১লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে বা মে দিবস হিসেবে পালন করা হয় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই। গত শতকের শেষ দিকেও শ্রমিকদের কোন নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা ছিল না। চৌদ্দ থেকে ষোল ঘণ্টা কাজ করেও তারা ন্যায্যমূল্য পেত না। ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে ছড়িয়ে পড়ে শ্রমিকদের দাবি আর সম্মিলিত আন্দোলন। দীর্ঘ তিন বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফ্রান্সের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১ মে-কে বিশেষ দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সেই থেকেই ১ মে পৃথিবীর সব দেশে ‘মে দিবস’ ‘শ্রমিক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়।
১৮০৬ সালে শ্রমিকরা অমানবিক নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। প্রথমে তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে প্রতিবাদ করে। পাশাপাশি তাদের দাবি ছিল কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা অর্থাৎ বিশঘণ্টার পরিবর্তে তারা চেয়েছিল দশঘণ্টা শ্রম দিতে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
মে দিবসের ইতিহাস একদল মানুষের উপর হয়ে আসা অত্যাচারের প্রতিবাদ করার ইতিহাস। ঔপনিবেশিক কাল থেকে শুরু করে বা আধুনিক যুগের প্রাথমিক সময়কাল থেকেই একটি জিনিস লক্ষ্য করা যেতো, শ্রমিকদের কোন নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা নেই। তাদের কোনো জীবন উপভোগের সুযোগ নেই। নেই কোন শখ ও আহলাদ পূরণের আলাদা পরিসর। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা কাজ করে যাওয়াই যেনো নিয়তি।
শিল্প বিপ্লবের পর আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের প্রচুর শিল্প কারখানা গড়ে ওঠার পর মালিকপক্ষ যখন প্রচুর শ্রমিক নিয়োগ দিচ্ছিলেন তখনও শ্রমিকেরা চৌদ্দ থেকে ষোলঘণ্টা কাজ করতো। উপরন্তু, এই চৌদ্দ থেকে ষোল ঘণ্টায় অমানুষিক কাজ করলেও তারা ন্যায্যমূল্য পেত না।
১৮০০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল নবজাগরণের জয়জয়কার। চারিদিকে গড়ে উঠছে নতুন নতুন শিল্প। কিন্তু সে হিসেবে শিল্প কারখানা শ্রমিকদের বেতন ছিল খুবই কম এবং কর্মঘণ্টা ছিল প্রায় বিশঘণ্টা।
১৮০৬ সালে শ্রমিকরা অমানবিক নিপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। প্রথমে তারা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে প্রতিবাদ করে। পাশাপাশি তাদের দাবি ছিল কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা অর্থাৎ বিশঘণ্টার পরিবর্তে তারা চেয়েছিল দশঘণ্টা শ্রম দিতে। ১৮২০-১৮৪০ সাল পর্যন্ত শ্রমিকরা অসংখ্য ধর্মঘট ও প্রতিবাদ অনুষ্ঠান করে। ১৮২৭ সালে দৈনিক দশঘণ্টা কাজ করার নিয়ম চালু করার জন্য মেকানিকরা গঠন করে ট্রেড ইউনিয়ন। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম ট্রেড ইউনিয়ন।
১৮৬৬ সালে এইভাবে গঠিত সাতটি ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিনিধিরা একযোগে মিলিত হয়ে তৈরি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন। সেখানে তাদের প্রাথমিক চাহিদা ছিল আটঘণ্টা কাজের প্রস্তাব। ওই বছর জেনেভা কনফারেন্সেও প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
