকে গোটা শ্রমজীবী সমাজকে বৈষম্য ও শোষণমুক্ত করতে হলে মালিকপক্ষের সঙ্গে, উঁচু মানের শ্রমিকদের সঙ্গে সাধারণ শ্রমিকদের অবস্থানগত সম্পর্ক গুঁড়িয়ে ইনসাফ নিয়ে আসতে হবে।
আধুনিক শিল্পউন্নতির যুগে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই নাজুক। যে পরিমাণ অর্থ এবং বৈদেশিক আধুনিক যন্ত্রপাতি বৃহদায়তনের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রয়োজন তা নেই বললেই চলে। ফলে শিল্পউন্নতির সুযোগ সুবিধা শ্রমিকদের বেশি পাওয়ার কথা থাকলেও তা কেবল কিছু সেক্টরে সীমাবদ্ধ।
ফলে আধুনিক শিল্পউন্নতির পথে অন্তরায় কিছু সমস্যা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি
১। দেশীয় অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততা।
২। উদ্যোক্তার অভাব।
৩। শিল্প ঋনের পরিমাণ কম হওয়ায় অর্থসংস্থানের অভাব।
৪। দুর্বল অবকাঠামো।
৫। দক্ষ জনশক্তি ও পেশাগত শিক্ষার অভাব।
৬। প্রযুক্তির পশ্চাৎপদ।
৭। নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারি নতজানু নীতি।
৮। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়া।
৯। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা।
১০। সীমাহীন দুর্নীতি ইত্যাদি।
এগুলো সমাধানের পথ যত দ্রুত উন্নত হবে আধুনিক শিল্প উন্নতির দুয়ার ততবেশি উন্মুক্ত হবে। এক্ষেত্রে আমদেরকের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিশেষ করে আধুনিক বৃহদায়তনের শিল্প প্রতিষ্ঠান কৃষি পরিবহন সহ সকল ধরনের শ্রম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। যেমনÑ বস্ত্র ও পোশাক শিল্প (গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান),পাট শিল্প, চা শিল্প, কাগজ শিল্প, চামড়া শিল্প। তাছাড়াও ক্ষুদ্র শিল্প এবং কুঠির শিল্পকে আমরা চাইলেই আধুনিকতার ছোঁয়ায় (মডেল রূপে) গড়ে তুলতে পারি। ব্যক্তি ও পারিবারিক উদ্যোগের সাথে সাংগঠনিক সহযোগিতা একত্রিত করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশে কোটি কোটি শ্রমিক আছেন যারা কর্মক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত এই সমস্যা পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে বর্ণনা করা বা চিহ্নিত করা আসলেই খুব কঠিন। কিছু সমস্যা তুলে ধরা হলো
১। দেশে প্রায় ৬ কোটি ৮৬ লাখ শ্রমিক আছেন, সবার সামাজিক সুরক্ষার অভাব।
২। স্বাস্থ্য সুরক্ষার অভাব।
৩। বেতন-ভাতা, চাকুরির নিরাপত্তার অভাব।
৪। শিক্ষা সুরক্ষার অভাব।
৫। মাতৃত্বকালীন সুরক্ষার অভাব।
৬। কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনাকালীন সুরক্ষার অভাব।
৭। শিশু সুরক্ষার অভাব।
৮। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে বাধা।
৯। তথ্য প্রযুক্তির প্রশিক্ষণের অভাব।
১০। পেশাগত শিক্ষার অভাব।
১১। রাজনৈতিক বৈষম্য।
১২। কর্ম বৈষম্য।
১৩। নিদারুণ দারিদ্রতা।
১৪। নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি।
১৫। শ্রমবান্ধব ট্রেড ইউনিয়নের অভাব।
১৬। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি।
এভাবে বর্ণনা করতে গেলে আরো অনেক সমস্যা বের হবে। যেগুলো যুগ যুগ ধরে এদেশের শ্রমিক শ্রেণিকে যাতাকলে পিষ্ট করছে। এভাবে পিষ্ট হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন অগনিত শ্রমিক। যাদের ঘাম শুকিয়ে গেছে পারিশ্রমিক পাননি। কিন্তু আমরা এর দায় এড়াতে পারি না। আমরাও এপর্যন্ত তেমন কিছুই করতে পারিনি তাঁদের জন্য। আমাদেরতো দায়বদ্ধতা আছে ৬ কোটি ৮৬ লাখ শ্রমিক ভাই বোনদের কাছে। যাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের কার্যকর প্ল্যাটফরম আজও আমরা গঠন করতে পারিনি। তাই তারা এখন রাজনৈতিক পালাবদলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। সুশাসনের মুখ আজও তারা দেখতে পাননি। ইসলামী শ্রমনীতি, ন্যায় ও ইনসাফ ভিত্তিক সমাজ এখন তাদের কাছে স্বপ্নের মতো।
চলবে…………
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।