শেষ পর্ব
রুহামায়ু বায়নাহুম-পরস্পর সহানূভুতিশীল সম্পর্ক : আসহাবে রাসুল (সা.) ছিলেন সুশৃঙ্খল। এই কারণেই আল্লাহ তাআলা বলেছেন, “আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন যারা তাঁর পথে সারিবদ্ধভাবে লড়াই করে যেন তারা সীসা ঢালা প্রাচীর” (সুরা সফ: ৫)। মূলত যারা আল্লাহর রাসুলের দাওয়াতে সাড়া দিতেন তিনি তাদের যে শিক্ষা দিতেন তা হচ্ছে, ‘Listen and obey’ শুনো এবং আনুগত্য কর। অতএব আসহাবে রাসুল (সা.) তাঁর কথা শোনার জন্য মরিয়া থাকত। হযরত আবু হুরাইরা (রা) সব সময় মসজিদে নববীতে থাকতেন। আর তাঁদের বলা হতো আসহাবে সুফফা। আর কোনো সিদ্বান্ত তাঁদের মনঃপূত না হলেও তা তাঁরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিতেন। এইভাবে শুনা ও আনুগত্য করার প্র্যাক্টিসের কারণেই অল্প সংখ্যক সাহাবারা বিরাট বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে জয়লাভ করে। মূলত একটি জামায়াত যত বড়োই হোক না কেন তার মধ্যে শৃঙ্খলা না থাকলে তাদের পক্ষে বড়ো কোনো টার্গেট হাসিল করা সম্ভব নয়। আর এই কারণেই ইমাম সাহেব প্রত্যেক নামাজের আগে তার মুসল্লিদের সফবন্দি হয়ে অর্থাৎ কাতার সোজা করে দাঁড়ানোর জন্য তাগিদ দেন। তিনি এই কথাও স্মরণ করিয়ে দেন যে, দুই জন মুসল্লির মাঝে ফাঁকা থাকলে শয়তান এসে ঢুকে পড়ে। অতএব, যারা সমাজ বিপ্লব করতে চান তারা সুশৃঙ্খল না হলে এবং নেতৃত্বের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত আনুগত্য না থাকলে তাদের পক্ষে সমাজ সংস্কার আন্দোলন নিরলসভাবে চালিয়ে যাওয়া কঠিন। আর নিজেদের মাঝে ঐক্য, সম্প্রীতি ও ভালোবাসা না থাকলে পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে। পারস্পরিক বিভেদ সৃষ্টি হলে আল্লাহ তায়ালার রহমত উঠে যায়। এই কারণে আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর সঙ্গী-সাথীদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল “রুহামায়ু বায়নাহুম”। আর এই কথাটিই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এই ভাষায় উল্লেখ করেন, “মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসুল এবং তাঁর সহচরগণ কাফিরদের প্রতি কঠোর এবং নিজেদের মধ্যে পরস্পর সহানূভুতিশীল।” (সুরা ফাতহ: ২৯)
আল্লাহর রাসুলের প্রতি সাহাবাদের আনুগত্য ছিল দ্বিধাহীন। কিন্তু প্রয়োজনের আলোকে তাঁরা শ্রদ্ধা ও বিনয়মাখা ভাষায় জানতে চাইতেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার এই সিদ্বান্ত কী আল্লাহর পক্ষ থেকে নাজিলকৃত ওহির ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে না আপনার সিদ্বান্ত এবং এতে কোনো মতামত দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি না? সাহাবারা যে কোনো নির্দেশ জীবন দিয়ে হলেও বাস্তবায়নে সদা সচেষ্ট থাকতেন। তারপরও বিভিন্ন সময় দেখা যায় যুদ্ধ কৌশলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ থাকলে তাদের