১৮৮৪ সালে আটঘণ্টা কাজ করার দাবিতে আন্দোলনের গতি তীব্রতা পায়। ১৮৮৬ সালে তৈরি হয় আমেরিকান ফেডারেশন অফ লেবার ইউনিয়ন। এই সংগঠনটি সে বছরের ১ মে তারিখ থেকে আটঘণ্টা কাজের দাবিতে সকল শ্রমিকদের ধর্মঘট করার জন্য বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ধর্মঘটের স্থান ছিলো শিকাগো, সেসময় সমস্ত পৃথিবীর বামপন্থীদের যে কোন আন্দোলন বা যেকোনো দাবি আদায়ের একটা বড়ো জায়গা ছিল শিকাগো শহর।
প্রায় ৫ লক্ষ শ্রমিক সেদিন তাদের কাজকর্ম বন্ধ রেখে শিকাগো শহরে ধর্মঘট আন্দোলনে যোগদান করে। তাদের দাবি ছিল, কর্মঘণ্টা হবে দৈনিক আটঘণ্টা, মজুরি বৃদ্ধি করা ও কর্মস্থলের মানসম্মত পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু কারখানার মালিকপক্ষ তাদের এই আন্দোলন ও ধর্মঘট মেনে নিতে পারেনি। মালিকপক্ষ নির্মমভাবে তাদেরকে থামানোর চেষ্টা করে।
পরদিন ২ মে, আন্দোলনের দ্বিতীয় দিনে সমাবেশস্থলে পুলিশের গুলিতে ছয়জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। নিরস্ত্র শ্রমিকদের নির্মমভাবে হত্যা করায় আন্দোলনের ভয়াবহতা তীব্র আকার ধারণ করে। তার পরের দিন অর্থাৎ ৩ মে শ্রমিকেরা আবারো জড়ো হয় শিকাগো শহরের ঐতিহাসিক হে মার্কেট স্কয়ারে। পরদিন ৪ মে সন্ধ্যা সাতটায় অগাস্টিস নামক একজন শ্রমিক নেতা শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। এসময় হঠাৎ করে পুলিশের সামনেই একটি বিকট বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। সাথে সাথেই স্যামুয়েল নামক একজন পুলিশ নিহত হয়, এর সাথে নিহত হয় কর্মকর্তা সহ আরও ৪-৫ জন পুলিশ ও ১১ জন সাধারণ মানুষ। ধারণা করা হয়, মালিক পক্ষ থেকে এই বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যাতে শ্রমিকদের আন্দোলন দমন করা যায়। রক্তাক্ত হয়ে যায় হে মার্কেট স্কয়ার প্রাঙ্গণ।
এ ঘটনার পর পুলিশের পক্ষ থেকে মৃত্যুর অভিযোগ আনা হয় শ্রমিকদের বিরুদ্ধে। প্রহসনমূলক মামলা সাজানো হয় ৮ জন শ্রমিকের বিরুদ্ধে। সেই সময় আকষ্মিকভাবে ৮ জন শ্রমিক নেতাকে শিক্ষাগো শহর থেকে গ্রেফতার করা হয়। করা হয় প্রহসনমূলক বিচার এবং দেওয়া হয় অমানবিক রায়। অস্কার নামক একজন শ্রমিককে ১৫ বছরে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি সাতজনকে দেওয়া হয় ফাঁসির আদেশ। ফাঁসির পূর্বে কারাগারে একজন শ্রমিক আত্মহত্যা করে।
১৭৮৭ সালের ১১ই নভেম্বর বাকি ছয় জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয় প্রকাশ্যে উন্মুক্ত স্থানে জনসমক্ষে। ফাঁসিতে ওঠার আগে শ্রমিক নেতাদের দেওয়া বক্তব্য আজও সাধারন মানুষকে উদ্দীপ্ত করে। সেসময় একজন শ্রমিক নেতা বলেছিলেন, ‘আজকে আমাদের নীরবতা একদিন সমস্ত পৃথিবী খুব জোরালোভাবে শুনতে পাবে।’ বাস্তবে তাই হয়েছে, সত্যিই সেই ডাক পৃথিবীর মানুষ শুনতে পেয়েছে। শহীদ শ্রমিকেরা অমর হয়ে থাকবেন পৃথিবীতে।
এর ৬ বছর পর জানা যায়, এটি ছিল একটি প্রহসনমূলক ও মিথ্যা অভিযোগ। হে মার্কেটের ঘটনা তিন বছর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ নভেম্বর ফ্রান্সের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন ১ মে কে একটি বিশেষ দিন হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এই ঘটনার সংবাদ যখন সারা বিশ্বে একযোগে ছড়িয়ে যায়, তখন পুরো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি ওঠা শুরু হলো, আমরা এরপর আর কোন ধরনের নিপীড়ন, নিষ্পেষণ ও চাপিয়ে দেওয়া জুলুম অন্যায় মানবো না।
