রাষ্ট্র’চিন্তা ও প্রশাসনিক উন্নয়নের ইতিহাসে মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত মদিনার ইসলামী রাষ্ট্র এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। মদিনায় প্রতিষ্ঠিত এই রাষ্ট্রটি ছিল মানবজাতির ইতিহাসের সর্বোত্তম জনকল্যাণ মূলক, ন্যায় বিচার, উন্নয়ন, সুশাসনে উদ্ভাসিত শ্রমবান্ধব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। ইসলামী আদর্শের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন, ইসলামের সর্বাত্মক বিজয় প্রতিষ্ঠা এবং ইসলামের মাধ্যমে শ্রমজীবী মেহনতি মানুষসহ সকল মানুষের সার্বিক কল্যাণ সাধনই ছিল মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের একমাত্র লক্ষ্য। মদীনা ইসলামী রাষ্ট্রের প্রশাসন ছিল স্বতন্ত্র ও সুসংগত এক সিস্টেম। রহমাতুল্লিল আলামীন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র একজন নবীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একাধারে একজন শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, মানুষের মুক্তিদূত, বার্তাবাহক, নেতা, পথপ্রদর্শক, বরকতের অবারিত দ্বার, সতর্ককারী, সুসংবাদদাতা ও মহান রাষ্ট্র প্রধান। তিনি ছিলেন ধর্ম ও রাষ্ট্র উভয় সংস্থার পরিচালক। (ড. মফিজুল্লাহ কবীর, মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৭, পৃ.৮৭)। তাঁর জীবন সাধনার একটি অনন্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হল মদীনায় ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। রাসূলুল্লাহর নিজের সমস্ত কার্যক্রম মানুষের কল্যাণে নিবেদিত ছিল। এতে ধর্ম, বর্ণ, ধনী, গরীব, মালিক-শ্রমিক ও অঞ্চলের পার্থক্য পরিলক্ষিত হতো না। শ্রমজীবী মানুষসহ সকলের জন্য সার্বজনীন কল্যাণ পরবর্তীকালে ইসলামী রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসেবে অনুসৃত হয়। আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র ধারণার অনেক আগে মহানবী (সা.) এর এই জনকল্যাণের ধারণা রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে অনেক অগ্রগামী ধারণা ছিল। গোত্র কলহে ল্পি যাযাবর ও মরুবাসী আরবদেরকে অসামান্য রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, সাংগঠনিক ক্ষমতা ও একনিষ্ঠতার মাধ্যমে একই সূত্রে গ্রথিত করে সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে তিনি গোড়াপত্তন করেন একটি উম্মাহ ভিত্তিক রাষ্ট্রের।
এর মাধ্যমে মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আল্লাহর প্রভুত্ব ও মানবিক সাম্য। শিরকের সকল চিহ্ন মূলোৎপাঠিত হয়েছিল সমাজের অঙ্গন হতে। অবসান হয়েছিল মানুষের উপর মানুষের কৃত্রিম প্রভূত্বের। মানুষ স্বাদ পেয়েছিল মুক্তি ও স্বাধীনতার, ফিরে পেয়েছিল মানুষ হিসেবে বিকশিত হবার সকল প্রকারের মৌলিক অধিকার, প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আইন ও ন্যায়ের শাসন, সুশাসন। শাসক পরিণত হয়েছিল জনগনের সেবক। মানুষের নিরাপত্তা ও জরুরীয়াত মৌলিক প্রয়োজন পূরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল রাষ্ট্র। সমাজে শ্রমজীবী ও নারীরা প্রথমবারের মত পেয়েছিল মর্যাদার আসন। রচিত হয়েছিল ক্রীতদাস ও দাসীদেরও মুক্তির সোপান। সমাজ থেকে আর রিবা বা সুদ উচ্ছেদ হয়ে তদস্থলে প্রবর্তিত হয়েছিল জনকল্যাণমুখী যাকাত ব্যবস্থা। ধনী ও দরিদ্রের বিশাল বৈষম্য হয়েছিল সংকুচিত। মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন মহানবী (সা.) স্বয়ং। মহান আল্লাহর অহীর মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রয়োজনীয় বিধি বিধান অবতীর্ণ করতে থাকেন। আর মহানবী (সা.) তাঁর সাথীদের সাথে শূরা বা পরামর্শ ও সহযোগিতার মাধ্যমে সেই সব বিধি-বিধান কার্যকর করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই পড়ে উঠেছিল একটি সুন্দর প্রশাসনিক ব্যবস্থা। কুরআনের আদেশ-নিষেধ ইসলামী রাষ্ট্র ও প্রশাসনের জন্য বাধ্যতামূলক অনুস্বরনীয় ছিল। কুরআনে কোনো মীমাংসা পাওয়া না গেলে মহানবী (সা.) বিজ্ঞ ও পরহেজগার সাহাবীদের পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রের সকল কাজ সম্পাদন করতেন। একে বলা হয় মজলিসে শূরা। ঐতিহাসিকদের মতে, মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠিত মদীনার রাষ্ট্রটি ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম সাংবিধানিক রাষ্ট্র এবং সর্বোত্তম জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র। রাসূল মুহাম্মদ (সা.) এর জীবদ্দশাতেই এই রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটেছিল মদীনা ছাড়িয়ে আরব উপদ্বীপের প্রায় ১৯ লক্ষ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে।
মহানবীর শ্রম প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য
১। মহানবী (সা.) মদীনা রাষ্ট্রে এমন একটি শ্রম প্রশাসন কায়েম করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা ছিল কুরআনের শিক্ষার আলোকে উদ্ভাসিত। এ প্রশাসনের ভিত্তি ছিল তাওহীদ ও রবুবিয়াত, খিলাফত ও রিসালাত এবং আখিরাত ও জবাবদিহিতার তীব্র অনুভূতি। আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করার অনুভূতিই মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে যাবতীয় অন্যায়, জুলুম, বৈষম্য, শ্রম শোষণ তথা আল্লাহর আবাধ্যতা থেকে বিরত রেখেছিল এবং আল্লাহর বিধানের অনুগত বানিয়ে দিয়েছিল।
২। তাওহীদ, রিসালাত, খিলাফত ও আখিরাতের ভিত্তির উপর মদীনা রাষ্ট্রের যে শ্রম প্রশাসন সংগঠিত হয়েছিল তার লক্ষ্য ছিল:
*শ্রমজীবী মেহনতী মানুষসহ সকল নাগরিকে ইহকালীন কল্যাণ নিশ্চিত করা;
*সুবিচার ইনসাফ প্রতিষ্ঠা;
*ক্ষতি, বিপর্যয় ও জুলুমের সকল পথ বন্ধ করা;
*রাষ্ট্রে বসবাসকারী মেহনতী মানুষসহ সর্বস্তরের জণগনের মৌলিক প্রয়োজন যথাযথভাবে পূরণের ব্যবস্থা করা;
*আয় ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা;
*ভারসাম্যমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে সামাজিক স্থায়িত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করা;
*আল্লাহর সৃষ্টিকূলের প্রতি অনুকম্পা এবং সকল সৃষ্টি ও মানুসের জন্য নির্মল ও সুস্থ পরিবেশ গড়ে তোলা।
৩। মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনের ভিত্তি ছিল অর্থনৈতিক ও সামাজিক সুবিচার আদল ও ইহসান। তা ছিল জাহিলিয়্যাতের যুগের সব অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও বেইনসাফী হতে মুক্ত। আদল মানে সুবিচার, ন্যায়বিচার, ইনসাফ, ন্যায্য ও সুষম নীতি। দুটি স্বতন্ত্র সত্যের সমন্বয়ে আদল গঠিত। (১) মানুষের অধিকার প্রদানের ক্ষেত্রে ভারসাম্য ও সাদৃশ্য প্রতিষ্ঠা করা। (২) প্রত্যেককে যথাযথভাবে তার অধিকার প্রদান করা। কোনো পক্ষপাতিত্ব না করে যার যা প্রাপ্য তাকে তা দেয়ার নাম আদল। প্রকৃতপক্ষে আদলের দাবি হচ্ছে ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য। শ্রমজীবী মানুষসহ প্রত্যেক নাগরিককে তার নৈতিক, সম্পর্কগত, অর্থনৈতিক আইনগত, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার পূর্ণ ঈমানদারির সাথে যথাযথভাবে প্রদান করা। ন্যায়বিচারের অন্য অর্থ সমান হতে অন্যায় ও জুলুমের উচ্ছেদ এবং সবল প্রতিরোধ। ইসলামী শরীয়াহর ব্যত্যয় জুলুমকেই ডেকে আনে। জুলুমের সময়োচিত প্রতিরোধ ও উচ্ছেদ না হলে দুর্বল ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী, শ্রমজীবী মেহনতী মানুষ প্রতারিত, নিগৃহীত, বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ জন্যই মহানবী (সা.) এর শ্রম প্রশাসনে এর প্রতিবিধানের উদ্দেশ্যে আদল ও ইসনাফ প্রতিষ্ঠাকে অন্যতম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। আদল বা সুবিচারের স্বার্থে আইনের তাৎক্ষনিক ও যথাযথ প্রয়োগ মদিনা রাষ্ট্রে সুনিশ্চিত করা হয়েছিল।
একই সাথে ইহসান বা কল্যাণ পরায়ণতা, পরোপকার, দায়িত্বের চাইতেও অধিক কর্তব্যবোধ এর প্রসঙ্গটি মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনে গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হয়েছিল। ইহসান মানে সুন্দও ব্যবহার, হৃদ্যতাপূর্ণ আচরণ, অপরকে তার অধিকারের চেয়ে বেশি দেয়া, অতিরিক্ত কাজের জন্য অতিরিক্ত মজুরি প্রদান, শ্রমজীবীকে ব্যবসার লভ্যাংশ প্রদান, সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ, ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রদর্শন, নিজের অধিকারের চেয়ে কম পেয়েও সন্তুষ্ট থাকা। ইহসান আদলের চেয়ে বেশি কিছু। কোন সমাজ কেবল আদলের নীতির ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না যেখানে সমাজের সকল সদস্য হরহামেশা মেপেমেপে নিজের অধিকার নির্ণয় ও আদায় করে, আর অপরের অধিকার কতটা রয়েছে তা খতিয়ে নির্ধারণ করে এবং কেবল ততটুকুই দিয়ে এ ধরণের একটি সমাজে দ্ব›দ্ব-সংঘাত ঘটবে না বটে কিন্তু সামগ্রিকভাবে সে সমাজে প্রেম ভালবাসা, কৃতজ্ঞতা, মহাত্ম, উদারতা, ত্যাগ ও কুরবানি, নিষ্ঠা ও ঐকান্তিকতা এবং অপরের কল্যাণ কামনার মত মহত্তম বৈশিষ্ট্যসমূহ হতে বঞ্চিত থেকে যায়। অথচ এ গুণগুলো তথা ইহসান হচ্ছে মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে ব্যক্তিজীবনে সজীবতা ও মাধুর্য সৃষ্টির এবং সমাজ জীবনে সৌন্দর্য ও সুষমা বিকাশের উপাদান। ইহসানের সাথে মেহনতী মানুসের জন্য আর্থ সামাজিক সুবিচার এবং কার্যক্রমের যে আদেশ আল্লাহ দিয়েছেন এ জন্যই তা বাস্তবায়নকে মদিনা রাষ্ট্র ফরজ হিসেবে গ্রহণ করেছিল। মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনে কড়া নজর রাখা হত যাতে আদল ও ইনসাফ কায়েম থাকে এবং কোন জুলুম হতে না পারে।