আপন মতামত ব্যক্ত করতেন। আর আল্লাহর রাসুল (সা.) কখনো কখনো তাদের মতামতের আলোকে সিদ্বান্ত গ্রহণ করতেন এবং পূর্ববর্তী সিদ্বান্ত পরিবর্তন করতে দ্বিধা করতেন না। যেমন বদর যুদ্ধে আল্লাহর রাসুল (সা.) যে স্থানে মুসলিম বাহিনীর জন্য বাছাই করেন তা হুবাব ইবনে মুনযের এর মতো একজন কম পরিচিতি সাহাবার পরামর্শে সে স্থান ত্যাগ করেন। কারণ তাঁর পরামর্শ ছিল পানির ক‚প মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য এবং বদর ক‚পের পাশেই মুসলিম বাহিনী থাকা উত্তম। উক্ত সাহাবির যুদ্ধ কৌশল (War strategy) আল্লাহর রাসুল (সা.) পছন্দ করেন এবং তার মতের আলোকেই স্থান নির্ধারণ করেন। খন্দকের যুদ্ধে হযরত সালমান ফারসীর পরামর্শক্রমেই পরিখা খনন করেন। কোনো সিদ্বান্ত সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়া আর শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা এক কথা নয়। আবার কোথাও কোথাও তিনি আপন সিদ্বান্তে অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন। যেমন হুদাইবিয়ার সন্ধিকালে যখন প্রতিপক্ষ ‘মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ এর পরিবর্তে মুহাম্মাদ ইবন আবদুল্লাহ লিখতে বলে তখন কোনো সাহাবিই রাসুলুল্লাহ শব্দটি মুছে ফেলতে চাননি। এমতাবস্থায় আল্লাহর রাসুল (সা.) নিজ হাতে উক্ত শব্দটি মুছে ফেলেন। যদিও কোনো কোনো সাহাবা এটাঁকে অপমানজনক চুক্তি হিসাবে আখ্যায়িত করে কিন্তু আল্লাহ তায়ালা উক্ত সন্ধিকে “ফাতহুম মুবিন তথা মহা বিজয়” হিসাবে উল্লেখ করেন।
আসহাবে রাসুল (সা.)-এর আনুগত্যের নজির অসংখ্য। আল্লাহর রাসুল (সা.) পুরো মক্কী জীবনে সকল জুলুম নির্যাতন নীরবে সহ্য করা ছিল আল্লাহর নির্দেশ। সে সময় কোনো প্রতিরোধ এর বিধান ছিল না। সাহাবারা নীরবে নির্যাতন সহ্য করেন। মক্কা থেকে হাবশা হিজরাত করেন কিন্তু কোনো পাল্টা আক্রমণ করেননি।
কষ্ট ও সহিষ্ণুতা : রাসুল (সা.) মক্কাতে ইসলামি দাওয়াতের ক্ষেত্রে সর্বদা ধৈর্য অবলম্বনের পন্থা গ্রহণ করেছেন, কোনোভাবেই প্রতিরোধের চেষ্টা করেননি। এতে করে সাধারণ মানুষের নিকট ইসলামি দাওয়াতের প্রকৃত লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং মানুষ বুঝতে পারে এ দাওয়াত মানুষের কল্যাণের জন্য। পবিত্র কুরআন মক্কার সুরা গুলোতে বারবার ধৈর্যের সাথে এ কাজ করার জন্য উৎসাহিত করেছে। সবরের এ শিক্ষা আল্লাহ তায়ালা সকল নবিদেরকে দিয়েছেন। নুহ (আ.) দীর্ঘ নয়শত পঞ্চাশ বৎসর যাবৎ শুধু একত্ববাদের দাওয়াত দিয়েছেন, তার জাতির লোকেরা তার কথায় কোনো কর্ণপাত করেনি। ইব্রাহিম (আ.) দীর্ঘ সময় দাওয়াতের কাজ করেছেন তার দাওয়াতে লোকেরা তেমন সাড়া দেননি।
মূসা (আ.) কীভাবে বড়ো হলেন, মিশর থেকে হিজরত করে মাদায়েনে গেলেন কত ঘাত প্রতিঘাত ও সংগ্রাম করে দ্বীনের পথে তাকে চলতে হলো। তাকে কত কষ্ট ও ধৈর্য অবলম্বন করে দাওয়াতের কাজ করতে হলো, রাসুল (সা.) কে মক্কার লোকেরা কত কষ্ট দিল, তার সাহাবাদেরকে অমানুষিক নির্যাতন সহ্য করতে হলো, তারপরও রাসুল (সা.) কে শিক্ষা দিলেন। “অতএব আপনি সবর করুন, যেমনি বড়ো বড়ো রাসুলগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবেন না”। (সুরা আহকাফ: ৩)
