হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট সেক্টরের শ্রমিকগণ বাংলাদেশের শ্রমিক অঙ্গনের বৃহত্তম শ্রমিক সেক্টরের গর্বিত সদস্য। যারা মানুষের মৌলিক চাহিদা খাদ্য তৈরি ও পরিবেশনের সাথে সম্পৃক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রাচীন পেশাকে বক্ষে ধারণ করে যুগ যুগ ধরে মানুষের সেবা করে আসছে। এই সেবামূলক সেক্টরের শ্রমিকদের রয়েছে নানাবিধ সমস্যা। বিদ্যমান রাষ্ট্র কাঠামো ও মালিক পক্ষের সৃষ্ট দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা ও পাহাড় সম নীরব কান্নার মানবিক সমাধান একান্ত প্রয়োজন। আমরা সকলেই জানি এদেশের হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট শ্রমিকগণ অন্য পেশার শ্রমিকদের মতই সমস্যার পাহাড় মোকাবেলা করে জীবন যুদ্ধে কোন রকমে টিকে রয়েছে। তাদের বাস্তব কিছু সমস্যা ও করণীয় নিয়ে আমার আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
হোটেল শব্দটি ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি শব্দ থেকে এসেছে। ১৬শ শতাব্দীতে মোগল আমলে ফরাসিগণ এদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসার পর থেকে খাবারের প্রয়োজনে হোটেলের প্রচলন শুরু হয়। যদিও সুলতানি আমলে সরাইখানার ব্যাপক প্রচলন ছিল এবং এই সরাইখানা ভ্রমণকারী অতিথিদের থাকা খাওয়া মৌলিক সকল প্রকার প্রয়োজন পূরণ করতো। সময়ের ব্যবধানে সরাইখানার বিপরীতে জায়গা করে নিল হোটেল মোটেল রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরা।
হোটেল এমন একটি সংস্থা যা কেবলমাত্র স্বল্প-মেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে টাকার বিনিময়ে থাকা ও খাবার ব্যবস্থা করে এবং অতিথিকে অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা সরবরাহ করে থাকে। সাধারণত হোটেল বলতে আমরা এ ধরনের ব্যবস্থাপনাকেই বুঝে থাকি। যুগের বিবর্তনে বা সময়ের ব্যবধানে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে গ্রামীণ জনপদের হাট-বাজারে নগর-বন্দর শহরে মানুষের আনাগোনা ও কর্মব্যস্ততা বেড়ে গেল। ফলে মানুষের ক্ষুধা নিবারণ বা খাদ্যের প্রয়োজনে গড়ে উঠলো খাবারের হোটেল। এলাকা ও অবস্থাভেদে এ হোটেল গুলো বিভিন্ন মানে ও নামে পরিচিতি লাভ করলো। কোথাও বাসের চাটাই দিয়ে তৈরি হল খাবার হোটেল, আবার কোথাও টিনের ঘরে। কোথাও আধাপাকা বিল্ডিংয়ে কোথাও আবার অতিথিদের মনোরঞ্জন ও সুখ সুবিধার বিবেচনায় আধুনিকতার ছোঁয়ায় অত্যাধুনিক বহুতল ভবনে গড়ে উঠল পাঁচ তারকা হোটেল। একতারা থেকে পাঁচ তারা বিভিন্ন নামে খ্যাত হোটেলগুলো অর্থের বিনিময়ে অতিথিগণকে জিম, সুইমিং পুল, চোখ ঝলসানো, বিনোদনের বিভিন্ন উপকরণসহ আধুনিক সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকে।
অন্যদিকে, মোটেল একটি সংস্থা যা স্বল্প সময়ের জন্য অর্থের বিনিময়ে অতিথির খাবার ও বিশ্রাম বা আরামের ব্যবস্থা করে থাকে। এগুলো সাধারণত মহাসড়কের পাশে হয়ে থাকে। যেগুলোতে মোটরযান বা গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা রয়েছে। অপরদিকে রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ বলতে আমরা এমন একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান কে বুঝি যেখানে খাবার তৈরি হয় এবং অর্থের বিনিময়ে তা গ্রাহকের নিকট সরবরাহ করা হয়। হোটেল, মোটেল রেস্টুরেন্ট বা রেস্তোরাঁ যে নামেই ডাকা হোক না কেন উদ্দেশ্য ও কর্মের ধারা প্রায় একই।
মনুষ্য জাতির ভোজন ক্রিয়া ও রসনাবিলাস সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যাদি সম্পাদন তথা মানবকূলের আহার তৈরি ও পরিবেশনের কাজে হোটেল মোটেল ও রেস্টুরেন্টে যারা জড়িত থাকে তাদেরকেই আমরা এই পেশার শ্রমিক হিসেবে চিহ্নিত করে থাকি। কাজের ধরন অনুযায়ী এ পেশায় শ্রমিকদের নিম্নলিখিত উপাধি দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন বাবুর্চি বা সেফ, কারিগর, মেসিয়ার ও হোটেল বয়।
বাবুর্চি বা শেফ বলতে সাধারণত আমরা হোটেলে যারা ভাত, মাছ, মাংস, শাকসবজি রান্না বান্নার কাজ করে থাকে তাদেরকে বাবুর্চি বা সেফ বলে থাকি। আর মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার যারা তৈরি করেন তাদেরকে কারিগর এবং যারা খাবার টেবিলে খাদ্যদ্রব্য ও পানীয় সরবরাহ করে থাকে তাদেরকে মেসিয়ার এবং পরিছন্নতার কাজ যেমন প্লেট ধোঁয়া, টেবিল পরিষ্কার করা সহ অন্যান্য আরও ছোটখাটো কাজে নিয়োাজিত থাকে তাদেরকে হোটেল বয় বলা হয়ে থাকে। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন সকলকে আমরা হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট শ্রমিক হিসেবে গণ্য করি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট সার্ভে ২০২১’ এর প্রতিবেদন অনুযায়ী এদেশে হোটেলের সংখ্যা ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৭৪টি। আর এই পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ২০ লক্ষ ৭১ হাজার। তবে বেসরকারি ও অন্যান্য তথ্যসূত্রে এ পেশার নিয়মিত ও অনিয়মিত শ্রমিক সংখ্যা ৩০ লাখেরও বেশি হবে। অঙ্কের হিসাবে যাই হোক না কেন দিব্য চোখেই তো আমরা দেখতে পাচ্ছি বিশাল এক জনগোষ্ঠী যুগ যুগ ধরে এদেশের হোটেল, মোটেল ও রেস্টুরেন্ট গুলোতে আমাদের জন্য আহার তৈরি ও পরিবেশনের কাজে ব্যস্ত রয়েছে। কিন্তু বাস্তব সত্য কথা হলো যে আজ তারা নানাবিধ জুলুম ও বৈষম্যের শিকার। বড় দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় যে, আগুনের তাপ ও ধোঁয়া সহ্য করে যারা সারাদিন ধরে অন্যের আহার তৈরি করার কাজে ব্যস্ত থাকে দিনশেষে তাদের চুলায় ওঠে না ভাতের হাড়ি। হয় না তাদের পরিবারের আহারের ব্যবস্থা। নেই তাদের চাকরির নিশ্চয়তা, নেই জীবনের নিরাপত্তা, কিংবা সম্মানজনক সামাজিক অবস্থান। মালিক ও রাষ্ট্রক্ষের নানাবিধ অবজ্ঞা ও অবহেলা শিকার হয়ে বছরের পর বছর মৌলিক মানবীয় চাহিদা হতে বঞ্চিত। ক্ষেত্র বিশেষে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে জীবন জীবিকার তাগিদে এই পেশাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। বাস্তবতার আলোকে এ পেশার কিছু চলমান সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে উল্লেখ করা হলো।
সমস্যা:
রমজান মাসে মজুরি না পাওয়া : বাংলাদেশ একটি মুসলিম প্রধান দেশ। ইসলামের বিধান অনুযায়ী দিনের বেলা পানাহার নিষিদ্ধ। তাই ইসলামি নীতি ও ঐতিহ্য অনুযায়ী ধর্মীয় বিধি-বিধান পালনের সুবিধার্থে দিনের বেলা অধিকাংশ হোটেল রেস্টুরেন্ট বন্ধ রাখা হয়। মালিক শ্রমিক সকলেই চাই এই মাসে একটু বেশি ইবাদত বন্দেগি করে আল্লাহর সান্নিধ্য পেতে। মালিক শ্রমিক সকলে রোজা রাখলেও এখানে ঘটনা একটু ভিন্ন রকমের ঘটে। এ মাসে শ্রমিকগণ কোন বেতন ভাতা পায় না। অন্যান্য মাসে যা বেতন পায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তা থেকে যে কিছু সঞ্চয় করে রাখবে সে সুযোগও তাদের হয় না। ফলে রোজার মাসে সেহরি ও ইফতারি খাওয়ার মত কোন খাদ্য উপকরণ তাদের কাছে থাকে না। অনেক সময় পরিবার-পরিজন নিয়ে না খেয়ে রোজা রাখেন আর পানি মুখে দিয়ে ইফতারি করেন। এরপর ঈদের দিনে হয় আরেক কষ্ট। এই পেশার শ্রমিকের সন্তানেরা অন্যদের নতুন পোশাক দেখে যখন পিতা-মাতার কাছে এসে বায়না ধরে তখন হতভাগা শ্রমিকদের নিরবে চোখের জল মুছা ছাড়া আর করার কিছুই থাকে না।
নিয়োগপত্র না থাকা : শ্রমিকদের অন্যতম আরেকটা সমস্যা হচ্ছে নিয়োগপত্র ও চাকরির বিধিমালা না থাকা। দেশের প্রচলিত শ্রম আইন ও বিধিমালা কে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখায় মালিকগণ যুগ যুগ ধরে দৈনিক হাজিরা প্রথার ভিত্তিতে মজুরি দিয়ে আসছে। দৈনিক হাজিরা প্রথার ভিত্তিতে শ্রমিকদের ভাগ্যের কোন উন্নয়ন হয় না, কারণ এই প্রথায় রয়েছে কথায় কথায় ছাঁটাই এর ব্যবস্থা। ফলে শ্রমিকদের সব সময় ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়। আর এভাবে ভয়ে ভয়ে থাকতে থাকতে একসময় তারা মালিকদের সামনে উচিত কথা বলার ন্যূনতম সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলে। কর্মহারার চিন্তা সব সময় তাকে তাড়া করে ফিরে। এই বুঝি তার কর্মটা চলে গেল। এইভাবে নানা রকম চিন্তা ও আতঙ্কে থাকতে থাকতে অসতর্কতা বসত হঠাৎ তার হাত থেকে গ্লাস বা প্লেট পড়ে ভেঙে গেলে গুনতে হয় জরিমানা, শুনতে হয় মালিকের অসভ্য গালিগালাজ। কোনো সময় জোরে কথা বললে মালিকের লেলিয়ে দেওয়া মাস্তানদের চড় থাপ্পড় তথা শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়। বিকল্প কোনো কর্ম না থাকায় নিরুপায় হয়ে ওই মালিকের অধীনেই কোনোরকমে কর্মটি চালিয়ে যেতে হয়।
উৎসব ভাতা ও অতিরিক্ত কর্মের মজুরি না থাকা : যেহেতু এই পেশার শ্রমিকদের কোন নিয়োগ নেই, তাই তারা কোন উৎসব ভাতা পায় না। ফলে বছরে দুই ঈদ কিংবা পূজা পার্বনে অন্যেরা যখন আনন্দ করে তখন এই পেশার শ্রমিকেরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে আর আফসোস করতে থাকে। হায়! আমরাও তাদের মত মানুষ। আমাদের ভাগ্যে কেন নতুন পোশাক জোটে না? আমরা কেন আনন্দ করতে পারি না? এরূপ আফসোস নিজের কাছে হাজারো প্রশ্ন করা ছাড়া তো তাদের আর করার কিছুই নেই। আগুনের তাপ ও ধোঁয়া সহ্য করে ১৬ থেকে ১৮ ঘণ্টা পরিশ্রম করতে করতে করে এক সময় তারা দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পড়লে তখন তাদেরকে দেখার মত আর কেউ থাকে না। বৃদ্ধ বয়সে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়। এভাবে খাদ্য ও বস্ত্রের অভাবে এক সময় খুবই করুণভাবে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়।
বাস্তবতার আলোকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
ক. কার্যকর মজুরি বোর্ড গঠনের মাধ্যমে আধুনিক জীবন ব্যবস্থা ও বাজার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতি রেখে মজুরি নির্ধারণ।
খ. রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বেকার শ্রমিকদের মাসিক ভাতা ব্যবস্থা চালু করা।
গ. রমজান মাসে পূর্বের যেকোনো এক মাসের সমান বেতন সাপেক্ষে ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা করা। সেই সাথে মুসলমানদের জন্য দুই ঈদে, হিন্দুদের জন্য দুর্গা পূজায় এবং সকলের জন্য বৈশাখী উৎসব ভাতা চালু করা।
ঘ. নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র চালু ও সার্ভিস বেনিফিট প্রদানের ব্যবস্থা করা।
ঙ. সাপ্তাহিক ও উৎসব ছুটির ব্যবস্থা ও ওভারটাইমে জন্য বিশেষ মজুরি নির্ধারণ।
চ. কথায় কথায় শ্রমিক ছাঁটাই ও শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন-নির্যাতন বন্ধ করা।
ছ. স্বাস্থ্যসম্মত কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, বিশুদ্ধ পানির সুব্যবস্থা করা।
ঝ. রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে শ্রমিকদের সন্তানদের অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা।
যেহেতু হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট রাজস্ব আদায়ের একটি সম্ভাবনাময় প্রতিশ্রæতি খাত। সেহেতু এ খাাতে সেবার মান বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশি-বিদেশী অতিথি, পর্যটকদের আকৃষ্ট করে প্রচুর পরিমাণ রাজস্ব আদায়ের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে অবদান রাখা সম্ভব।
লেখক: কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।