৪। মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনের লক্ষ্য ছিল সম্পদের পূর্ণ ব্যবহার। যাবতীয় বস্তুগত ও মানবীয় সম্পদের পূর্ণাঙ্গ ও দক্ষতাপূর্ণ ব্যবহার মদীনা রাষ্ট্রে নিশ্চিত করা হয়েছিল। এ রাষ্ট্রে সবাই ছিলেন শ্রমজীবী। মানবকল্যানের লক্ষ্য হাসিলের জন্যই মহানবী (সা.) অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সকল জনশক্তিকে ব্যবহার করে সসীম সম্পদের দক্ষতাপূর্ণ বরাদ্দ ও ব্যবহার করেছিলেন। মদীনা রাষ্ট্রের শ্রমনীতিতে সম্পদ ও সেবা প্রাপ্তি এবং ত্যাগ উভয়ের মধ্যেই কল্যাণ নিহিত আছে বলেই মনে করা হত। সম্পদের ব্যবহার ও ভোগ শুধুমাত্র ইহজাগতিক সুকের জন্য নয়। এর যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে পরকালীন কল্যাণও নিশ্চিত করতে হবে। সম্পদের যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমে আখেরাতে শান্তির আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা সম্পর্কে কুরআনে বলা হয়েছে, আল্লাহ তোমাকে যে ধন-সম্পদ দিয়েছেন তা দ্বারা আখেরাতের ঘর বানানোর চিন্তা কর, অবশ্য দুনিয়া হতেও তোমার অংশ নিতে ভুলে যেয়ো না। (সুরা ২৮ আল কাসাস: আয়াত-৭৭)।
৫। মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনের অন্যতম লক্ষ্য ছিল শ্রমজীবী মেহনতী বঞ্চিতদের অর্থনৈতিক প্রয়োজন মিটানো এবং তাদের মানবিক মর্যাদার যথাযথ প্রতিষ্ঠা। মদীনা রাষ্ট্রে ব্যক্তির সম্পদে রাষ্ট্রের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বৈধ পন্থায় উপার্জিত ধন-সম্পদে অন্যদেরও অধিকার রয়েছে। বিশেষত: আত্মীয়স্বজন, খেটে খাওয়া শ্রমজীবী এবং সমাজে যারা মন্দভাগ্য তাদের প্রতি সহযোগিতা ও সহমির্মতার হাত বাড়িয়ে দেয়া প্রতিটি বিত্তবান নাগরিকের ঈমানী দায়িত্ব। কুরআনের শিক্ষা অনুসারে নাগরিকগণ নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের পর যাদের হাতে উদ্বৃত্ত অর্থ থাকত তারা দরিদ্র শ্রমজীবী, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী ও সমাজের অসহায়, বঞ্চিত ভাগ্যাহত নাগরিকদের ন্যূনতম প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্য তা বাধ্যতামূলক ভাবে ব্যয় করত। সমাজের বিত্তহীন ও অভাবগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষের প্রয়োজন পূরণ ও কল্যাণ সাধনের জন্য দেয় কুরআনিক নির্দেশনা মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
৬। মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসন যে শ্রমনীতি কায়েম করেছিল তাতে প্রত্যেকের স্বাধীনভাবে পেশা নির্বাচন করে জীবিকা অর্জন করার অধিকার ছিল। অন্য কথায় জীবিকা অর্জনের পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। এ পৃথিবীতে আল্লাহর যে নিয়ামতসমূহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, যে অফুরন্ত সম্পদ ভান্ডার রয়েছে তা খুঁজে বের করে যথার্থ ব্যবহারের মাধ্যমেই আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিল করা যায়। মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে মদীনা রাষ্ট্রের সকল নাগরিক ও শ্রমজীবীরা স্বাধীনভাবে ব্যবসায়, চাষাবাদ, হস্তশিল্প, পশুপালন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ও পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। উৎপাদন কার্য চলত স্বাধীনভাবে। উৎপাদন কর্মকান্ডে সাহাবিরা নিজেরাও অংশগ্রহণ করতেন এবং প্রয়োজনবোধে মজুরও নিয়োগ করতেন। ইতিহাসে অনেক সাহাবীর মজুরীর বিনিময়ে কাজ করার ও শ্রমদানের উদাহরণ রয়েছে। শ্রমিকের ন্যায্য মজুরী নির্ধারণ ও যথাসময়ে পরিশোধের ব্যাপারে মহানবী (সা.) সতর্ক ও সাবধান থাকার জন্য কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে এ নিয়ে কোন মনোমালিন্য বা অসন্তোষ তৈরী না হয়। এক্ষেত্রে তিনি ইনসাফপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতে বলেছেন। একজন শ্রমিক যাতে যথাসময়ে ন্যায্য মজুরী অনায়াসে পেতে পারেন সেদিকে খেয়াল রাখা প্রত্যেক নিয়োগকারীর প্রধান কর্তব্য। কেননা, শ্রমিক তার কাজ শেষে সঠিক সময়ে সঠিক মজুরী না পেলে তার ভেতরে কষ্ট, হাহাকার ও হতাশা জন্ম নেয়। শ্রমিক তখন মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তার কর্মস্পৃহা হ্রাস পায়। পরিবার পরিজনের ভরন- পোষনের খরচ যোগাতে গিয়ে তিনি তখন দিশেহারা হয়ে পড়েন। মহানবী (সা.) বলেছেন, কর্মে নিয়োগ কালীনই মজুরীর পরিমাণ সম্পর্কে শ্রমিককে জানিয়ে দাও। (কানজুল উম্মাল, হা-৯১২৬)। মজুরী নির্ধারণ ব্যতীত কোন শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করা অনুচিত। (সহীহ আল বুখারী)। শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকাবার পূর্বেই তার মজুরী পরিশোধ করে দাও। (ইবনে মাজাহ) যে ব্যক্তি শ্রমিককে মজুরী প্রদানে জুলুম করে আল্লাহ তার ইবাদত কবুল করবেন না। (আমালি আস সাদুব, হা-৭০৭)।
শ্রমিকের অতিরিক্ত কাজ এর জন্য অতিরিক্ত মজুরি প্রদান করতে হবে। মহানবী (সা.) বলেন, তোমরা যদি তাদের উপর অধিক কাজের দায়িত্ব চাপাও, তবে সে হিসেবে বাড়তি মজুরি দিয়ে তাদের সাহায্য কর।
শ্রমিককে ব্যবসার, শিল্পোৎপাদনের লভ্যাংস প্রদান করতে হবে। মালিকের লভ্যাংশে শ্রমিকেরও হিস্যা থাকা প্রয়োজন। এটিই ইনসাফের নীতি। মহানবী (সা.) বলেন, মজুর ও শ্রমিককে তার শ্রমোৎপাদিত দ্রব্য থেকেও অংশ প্রদান কর। কারণ, আল্লাহর মজুরকে কিছুতেই বঞ্চিত করা যায় না। (মুসনাদে আহমদ)
শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। কাজ কারার সময় শ্রমজীবীকে যথেষ্ট ঝুঁকি নিতে হয়। তিনি শ্রম, ঘাম দেন। তার পুরো দেহ, মন ও মনন নির্দিষ্টভাবে মালিকের কাজে নিবেদিত হয়। মাথার বুদ্ধি, কানের শ্রবনশক্তি, চোখের দৃষ্টি, বাহুর বল, পায়ের পদচারণা ইত্যাদি যুগপৎভাবে কাজ করে চলে। ফলে কর্মরত অবস্থায় দেহের যে কোন অংশ যে কোন সময় যখম হওয়ার ঝুঁকি থাকে। সুতরাং যদি শারীরিক কোন জখম হয় সেক্ষেত্রে শ্রমিকের অধিকার থাকে মালিকের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সুবিধা লাভের। মহানবী (সা.) বলেছেন, ক্ষতি যথাসাধ্য প্রতিরোধ ও পূরণ করতে হবে। (আহকামুল আমল ওয়াহকুকুল আম্মাল, পৃ.২৬)
শ্রমজীবীদের প্রতি মালিকের সার্বিক আচরণ হবে সহানুভূতিসুলভ ও হৃদ্যতাপূর্ণ। মালিক হবেন সত্যিকার অর্থেই শ্রমবান্ধব। কাজ করতে গিয়ে শ্রমজীবীরা ভুল করতে পারেন। ভুল ইচ্ছেকৃত আবার অনিচ্ছাকৃতভাবেও হতে পারে। প্রতিটি অনিচ্ছাকৃত ভুল মার্জনা করা যেতে পারে। মহানবী (সা.) বলেছেন, মজুরের অপরাধ অসংখ্যবার ক্ষমা করা মহত্বের লক্ষণ। মালিকের পাশাপাশি শ্রমজীবীরও বিস্তর দায়িত্ব রয়েছে। শ্রমিক মালিকের প্রতি বিবেকের দাবী অনুযায়ী দায়বদ্ধ ও বিশ্বস্ত থাকবেন। তার উপর অর্পিত দায়িত্বকে তিনি হালাল রুজী আহরণকল্পে ইবাদততুল্য জ্ঞান করবেন। শ্রমিক নির্ধারিত সময়ে কর্মস্থলে হাজির হবেন। নিষ্ঠার সাথে নিরলসভাবে মন দিয়ে কাজ করবেন। কাজের যাতে ক্ষতি না হয় অথবা মালিকের সম্পদেও যাতে কোনরূপ ক্ষতি না ঘটে সেদিকে শ্রমজীবী তীক্ষè দৃষ্টি রাখবেন। এ ব্যাপারে মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িথ্বশীল এবং প্রত্যেকেই স্ব-স্ব দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। (সহীহ আল বুখারী, মুসলিম)
শিল্প-কারখানা, ব্যবসায়-বাণিজ্য, দফতর-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির উন্নতি সমৃদ্ধি নিহিত রয়েছে মালিক-শ্রমজীবী, কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রমুখের মধ্যকার সুসম্পর্কের মাঝে। মালিক হবেন মানবিক। ক্রোধ ও সন্তুষ্টি সর্বাবস্থায় তিনি ইনসাফের উপর অটল থাকবেন। তার কথাবার্তা আল্লাহর স্মরণমূলক হবে। অত্যাচারীর হাত আল্লাহ তায়ালা অপছন্দ করেন। বৈষম্য, দ্বিমুখী নীতি ও কপটতা পরিহার করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক-কর্মচারীদের দৈহিক ও সামাজিক নিরাপত্ত নিশ্চিত করতে হবে।
শ্রমজীবীগণও মালিকের স্বার্থের দিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন। অনুমোদিতভাবে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকবেন না। শ্রমিকগণ কাজ করবেন নিষ্ঠার সাথে, একাগ্রচিত্তে, নির্ভূলভাবে। মহানবী (সা.) বলেছেন, তোমাদের কেউ যখন কোন শ্রমের কাজ করবে তখন তা নিখুঁত ও নির্ভূলভাবে সম্পন্ন করবে, এটিই আল্লাহ তায়ালা ভালবাসেন। (বায়হাকী)।
শ্রমিক মালিক সম্পর্ক ও মনোভঙ্গী অনুপম, উদার, স্বচ্ছ, মানবিক, ন্যায়ানুগ ও আল্লাভীরু হওয়ার ফলশ্রতিতেই একটি প্রকৃত, মহিমাময় ও মুখরিত কর্ম পরিবেশ তৈরী হতে পারে আর এটিই মহানবী (সা.) এর শাশ্বত শিক্ষা।
মহানবী (সা.) প্রবর্তিত মদীনা রাষ্ট্রের শ্রম প্রশাসনের প্রতি লক্ষ করলে এর স্থিতিস্থাপকতা ও গতিশীলতা দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। বস্তুত ইসলামী শ্রমনীতি ও শ্রম প্রশাসন আধুনিক যুগে কার্যকরী করার জন্য সম্পূর্ণ উপযোগী।