তার সামনেই আম্মার, তার মা, তার পিতাকে মক্কার লোকেরা কঠিন শাস্তি দিচ্ছিল। তিনি শুধু বললেন, ইয়াসিরের পরিবার ধৈর্য ধরার তোমাদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা রয়েছে। (আল-হালাবীয়া, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৩৩৭)
সকল পরিস্থিতি ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা : “হে ঈমানদারগণ সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থীদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও। হকের খিদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে” (আলে-ইমরান: ২০০)। মাওলানা মওদুদী তাঁর ‘ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী’ গ্রন্থে ধৈর্য সম্পর্কে চমৎকার আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে ধৈর্যের বহু অর্থ হয় এবং আল্লাহর পথে যারা কাজ করে তাদের এর প্রত্যেকটি অর্থের প্রেক্ষিতেই ধৈর্যশীল হতে হয়। ধৈর্যের এক অর্থ হচ্ছে তাড়াহুড়া না করা, নিজের প্রচেষ্টার ত্বড়িত ফল লাভের জন্য অস্থির না হওয়া এবং বিলম্ব দেখে হিম্মত হারিয়ে না বসা। ধৈর্যের দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে তিক্ত স্বভাব, দুর্বলমত ও সংকল্পহীনতার রোগে আক্রান্ত না হওয়া। ধৈর্যের আরেক অর্থ হচ্ছে বাধা বিপত্তির বিরোচিত মোকাবিলা করা এবং শান্ত চিত্তে লক্ষ্য অর্জনের পথে যাবতীয় দুঃখ কষ্ট বরদাশত করা। ধৈর্যের আরেক অর্থ হচ্ছে, দুঃখ-বেদনা-ভারাক্রান্ত ও ক্রোধান্বিত না হওয়া, সকল প্রকার ভয়-ভীতি ও লোভ-লালসার মোকাবেলায় সঠিক পথে অবিচল থাকা, শয়তানের উৎসাহ প্রদান ও নফসের খাহেশের বিপক্ষে নিজের কর্তব্য সম্পাদন করা। হারাম থেকে দূরে থাকা ও খোদার নির্দেশিত সীমার মধ্যে অবস্থান করা, গুনাহের যাবতীয় আরাম আয়েশ, লাভ প্রত্যাখ্যান করা এবং নেকি ও সততার পথে সকল প্রকার ক্ষতি ও বঞ্চনা সাদরে গ্রহণ করা।
তাদের অবস্থা এই যে, তারা তাদের রবের সন্তুষ্টির জন্য সবর করে, নামাজ কায়েম করে, গোপনে ও প্রকাশ্যে আমার দেওয়া রিজিক থেকে খরচ করে এবং মন্দকে ভালো দ্বারা দূর করে। আখেরাতের ঘর এ লোকদের জন্যই রয়েছে। অর্থাৎ তা এমন বাগান, যা তাদের চিরস্থায়ী বাসস্থান হবে। তারা নিজেরাও তাতে প্রবেশ করবে এবং তাদের বাপ-দাদা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেককার তারাও সেখানে তাদের সাথে যাবে। আর ফেরেশতারা সব দিক থেকে তাদেরকে সমাদর জানাতে আসবে এবং তাদেরকে বলবে “তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। তোমরা দুনিয়ায় সবর করার বদলায় আজ এর ভাগী হয়েছো। তাই আখেরাতের ঘর কতই না ভালো।” (সুরা রা’দ: ২২-২৪)
আদর্শের বিজয়ের ব্যাপারে আত্মপ্রত্যয় থাকতে হবে : এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন যে, তিনি এবং তাঁর রসুল অবশ্যই বিজয়ী হবেন। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ মহাশক্তিমান ও পরাক্রমশালী।
“তোমরা কখনো এমন দেখতে পাবে না যে, যারা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি ঈমান পোষণ করে তারা এমন লোকদের ভালবাসছে যারা আল্লাহ ও তাঁর রসুলের বিরোধিতা করেছে। তারা তাদের পিতা, অথবা পুত্র অথবা ভাই অথবা গোষ্ঠীভুক্ত হলেও তাতে কিছু এসে যায় না। আল্লাহ এসব লোকদের হৃদয়-মনে ঈমান বদ্ধমূল করে দিয়েছেন এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি ‘রুহ’ দান করে তাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তিনি তাদেরকে এমন জান্নাতসমূহে প্রবেশ করাবেন যার পাদদেশ দিয়ে নহরসমূহ প্রবাহিত হতে থাকবে। তারা সেখানে চিরদিন অবস্থান করবে। আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। তারা আল্লাহর দলের লোক। জেনে রেখো আল্লাহর দলের লোকেরাই সফলকাম।” (আল-মুজাদিলাহ: ২১-২২)
আর্থিক কুরবানি পেশ করা : এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “যারা সচ্ছল ও অসচ্ছল সব অবস্থায়ই অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে এবং যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষক্রটি মাফ করে দেয়। এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন। আর যারা কখনো কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা কোনো গুনাহের কাজ করে নিজেদের ওপর জুলুম করে বসলে আবার সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে তাঁর কাছে নিজেদের গুনাহ খাতার জন্য মাফ চায় কারণ আল্লাহ ছাড়া আর কে গুনাহ মাফ করতে পারেন এবং জেনে বুঝে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জোর দেয় না।” (আল ইমরান: ১৩৪-১৩৫)
সংকটকালে ত্যাগের নজরানা স্থাপন করতে হবে : এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “কী ব্যাপার যে, তোমরা আল্লাহর পথে খরচ করছো না, অথচ জমিন ও আসমানের উত্তরাধিকার তাঁরই। তোমাদের মধ্যে যারা বিজয়ের পরে অর্থ ব্যয় করবে ও জিহাদ করবে তারা কখনো সেসব বিজয়ের সমকক্ষ হতে পারে না যারা বিজয়ের পূর্বে ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে। বিজয়ের পরে ব্যয়কারী ও জিহাদকারীদের তুলনায় তাদের মর্যাদা অনেক বেশি। যদিও আল্লাহ উভয়কে ভাল প্রতিদানের প্রতিশ্রæতি দিয়েছেন। তোমরা যা করছো আল্লাহ সে সম্পর্কে অবহিত। এমন কেউ কী আছে যে আল্লাহকে ঋণ দিতে পারে? উত্তম ঋণ যাতে আল্লাহ তা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করে ফেরত দেন। আর সেদিন তার জন্য রয়েছে সর্বোত্তম প্রতিদান।” (সুরা হাদিদ: ১০-১১)
যার কাছে যা বেশি প্রিয় তাকে সে বস্তু ত্যাগ করতে হবে : এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, “তোমরা কখনো পূণ্যের মর্যাদা লাভ করতে পারবে না যতক্ষণ না তোমরা নিজেদের পছন্দনীয় জিনিস আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, সে সম্পর্কে আল্লাহ পূর্ণ জ্ঞাত” (সুরা আলে ইমরান: ৯২)। এই আয়াতটি নাজিল হবার পর সাহাবায়ে কেরাম প্রত্যেকে নিজ নিজ সহায় সম্পত্তির প্রতি লক্ষ্য করলেন যে কোনোটি তাঁদের নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়। এরপর আল্লাহর পথে তা ব্যয় করার জন্য তাঁরা রাসুলুল্লাহ (সা.) এর কাছে আবেদন করতে লাগলেন। মদিনায় আনসারগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষা ধনী ছিলেন হযরত আবু তালহা (রা.)। মসজিদে নববী সংলগ্ন বিপরীত দিকে তাঁর একটি বাগানে বীরহা নামে একটি কূপ ছিল। বর্তমানে বাগানের স্থলে বাবে মজীদির সামনে “আস্তফা মনজিল’’ নামে একটি দালান রয়েছে। এতে মদিনা যিয়ারতকারী হাজীগণ অবস্থান করেন। এর উত্তর পূর্ব কোনে বীরহা ক‚পটি অদ্যবধি স্বনামে বিদ্যমান রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (স.) মাঝে মধ্যে এ বাগানে প্রবেশ করতেন এবং বীরহা কূপ থেকে পানি পান করতেন। একূপের পানি তিনি পছন্দ করতেন। আবু তালহার এ বাগান অত্যন্ত মূল্যবান, উর্বর ও তাঁর বিষয় সম্পত্তির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। আলোচ্য আয়াত অবতীর্ণ হবার পর তিনি রাসুলুল্লাহ (স.) এর খেদমতে হাযির হয়ে আরয করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমার সব বিষয় সম্পদের মধ্যে বীরহা আমার কাছে সব চেয়ে প্রিয় আমি এটি আল্লাহর পথে ব্যয় করতে চাই। আপনি যে কাজে পছন্দ করেন এটি তাতেই খরচ করেন। হুজুর (স.) বললেন বিরাট মুনাফার এ বাগানটি আমার মতে আপনি আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বণ্টন করে দিন। হযরত আবু তালহা এ পরামর্শ শিরোধার্য করে বাগানটি আত্মীয় স্বজন ও চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দিলেন” (বুখারি ও মুসলিম)। এ হাদিস থেকে জানা গেল যে শুধু ফকীর মিসকিনকে দিলেই পুণ্য হয় না, পরিবার পরিজন ও আত্মীয় স্বজনকে দান করারও বিরাট পুণ্য ও সওয়াবের কাজ। হযরত উসমান তাঁর সম্পদের এক তৃতীয়াংশ দান করেছেন। আর হযরত আবু বকর তার যা ছিল সব কিছুই আল্লাহর রাসুলের কাছে উপস্থিত করেছেন।
মন্দের জবাব উত্তমভাবে দেওয়া : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “হে নবি, সৎ কাজ ও অসৎ কাজ সমান নয়। তুমি অসৎ কাজকে সে নেকি দ্বারা নিবৃত্ত করো যা সবচেয়ে ভাল। তাহলে দেখবে যার সাথে তোমার শত্রুতা ছিল সে অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে গিয়েছে। ধৈর্যশীল ছাড়া এ গুণ আর কারো ভাগ্যে জোটে না। এবং অতি ভাগ্যবান ছাড়া এ মর্যাদা আর কেউ লাভ করতে পারে না।” (হামীম-আস-সাজদাহ: ৩৪-৩৫)
পরস্পর বিবাদে লিপ্ত না হওয়া এবং আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা নষ্ট না করা : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, “হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কোনো বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর যাতে তোমরা উদ্দেশ্যে কৃতকার্য হতে পার। আর আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মান্য কর এবং তাঁর রসুলের। তাছাড়া তোমরা পরস্পরে বিবাদে লিপ্ত হইও না। যদি তা কর, তবে তোমরা কাপুরুষ হয়ে পড়বে এবং তোমাদের প্রভাব চলে যাবে। আর তোমরা ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’য়ালা রয়েছেন ধৈর্যশীলদের সাথে। আর তাদের মত হয়ে যেয়ো না, যারা বেরিয়েছে নিজেদের অবস্থান থেকে গর্বিতভাবে এবং লোকদেরকে দেখাবার উদ্দেশে। আর আল্লাহর পথে তারা বাধা দান করত। বস্তুত: আল্লাহর আয়ত্তে রয়েছে সে সমস্ত বিষয় যা তারা করে।
সর্বাবস্থায় সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে চলতে হবে : আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, এছাড়াও তাঁর নির্দেশ হচ্ছে এই, এটিই আমার সোজা পথ। তোমরা এ পথেই চলো এবং অন্য পথে চলো না। কারণ তা তোমাদের তাঁর পথ থেকে সরিয়ে ছিন্নভিন্ন করে দেবে। এ হেদায়াত তোমাদের রব তোমাদেরকে দিয়েছেন, সম্ভবত তোমরা বাঁকা পথ অবলম্বন করা থেকে বাঁচতে পারবে।
তারপর আমি মূসাকে কিতাব দিয়েছিলাম, যা সৎকর্মশীল মানুষের প্রতি নেয়ামতের পূর্ণতা এবং প্রত্যেকটি জিনিসের বিশদ বিবরণ, সরাসরি পথ নির্দেশ ও রহমত ছিল, (এবং তা এ জন্য বনি ইসরাঈলকে দেওয়া হয়েছিল যে,) সম্ভবত লোকেরা নিজেদের রবের সাথে সাক্ষাতের প্রতি ঈমান আনবে। (সুরা আনআম: ১৫৩, ১৫৪)।
আল্লাহর সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করা : ইসলামের বিজয়ের জন্য তাড়াহুড়া করা যাবে না, বিজয়ের জন্য আল্লাহর একটি নিয়ম নির্ধারিত রয়েছে, সে নিয়মনীতি পূর্ণ না হলে আল্লাহ কখনও দ্বীনকে বিজয় করবেন না, সেজন্য দীর্ঘ সবর, দৃঢ়তা, প্রচেষ্টা ও নিয়মিত দাওয়াতের কাজ করতে হবে। মক্কাতে যারা ঈমান এনেছিল রাসুল (সা.) তাদেরকে কাবার ঘরের মূর্তি ভাঙার নির্দেশ দেন নাই, কাফেরদের কাউকেও হত্যা করতে বলেননি। কেননা মূর্তির প্রতি ভালবাসা মুশরিকদের আংশিক ধর্মীয় কাজ। যদি তিনি তাদের এসব মূর্তি ভাঙার নির্দেশ দিতেন তাহলে তারা আরও বেশি করে নতুন নতুন মূর্তি তৈরি করত। কিন্তু যখন সময় সুযোগ আসল তখন তিনি সমস্ত মূর্তি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন, ফাতেহ মক্কার দিন রাসুল (সা.) মুসলমানদেরকে নিয়ে বায়তুল্লাহ তওয়াফ করেন অথচ মক্কার ঘরের আশে পাশে যে মূর্তি গুলো বসানো ছিল তিনি তা ভাঙতে দিলেন না কিন্তু অল্পদিনের মধ্যে মক্কার লোকেরাই তাদের মূর্তি গুলো ভেঙে সত্য দ্বীন গ্রহণ করল।
আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল : “আমরা কেন আল্লাহর উপর ভরসা করবো না, অথচ তিনিই আমাদের জীবনে চলার পথ দেখিয়েছেন? তোমরা আমাদেরকে যে কষ্ট দিচ্ছো এতে আমরা সবর করবো। আর ভরসাকারীদের শুধু আল্লাহর উপরই ভরসা করা উচিত।” (সুরা ইবরাহীম: ১২) ।
আল্লাহর সাহায্য থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না : কেউ কেউ আছেন তারা দ্বীন কায়েমের আন্দোলনে বদরের মত ফেরেশতা কিংবা আবাবিল পাখি সব সময় কামনা করেন। তাঁদের সামনে আল্লাহর রাসুলের তায়েফ ও ওহুদের ঘটনাও রয়েছে। তবে আল্লাহর সাহায্য থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন “তারা মুখের ফুৎকার দিয়ে আল্লাহর আলো নিভিয়ে দিতে চায়। আল্লাহ তার আলোকে পূর্ণরূপে বিকশিত করবেন। যদিও কাফিররা তা অপছন্দ করে, তিনি তার রসূলকে পথ নির্দেশ ও সত্যধর্ম দিয়ে প্রেরণ করেছেন, যাতে তাকে সব ধর্মের উপর প্রবল করে দেন যদিও মুশরিকরা তা অপছন্দ করে” (সুরা আসসফ : ৮-৯)। রাসুল (সা.) সাহাবাদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, “আল্লাহর শপথ! এ দ্বীনকে পূর্ণভাবে তিনি কায়েম করেই দিবেন। এমনকি সে সময় একজন সওয়ার সানয়া থেকে হাদরামাউত পর্যন্ত চলে যাবে, কিন্তু সে আল্লাহ আর নিজের মেষ পালনের জন্য নেকড়ে ছাড়া আর কিছুর ভয় করবে না। কিন্তু তোমরা তাড়াহুড়া করছ।” (রিয়াদুল সালেহীন, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা : ৩৯)
আল্লাহ মুমিনদেরকে রহমত থেকে নৈরাশ হওয়া হারাম করেছেন “কাফেরগণ ছাড়া কেউ আল্লাহর রহমত থেকে নৈরাশ হয় না” (সুরা ইউসুফ : ৮৭)। “বলুন, হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ, তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না।” ( সুরা যুমার : ৫৩)
অতএব, যতই প্রতিকূল অবস্থা আসুক না কেন কোনো অবস্থাতেই হতাশ কিংবা মনোবল হারানো যাবে না। রাসুলে কারিম (সা.) বললেন, “এমন এক সময় আসবে যে তোমরা বন্যার পানির খড় কুটার মত পরিণত হবে। সাহাবারা প্রশ্ন করল হে আল্লাহর রাসুল (সা.) তার কারণ কী হবে? তিনি বলেন তোমাদের মধ্যে ওয়াহন সৃষ্টি হবে। তাঁরা প্রশ্ন করল ওয়াহন কী? তিনি জবাব দিলেন হুব্বুদ্দুনিয়া ওয়া কারাহিয়াতুল মাওত। দুনিয়া প্রেম ও মৃত্যু ভয় মানুষকে জিহাদ থেকে দূরে রাখে। ওহুদ যুদ্ধে যারা পিছপা হয়েছিল তারা মৃত্যু ভয়েও পালিয়েছিল।
আল্লাহর ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট থাকা : আল্লাহ আমাদের জন্য যেই ফায়সালা করেন তার প্রতি সন্তুষ্ট থাকতে হবে। হে রাসুল! ওদেরকে বলুন, “আল্লাহ আমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন, তা ছাড়া কখনো কোনো (ভালো বা মন্দ) কিছুই আমাদের কাছে পৌঁছে না। তিনিই আমাদের মনিব। মুমিনদেরকে আল্লাহরই উপর ভরসা করা উচিত।” (সুরা তাওবাহ: ৫১)
আল্লাহর দরবারে ধরনা দেওয়া : এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে নেয়ামতই তোমরা পেয়েছে, তা আল্লাহর পক্ষ থেকেই এসেছে। তারপর যখন তোমাদের উপর কোনো কঠিন সময় আসে তখন তোমরা ফরিয়াদ নিয়ে তাঁরই দিকে দৌড়াও।” (সুরা নাহল: ৫৩)।
(সমাপ্ত)
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক গবেষক