এ ঘটনার জের ধরেই পরবর্তী সময়ের সমস্ত সরকাররা শ্রমিকদের একটি নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, অর্থাৎ আটঘণ্টা নির্দিষ্ট করে দেওয়ার জন্য বাধ্য হয় এবং ১৯৭৯ সাল থেকেই ৮ কর্মঘণ্টা চালু হয়। ১৮৯০ সালে বিশ্বে একযোগে মে দিবস পালন করা হয়। পরবর্তীতে সকল সময়েই সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা এই দিবসকে উদযাপনে একাত্মতা প্রকাশ করছেন। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশেও মে দিবসকে মেহনতি মানুষের দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, যে দেশের শ্রমিক দিবসের জন্ম সেই আমেরিকাতে মে দিবস পালন করতে দেওয়া হয় না। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হে মার্কেটে হত্যাকাÐের পর, মে মাসের ১ তারিখ আর কোন সভা সমাবেশ করতে দেননি। কারণ তিনি ভাবতেন, এটা তার দেশের জন্য অসম্মানজনক, তাই এই দিবস উদযাপন বন্ধ করে দেয়া হয়।
তাৎপর্য
মে দিবস দিনপঞ্জিকায় এটি একটি নিছক দিবস-মাত্র নয়। বিশ্বের শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের ঐক্য, সংহতি, সংগ্রাম এবং বিজয়ের মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচিত হয়েছিল এই দিনে। মুনাফালোভী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অমানবিক নির্যাতনের শিকার শ্রমজীবী মানুষের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে অব্যাহত সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই মহান মে দিবস। শোষণ, বৈষম্য ও জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিকের ঐতিহাসিক বিজয়ের দৃষ্টান্ত মে দিবস। যুগে যুগে সারাবিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে অনন্য প্রেরণা জুগিয়েছে মে দিবস।
করণীয়
মে দিবসে আমরা সম্মান প্রদর্শন করতে চেষ্টা করি সেই মানুষগুলোকে, যে মানুষগুলো আমাদের জন্য পরিশ্রম করে নিজেদের শ্রম দিয়ে এবং আমাদের কাজকর্ম সহজ করে দেয়। নিজেদের সুখ শান্তি, বিনোদন ও আরামের কথা না ভেবে যারা আমাদের সুখ শান্তি বিনোদন ও আরামের কথা ভাবে, সেই মানুষগুলোর জন্য এই দিনটি যেন খাতা কলমের মধ্যে আটকে না রেখে শ্রমিকদের যে দাবি ও লক্ষ্য নিয়ে একত্রিত হয়েছিল তাদের সে দাবিগুলো যেন আমরা সম্পূর্ণরূপে তুলে ধরতে পারি সে চেষ্টাই করতে হবে এবং তাদের দাবিগুলো যেন পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন হয় এবং প্রত্যেকটি শ্রমিককে তাদের শ্রম এবং ঘামের সম্পূর্ণ সম্মান যেন দিতে পারি সে চেষ্টাই আমাদের করতে হবে।
পরিশেষে, আত্মত্যাগ ও বলিদানকে স্মরণীয় রাখার জন্যই মে দিবস। অমানবিক মুনাফা লোভী এক শ্রেণি জুলুম-নিপীড়নের মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষকে সব সময় পায়ের নিচে রাখতে চেয়েছিল। আমরা চাই নবী করীম সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এর সেই অমীয় বাণী ‘শ্রমিকের ঘাম শুকানোর পূর্বে তার মজুরি দিয়ে দাও’ হাদিসটি নিজের জীবনে বাস্তবায়ন এবং পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাস্তবায়ন হোক । আমিন।
লেখিকা: অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা