আগুন আর ধ্বংসের মাঝে ভাগ্যাহত মানুষগুলোর ভাগ্য উঠা নামা করে। পোড়া গন্ধ আর ছাইয়ের মাঝে অঙ্গার হওয়া আশার প্রদীপ নিয়ে যারা বেঁচে আছে, সেই জনপদের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আমরা বেঁচে আছি। আমরা ভয় ও আতঙ্কের মাঝে বেঁচে আছি। দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা নিয়ে আমরা বেঁচে আছি। আমরা বেঁচে আছি ধ্বংস আর প্রলয়ের মাঝে। আমাদের ভয়গুলো আমাদের তাড়া করে। গোটা জীবনের সঞ্চয় আর পরিশ্রম অঙ্গার হয়েছে একদল স্বপ্ন সারথীর। জীবনের পরিশ্রমগুলো চোখের সামনে দাউ দাউ করে জ¦লেছে। আশার প্রদীপ লেলিহান শিখায় পরিণত হয়েছে চোখের সামনেই। তীব্র তাপদাহে ওষ্ঠাগত প্রাণগুলো যখন রহমের আশায় কাতর ফরিয়াদ জানিয়ে একটু বিশ্রামে যায় সে সময় আসে কোনো কোনো দুঃসংবাদ। কখনো সন্ধ্যায়, কখনো গভীর রাতে কখনো রাতের শেষ প্রহরে। দুঃসংবাদ কাঁপিয়ে দিচ্ছে আমাদের। আশাহীন ভাষাহীন হয়ে যাচ্ছে সবহারা মানুষগুলো। কখনো সম্পদ, কখনো জীবন চলে যাচ্ছে। প্রলয় আর ধ্বংসের মাঝে এখানে রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি আবিষ্কারের চেষ্টা চলে অবিরাম। মানুষের জীবন নিয়ে এখানে নোংড়া খেলা চলে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা মানুষের দুঃখের অঙ্গারে আরও একবার ঘৃত নিক্ষেপ করে। জীবনের করুণ অভিব্যক্তিগুলো নিয়ে যারা ট্রল করে তারা আর কেউ নন জনগণের নেতা। রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা দায়িত্ব নিয়ে ক্ষমা চেয়ে ভুল শুধরে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে ঘৃণ্য খেলা খেলতে ভালোই পছন্দ করেন। রমজানের শেষ সপ্তাহে এই লেখা লিখছি, পাঠকের কাছে যখন এই লেখা পৌঁছাবে তখন ঈদুল ফিতরের পর মানুষ আবার নতুন করে কর্মচঞ্চল হয়ে পড়বে। দীর্ঘ এক মাসের সিয়াম সাধনার পরে ঈদুল ফিতরে যারা প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা আশায় ছিলেন এমন অনেকেই এক বুক কান্না আর অশ্রু ছাড়া নিজ পরিবারকে কিছুই দিতে পারবেন না।
আগুন আর ধ্বংসের প্রলয় শিখায় শুধু সম্পদই ধ্বংস হয় না। ভাঙন আর বিপর্যয়ের মাঝে অনেক প্রিয়মুখ চলে যায়। চলে যায় তারা না ফেরার দেশে। আমাদের বোধের জানালায় দমকা হাওয়ার মতো দুঃসংবাদগুলো আসে আবার চলে যায়। এই আসা যাওয়ার মাঝে আমাদের বেঁচে থাকা। জীবনের মূল্য এখানে? তার কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব পাওয়া না গেলেও একটি দুঃখজনক মৃত্যুর পর লাশের উত্তরাধিকারীরা কখনো কখনো পঞ্চাশ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। এটা কি জীবনের মূল্য নাকি লাশের মূল্য? আমাদের ভয়, বেদনাগুলো দুঃখের নদীতে পাল তোলা নৌকো, সে যেন একটির পর একটি প্রলয়ংকারী ঢেউকে মোকাবিলা করতে করতে নিজের পাটাতন কিংবা সঙ্গীদের শুধু হারায়। হারানোর বেদনা আমাদের হৃদয়ে যে দগ্ধ ক্ষত সৃষ্টি করে সময়ের ব্যবধানে তা মৃয়মান হলেও মুছে যায় না। প্রতিদিন নিত্য নতুন আঘাত যাদের জীবনকে তাড়া করে, প্রতিনিয়ত তারা ভয় ও আতঙ্কের মাঝেই বেঁচে থাকে। জীবনের মূল্য অনুধাবন হয় এখানে ক্ষমতা আর টাকার হিসেবে। রাজনীতির ষোলকলায় জীবনের লেনা দেনা ওঠা-নামা করে। জীবন উপভোগের নয় আবার উচ্ছন্নে যাওয়ারও নয়। জীবনের মূল্য আছে, দায়িত্ব এবং কর্তব্যবোধ আছে। জ্ঞান, বুদ্ধি এবং বিবেকের সাথে যোগ্যতার সমাহারে যে মানুষ; তার জীবনের মূল্য টাকার অংকে বিবেচ্য হওয়ার নয়। আমরা যেন গিনিপিগ, যাদের উন্নয়নের তবলা বাজিয়ে শোনানো হয়। জীবনের অনুভবে নৈঃশব্দের মাঝে কোরাস চলে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে। উচ্চৈঃস্বর চিৎকার আর তথাকথিত উন্নতির স্লোগানের মাঝে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার অনেক ক্ষীণ এবং মৃয়মান হয়ে যায়। এই তো এরই মাঝে আমাদের বেঁচে থাকা। এখানে জীবনের চাঁকা ঘোরানোর নানান বাঁক আর নানা গল্প আছে। দুর্ঘটনা আর অনাকাক্সিক্ষত ঘটনার মাঝে যারা চলে যায় তাদের গল্পগুলো আরও করুণ, আরও বেদনার।
রমজান আসে আমাদের পাপগুলো মোচনের জন্য। সিয়াম শেষে ঈদুল ফিতর ¯্রষ্টার এক মহা উপহার। হিংসা বিদ্বেষ মাড়িয়ে আনন্দ আর হাসি গানে মানুষ নতুন জীবনের স্বপ্ন বুননের দীক্ষা নেবে ঈদুল ফিতরে। প্রিয়জনের প্রতীক্ষা আর প্রত্যাশার পারদে আজ অসংখ্য মানুষ দুঃখ-বেদনার পঙক্তিকে সাথী করে নিয়েছে। বাংলাদেশের খুচরা এবং পাইকারি ব্যবসায়ীদের ব্যবসার বড়ো একটি মৌসুম ঈদুল ফিতর। ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে রমজানের এক মাস আগে থেকেই বস্ত্র ব্যবসায়ীদের ব্যস্ততা বাড়ে। বড়ো ব্যবসায়ীরা তাদের দেনা পাওনা চুকানোর চিন্তা করেন। ছোট ব্যবসায়ীরা একটু ভালো লাভ হওয়ার আশা করেন। এ ব্যবসার সাথে জড়িত কর্মচারীরা পরিবার প্রিয়জন নিয়ে ঈদকে আনন্দময় করার স্বপ্ন দেখেন। রমজানের আগে থেকে শুরু করে পুরো রমজান মাস জুড়ে একের পর এক অগ্নিকাÐ ঘটেই চলেছে। এগুলো কি শুধু দুর্ঘটনা নাকি কারো হিংসার ফসল এ নিয়ে নানান প্রশ্ন ডালপালা বিস্তার করেছে। দুর্ঘটনা কিংবা নাশকতা যাই হোক এগুলো যে আমাদের জাতীয় জীবনে গভীর রেখাপাত করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ২০২৩ সালের রমজান মানে যে কয়টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে প্রায় সবগুলোতেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসায়ীরা। একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া মানে একজন মালিকেরই ক্ষতি নয়। এক একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে জড়িত থকে আরও ৮/১০ টি পরিবার।
তাজরীন থেকে নিমতলী, বিএম ডিপো হতে চকবাজার, নারায়ণগঞ্জের মসজিদ হতে সিদ্দিকবাজার কিংবা আরমানিটোলা, বঙ্গবাজার হতে নিউ মার্কেট। মহাখালীর বিএনপি বস্তি হতে উত্তরার বিজিবি মার্কেট। মানুষের ভাগ্যগুলো পুড়ে পুড়ে ছাই হয়। আগুনের লেলিহান শিখায় কেউ নতুন কিছু স্বপ্ন দেখেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে জনগণের মুখের ভাষা তো বন্ধ করা যায় না। কেউ কেউ বলছেন, আগুন মানে সেখানে বড়ো ভবন, বড়ো মার্কেট, নতুন বিনিয়োগ, নতুন বরাদ্ধ আর নতুন ধান্ধা। মানুষের প্রমাণহীন কথাগুলো যেন অসত্যই হয় এই প্রত্যাশা করছি। বঙ্গবাজার আর নিউ মার্কেটের আগুন নিয়ে সেখানকার ব্যবসায়ী এবং কর্মচারীরা বারবার তাদের সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করছে এমন এক ব্যক্তির দিকে যার দায়িত্ব নগরের ব্যবসায়ীদের নিরাপদ ব্যবসার নিশ্চয়তা দেওয়া। অসমর্থিত সূত্রগুলো কেউ কেউ বঙ্গবাজারে অগ্নিকাÐের ভিডিও প্রকাশ করে প্রমাণের চেষ্টা করেছেন যেকোনো একজন আগুন লাগিয়ে সটকে পড়েছে। নিউ মার্কেটে আগুন লাগার কারণ হিসেবে একাত্তর টেলিভিশন এবং সময় টেলিভিশন সেখানকার ব্যবসায়ীদের যে সাক্ষাৎকার প্রচার করেছে তাতে সিটি কর্পোারেশনের ব্রিজ ভাঙার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। ঈদের এক সপ্তাহ আগে কেন ফুটওভার ব্রিজ ভাঙতে হবে এ বিষয়টিও প্রশ্ন আকারে সামনে এসেছে। বঙ্গবাজারে আগুনের সূত্রপাত একটি মার্কেট থেকে হলেও সেখানে মোট আটটি মার্কেট সম্পূর্ণ ভস্মীভূত হয়েছে। এক হিসেব মতে আটটি মার্কেটে মোট দোকান ছিলো প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। এ সকল দোকানের কর্মচারী সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ হাজার। এর সাথে যুক্ত আছে এ সকল মার্কেটে যারা মালামাল সরবরাহ করেন, তারা। যুক্ত আছেন বিভিন্ন কারখানার কারিগর। সব মিলিয়ে বলা যায় আরও লক্ষাধিক আয় উপার্জনক্ষম মানুষ। একজন উপার্জনক্ষম মানুষ মানে তার সাথে একটি পরিবার। একটি পরিবার অর্থ তার সাথে যুক্ত আছে কমপক্ষে আরও পাঁচজন মানুষ। আমরা শুধু একটি অগ্নিকাণ্ডে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার একটি সম্ভাব্য সংখ্যা বের করার চেষ্টা করেছি। একইভাবে নিউ মার্কেট সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও সেখানে প্রায় এক হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিকদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের জন্য কিছু অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করেছে। যা মোট ক্ষতির তুলনায় অতি সামান্য। সরকারের ডাটাবেজে অবশ্যই দোকান কর্মচারী এবং এ সকল মার্কেটে যারা মালামাল সরবরাহ করেন তারা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। খুচরা কাপড় ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় ঈদের এক সপ্তাহ আগে। যে সময়টিতে তারা আদৌ ব্যবসাই করতে পারলেন না।
একটি অগ্নিকাণ্ড মানে অনেকগুলো স্বপ্নের অপমৃত্য। অনেক আশা প্রত্যাশার চির বিলুপ্তি। হাজারো মানুষের হাজারো পরিকল্পনা। দোকান মালিকদের অনেকেই ভেবেছেন ঈদের বেচাকেনা শেষে বড়ো মাপের ঋণের দায় থেকে মুক্ত হতে পারবেন। কেউ অসংখ্য মানুষকে আশা দিয়ে রেখেছেন যে ওয়াদাগুলো আর পূরণ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। অধিকাংশ ব্যবসায়ীর বক্তব্য ছিলো, গতকাল ছিলাম কোটিপতি আজ রাস্তার ফকির। এ সকল মালিকদের প্রতি আশা প্রত্যাশা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো যারা তাদের আশাগুলো অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। একটির পর একটি অগ্নিকাণ্ড। কয়টি নিয়ে আলোচনা করা যায়? এক একটি ঘটনা ঘটে তা নিয়ে কয়েকদিন আলোচনা হয়। পত্রিকার পাতায় সরগরম নিউজ ছাপা হয় এরপর সবকিছুতে শুনশান নীরবতা। রমজানের শুরুর আগে দুটি বড়ো বিস্ফোরণে অনেকগুলো মানুষের প্রাণহানি। একটি রাজধানীর সাইন্সল্যাবে অন্যটি সিদ্দিকবাজারে। রমজান মাসের মাঝামাঝি একের পর এক আগুনে পুড়তে লাগলো মার্কেট। ঢাকার বঙ্গাবাজার দেশের অন্যতম খুচরা ও পাইকারি বাজার। সারাদেশ থেকে এখাসে যেমন পাইকারি ক্রেতারা আসেন, একইভাবে আসেন খুচরা বিক্রেতারাও। ঢাকার বাইরের কাপড় ব্যবসায়ীরা আগে অনেকটা নিশ্চিন্ত মনে ঢাকায় আসতেন তাদের ভরসা ছিলো, বঙ্গবাজার। এ মার্কেটের একটি সুবিধা হচ্ছে এখানে দেশি বিদেশী সকল কাপড় পাওয়া যায়। একইভাবে সকল শ্রেণির ক্রেতার সাধ্য ও সাধ্যের মধ্যে এখান থেকে মালামাল সংগ্রহ করা যায়। তাই সারাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য অল্প সময়ে কেনা কাটা শেষ করার জন্য অন্যতম পছন্দের জায়গা ছিলো বঙ্গাবাজার। বঙ্গাবাজার আগুনে পুড়ে যাবার পর একজন পাইকারি ক্রেতার বক্তব্য একটি জাতীয় দৈনিকে এভাবে উঠে এসেছে ‘আগে এক ঘণ্টায় চাহিদামতো সব মালামাল কেনা হয়ে যেত। আর আগুনের পর গিয়ে আমি প্রায় তিন থেকে চার ঘণ্টা ঘুরছি। কিন্তু ৫০ হাজার টাকার মাল কিনতে পারি নাই। সেটা নিয়ে ফিরে আসছি। দামও হেরফের বেশি। আবার যেতে হবে কয়েকদিনের মধ্যে।’ তার মানে বঙ্গবাজারের আগুনে শুধু এখানকার ব্যবসায়ীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এর প্রভাব পড়েছে সারাদেশের কাপড় ব্যবসায়ীদের ওপর।
একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শুধু কত টাকার মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হলো সেটিই আলোচনার বিষয় নয়। একজন ব্যবসায়ী অনেকের কাছ থেকে বাকিতে পণ্য ক্রয় করেছেন, ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান হতে ঋণ গ্রহণ করেছেন। আবার নিজে অনেককে বাকি দিয়েছেন। এভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এমন অনেকেরই কথামালা উঠে এসেছে। অনলাইন নিউজ পোর্টাল ‘বিডি নিউজ ২৪ ডট কম’ এ মিজানুর রহমান নামে একজন ব্যবসায়ীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। এই ব্যবসায়ী গত ২৬ বছর ধরে বঙ্গবাজারে ব্যবসা করছেন। তার টিশার্ট ও গেঞ্জির সাতটি দোকানে ১৫ জন কর্মচারী কাজ করতেন। ঈদ উপলক্ষ্যে ঋণ নিয়ে দোকানে মালামাল তুলেছিলেন মিজানুর রহমান। আগুন লাগার পর সেসব মালামালের কিছুই উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি বিডি নিউজকে বলেন, ‘ঈদ উপলক্ষে মালামাল তুলতে দুই কোটি টাকা ঋণ নিয়েছি ব্যাংক ও স্বজনদের কাছ থেকে। সাত দোকানে ৮-১০ কোটি টাকার মালামাল ছিল। কিন্তু এক সুতাও উদ্ধার করতে পারিনি।’ এমন আর একজন ব্যবসায়ী শামীম আহমেদ। তিনিও একই ধরনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবাজারের প্রতিটি ব্যবাসায়ীর এমন অভিব্যক্তি পাওয়া যাবে। সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা দোকান মালিকদের জন্য নামমাত্র পুঁজির ব্যবস্থা করলেও তারা কতদিনে ঘুড়ে দাঁড়াতে পারবে একমাত্র আল্লাহই ভালো জানেন। তবে সবচেয়ে করুণ অবস্থা দোকান কর্মচারীদের। যারা বছরের এই একটি সময়ে আশায় থাকে যখন তারা ঈদ বোনাস হিসেবে ডাবল বেতন পান। অনেক মালিক দোকান কর্মচারীদের সন্তানদের জন্য ঈদে নতুন পোশাক উপহার হিসেবে দিয়ে থাকেন। তারাও অনেকেই সন্তানদের আশা দিয়ে রেখেছেন ঈদে নতুন জামা নিয়ে আসবেন। সন্তানরাও নতুন পোশাক এবং ঈদ উপহারের প্রত্যাশায় দিন গুজরান করেছে কিন্তু এবারে তাদের সে প্রত্যাশা তাদের অভিভাবকরা আদতেই পূরণ করতে পারেননি। এভাবে অনেকের স্বপ্নগুলো আগুনের লেলিহান শিখায় হতাশায় পরিণত হয়েছে।
রমজানের শেষ দশকে আগুনে পুড়ে নিউ মার্কেটের প্রায় এক হাজার দোকান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এখানকার ব্যবসায়ীদের বক্তব্য শোনলে বোঝা যায় যে, তারা কি পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। একজন ব্যবসায়ীর সাথে আমি যখন কথা বললাম, তিনি বললেন, সারা বছরের বিভিন্ন লেনদেন থাকে। আমরা কারো কাছ থেকে বাকিতে মালামাল ক্রয় করি, আবার আমাদের কাছ থেকে যারা বাকিতে মালামাল ক্রয় করে উভয় লেনদেনের একটি পরিসমাপ্তি হয় রমজান মাসে। মোদ্দাকথা রমজানে সারা বছরের দেনা পাওনার হিসাব মেটানো হয়। যে সময়টিতে সারা বছরের হিসাব মেটানো হয়; সেই সময়ে আমাদেরকে পথের ফকির বানিয়ে দেওয়া হলো। নিউ মার্কেটে বোরকা হিজাবের দোকান করে সুমন নামে এক তরুণ। কিছু দিন পূর্বে তার পিতা মারা গিয়েছে। মা এবং ছেলে মিলে দোকানটি পরিচালনা করেন। সুমনের মাকে একটি অনুষ্ঠানে সামান্য কিছু অর্থ সাহায্য প্রদান করা হয়েছে। সেই উপহার গ্রহণ করার সময় তিনি শুধু কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, ছেলের বাবা মারা যাবার পর মা-ছেলে মিলে নতুন প্রত্যাশায় দোকানটি পরিচালনা করছিলাম। কিন্তু এক দিনের আগুনে আমাদের সে প্রত্যাশাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলো। সেখানকার ব্যবসায়ীদের প্রত্যেকেরই এমন বেদনাভরা বক্তব্য আছে। এখানকার আগুন নিয়ে বিপরীত মুখী যে কথা আছে তারও সুরাহা হওয়া দরকার এবং বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া দরকার।
ভবন নির্মাণের সময় চারদিকে ৩৫ শতাংশ জমি ছেড়ে দিতে হবে, এ নিয়ম কয়জন মানে ভবনগুলোর মাঝখানের দূরত্ব দেখলেই তা বোঝা যায়। বিদ্যুৎ সংযোগ এবং ভবনের ওয়্যারিং নীতিমালা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানার কোনো বালাই নেই। ঢাকার সুয়ারেজ লাইনগুলো একটি সভ্য নগরের সাথে মেলে না।
আগুন, ধ্বংস, মৃত্যু আর গভীর ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর বেদনার মাঝে কিছু অনাহুত জবাব ব্যতীত জাতি আর কিছুই পায়নি। বিদ্যুৎ সংযোগে ত্রুটি, গ্যাস সংযোগের অবৈধতা, ভবন নির্মাণে অনুমতি নেই, ফায়ার সার্টিফিকেট নেই, বৈধ কাগজপত্র ছিলো নাÑইত্যাদি বেসুরো জবাবগুলো শুনতে শুনতে আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। রাষ্ট্রের কর্মচারীদের অপেশাদারিত্বমূলক জবাবের মাঝে রাজনীতিবিদদের বক্তব্যগুলো আমাদের তপ্তক্ষতে নতুন করে অগ্নি প্রজ্জলন করে। বিরোধী দলের নাশকতা, সরকার পতনের ষড়যন্ত্র, কিংবা স্বাধীনতার দুশমনরা এ ঘটনা ঘটিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্যও কখনো কখনো সন্তোষজনক হয় না। নাশকতা, জঙ্গিতত্ত্ব অথবা ক্ষমতাসীনদের খুশি করতে তাদের সাচিবিক শব্দের ব্যবহার আমাদের প্রত্যাশার পারদকে শুধু নিম্মগামীই করে। মৃত মানুষের স্বজনরা প্রিয়জন হারানোর বেদনা এক সময় ভুলে গেলেও আহত মানুষদের কেউ কেউ দুঃসহ স্মৃতির বোঝা নিয়ে জীবনকে পার করে দেয়। তাজরীন দুর্ঘটনায় এখনো অনেকে আপনজনের ছবি নিয়ে দুঃখ দিনের স্মৃতি রোমন্থন করে; যারা আজও পর্যন্ত জানতে পারেনি তার পরিবারের সদস্যের লাশটি কোথায়? অনিয়ম আর বিশৃঙ্খলায় ভরা রাষ্ট্রের পরতে পরতে শুধু নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষগুলো বারুদ আর বোমার মাঝে বসবাস করে। আমরা যেন যুদ্ধ ছাড়াই টাইম বোমার ওপরে বসবাস করছি। রাজধানী ঢাকার হাজার হাজার ভবন এমন যার অনুমোদন কিংবা নির্মাণশৈলী যথাযথ নিয়মে হয়নি। বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণের পরও সেখানে অনিয়মের প্রতিযোগিতা আছে। আমরা যতো আধুনিক হচ্ছি, প্রাগৈতেহাসিক নির্মমতা আমাদের জীবনকে ততো বেশি অষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে। দুর্ঘটনাগুলো কি শুধু নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা, না কি নৈতিক ও চারিত্রিক মাপকাঠিতে আমরা দিন দিন অধঃগতির দিকে যাচ্ছি তাও বিচার করে দেখা দরকার।
প্রতিটি ঘটনা আমাদের হৃদয়কে নতুন করে নাড়া দেয়। ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সরকারের টনক নড়ে। সাংবাদিক বন্ধুরা সংবাদ সংগ্রহে রাতদিন দৌড়ঝাঁপ করে। রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট আইনি এবং প্রশাসনিক বিভাগগুলো তৎপর হয়। স্বেচ্ছাসেবীদের অক্লান্ত পরিশ্রম আমাদের আশাবাদী করে। অল্পদিনের মধ্যেই দুর্ঘটনার রেশ কেটে যেতে থাকে। আবার নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা চলে। নিয়মের মাঝেও কখনো কখনো দুর্ঘটনা ঘটে চলে। বেশ কয়েকবছর যাবৎ পুরান ঢাকায় আগুন লাগার ঘটনা ঘটেই চলছে। লোকালয়ের বাইরে কেমিকেল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার কথা বলা হলেও তা কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বোঝার উপায় নেই। পুরান ঢাকার গলিগুলো এতো সরু যে, কোনো কোনো গলিতে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি তো দূরের কথা রিক্সা ঢোকাই দায়। একটি ভবন থেকে আর একটি ভবনের মাঝে যে ফাঁকা থাকার কথা তা আদৌ নেই। একটি ভবন নির্মাণের সময় চারদিকে ৩৫ শতাংশ জমি ছেড়ে দিতে হবে, এ নিয়ম কয়জন মানে ভবনগুলোর মাঝখানের দূরত্ব দেখলেই তা বোঝা যায়। বিদ্যুৎ সংযোগ এবং ভবনের ওয়্যারিং নীতিমালা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানার কোনো বালাই নেই। ঢাকার সুয়ারেজ লাইনগুলো একটি সভ্য নগরের সাথে মেলে না। এসব লাইনের মাধ্যমে মিথেন গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে বড়ো দুর্ঘটনা যে কোনো সময় ঘটতে পারে, সাইন্সল্যাব এলাকার দুর্ঘটনা তার প্রমাণ। তিতাস গ্যাসের লাইনগুলো কতটুকু নিরাপদ তা প্রমাণ করেছে গুলিস্তান ট্রাজেডি। নগরের অফিস এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের সীমাতিক্রম্য প্রতিযোগিতায় হাজারো প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ সব প্রতিষ্ঠানের ক্যাবল যেন নগরীতে এক মহাজঞ্জাল। কোন সংস্থা তাদেরকে এভাবে বিদ্যুৎ লাইনের পিলারের সাথে ক্যাবল টানার অনুমোদন দিয়েছে তার কোনো জবাব পাওয়া দুস্কর।
চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের অক্সিজেন ডিপো, রাজধানীর সাইন্সল্যাব, সিদ্দিকবাজার এবং আরমানিটোলা ট্রাজেডিতে নিহতদের স্বজনদের কান্না এখনো থামেনি। আহতরা হাসপাতালে কাতরাচ্ছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকজন আছেন যারা শঙ্কামুক্ত নন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী সিদ্দিকবাজার ট্রাজেডির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা সাতাশ জনে এসে দাঁড়িয়েছে। আহত হয়ে এখনো চিকিৎসাধীন আছেন অনেকে। মহামহিম রবের কাছে প্রার্থনা আল্লাহ আহত সবাইকে অতি দ্রুত সুস্থ করে দিন। সিদ্দিকবাজার ট্রাজেডির দিন গিয়েছিলাম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালের মর্গে নিহতদের লাশের সাড়ি, বাইরে স্বজনদের কান্না এবং আহতদের গগণবিদারী চিৎকার পুরো হাসপাতালের পরিবেশকে ভারী করে তুলেছিলো। ঢাকার লালবাগের ইসলামবাগের অধিবাসী মমিনুল ইসলাম এবং তার স্ত্রী নদী আক্তার একই সাথে নিহত হয়েছেন। মমিনুল ইসলামের ছোটো বোনের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। ভাই এবং ভাবীকে হারিয়ে সে নির্বাক। ঘটনায় নিহত আকুতি বেগমের ভাইয়ের ছেলে শুধু চিৎকার করে কাঁদতেছিলো। কোনো সান্তনাই তার কান্না থামাতে পারছে না। বন্ধুকে হারিয়ে চিৎকার করে কাঁদছিলো পুরান ঢাকার একদল তরুণ।
মিডিয়ার বরাতে আমরা অনেকেই জেনেছি নিহত এবং আহত অনেকের হৃদয়ছোয়া কাহিনী। মায়ের জন্য ইফতার কিনতে এসেছিলো বংশালের এক তরুণ। ইফতার নয় সে নিজেই লাশ হয়ে তখন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। নিজ বাড়ি ময়মনসিংহে রওয়ানা দিয়েছিলেন এক নারী, পথিমধ্যে তিনি এ ঘটনায় লাশ হলেন। নিহতদের একটি বড়ো সংখ্যা অতিদরিদ্র শ্রেণির মানুষ। গুলিস্তান বিস্ফোরণে নিহত আহত সবার জীবনেই আছে এক একটি ট্রাজেডিক গল্প। এদের মধ্যে একজন রবিন হোসেন শান্ত। যাকে তার দরিদ্র বাবা-মা বিয়ে করিয়েছিলেন। তাদের আশা ছিলো ছেলের বউ তাদের ঘর আলোকিত করবে। সেই বউ এসেছে তবে স্বামীর হাত ধরে লাল শাড়ি পড়ে নববধুর সাজে নয়। সে এসেছে স্বামীর লাশ দেখতে এবং তার দাফন ও জানাজা দেখতে। শান্তর পিতা-মাতার দুঃখগাথার কয়েক পঙক্তি দৈনিক সমকালের বরাতে পাঠকদের জন্য উল্লেখ করছি ‘আমরা বুড়া-বুড়ি কখন যে মরে যাই তা কি বলতে পারি। তাই ছেলের বউ দেখব বলে পাঁচ মাস আগে তাকে বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু অভাবের সংসারে অনুষ্ঠান করতে পারিনি। তাই এখনও পোলা বউরে বাড়িতে নাইয়র (ওঠানো) আনা হয় নাই। ছেলের দোকান মালিক বলেছিলেন, রমজানের ঈদের পরে শান্তর (ছেলে) বেতন বাড়াবে। আশা ছিল, কোরবানির ঈদের পর গ্রামের মুরব্বিদের নিয়ে লাল শাড়ি পরাইয়া বউ আনব। কিন্তু তা আর হলো না। নতুন বউ আইলো স্বামীরে দাফন করতে।’ শান্তর মতো বেশ কয়েকজন তরুণ এ ঘটনায় নিহত হয়েছে, যারা বিভিন্ন দোকানের কর্মচারী। টাইলস দোকানের কর্মচারী আছে চার-পাঁচজন। কুমিল্লার মেঘনা থানার মো. সুমন মাত্র ১০/১২ দিন আগে কাতার থেকে দেশে ফিরেছেন। সুমন কিংবা তার পরিবারের কেউই কি জানতো এটিই তার জীবনের শেষ দিন। শুধু ঢাকা মেডিকেল নয়, জাতীয় বার্ণ ইনস্টিটিউট, মিডফোর্ড হাসপাতাল, পঙ্গু হাসপাতাল সর্বত্রই ছিলো এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। আহত নিহত মানুষের সারির সাথে ভীড় বাড়তে থাকে স্বজনদের। এ মানুষগুলো কষ্টের লোবানে পোড়া নির্ঘুম রাত পার করেছে হাসপাতালেই।
দুর্ঘটনার পরে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদেরকে সেফসাইডে নেওয়ার চেষ্টা করে।
জীবন মৃত্যুর ফায়সালা আল্লাহর হাতে; এটি নির্মম সত্য। কিন্তু সেই আল্লাহরই ঘোষণা, ‘জলে স্থলে মানুষের জীবনে যতো বিপদ বিশৃঙ্খলা সবই মানুষের কৃতকর্মের ফসল।’ আল্লাহ নিয়মের বাইরে পৃথিবীকে পরিচালনা করেন না। কোনো জাতি যখন গড়ার চেয়ে ভাঙার খেলায় বেশি মত্ত হয়ে যায় তখন প্রথম আল্লাহ তাদেরকে ছোটো বিপদ দিয়ে সতর্ক করেন। এরপর বড়ো বড়ো বিপদ তাদের ওপর আবর্তিত হয়। আল্লাহ কুন ফায়াকুনের মালিক। তিনি যখন যা ইচ্ছা করেন তাই ঘটাতে পারেন। পৃথিবী পরিচালনায় আল্লাহর একটি নিয়ম আছে এই নিয়মের তিনি কখনো ব্যত্যয় ঘটান না। রাস্তায় একটি চলমান গাড়িকে তিনি বিনা কারণে বিপদে আবর্তন করান না। ড্রাইভার নিয়ম ভেঙে ওভার স্পিডে গাড়িকে নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে গেলে সেখানে দুর্ঘটনা ঘটা স্বাভাবিক। কেউ আগুনে হাত না দেওয়া পর্যন্ত কারো হাত পুড়বে না। আমাদের দেশের গোটা ব্যবস্থাপনায় অধিকাংশ মানুষের মাঝে নিয়ম ভাঙার একটি মানসিক ব্যাধি তৈরি হয়েছে। হাসপাতালে রোগী দেখাতে গিয়ে আরও দশজন মুমূর্ষ রোগীকে পেছেনে ফেলে নিজে আগে কিভাবে ডাক্তারের কাছে যাওয়া যায় তার একটি প্রতিযোগিতা। ব্যাংকের লাইনে বিল কিংবা টাকা জমা দিতে গেলে সবার আগে যাওয়ার চেষ্টা। রাস্তায় গাড়িতে ওঠার ক্ষেত্রে অন্যজনকে ধাক্কা দিয়ে নিজে ওঠার প্রতিযোগিতা।
বিপদ আপদ আসে আল্লাহর পক্ষ হতে আবার বিপদ থেকে উদ্ধার করেন একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। মানুষ পাপ করতে করতে যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ সেই জাতিকে নানা বিপদ দিয়ে সতর্ক করেন।
নিয়ম লঙ্ঘন করে বাড়ি নির্মাণ, গ্যাস বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি কর্মযজ্ঞ চলে সারা বছর। মানুষের এই যে নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতা; এর পেছনে অন্যতম একটি কারণ পাবলিক সার্ভিস বলতে যা বোঝায় তা মানুষের জন্য সহজলভ্য নয়। সরকারি অফিসগুলোতে সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে ঘুষ ছাড়া ফাইল চলে না। রাজউক, ওয়াসা বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের জন্য কতটুকু সেবামূলক, ভুক্তভোগী ব্যতীত কেউ তা বুঝবে না। ডিজিটাল থেকে স্মার্টের পথে হাঁটা বাংলাদেশে এখন ঘুষও স্মার্ট পদ্ধতি অবলম্বন করছে। সব নিয়ম মানার পরেও বকশিশ না দিলে সেবা পাওয়া যেখানে দুস্কর, সেখানে অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে যায়। অসংখ্য অনিয়মের ভীড়ে কোনটি নিয়ম আর কোনটি অনিয়ম তা বোঝা দুস্কর হয়ে পড়ে। প্রতিটি দুর্ঘটনার পরে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো দায়সারা বক্তব্য দিয়ে নিজেদেরকে সেফসাইডে নেওয়ার চেষ্টা করে। সর্বত্র অনিয়ম আর অনাচারের জঞ্জালের মাঝে স্রষ্টা আমাদেরকে স্বাভাবিক জীবন যাপনের যতটুকু সুযোগ দিয়েছেন তা মহান রবের অপার মেহেরবাণী। নিয়ম ভাঙার এই সমাজকে গড়ার পথে নিয়ে যেতে না পারলে তাজরীন, সীতাকুন্ড নয় তার চেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পথে আমাদেরকে ধাবিত করবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে সকল বিপদ থেকে রক্ষা করুন।
এই দেশ, এই সমাজ, এই নগর আমাদেরই। এখানে আমরা নিঃশ্বাস গ্রহণ করি। এখানের আলো ছায়ায় আমরা আমাদের জীবনের স্বপ্ন বুনি। নিয়ম ভাঙার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হওয়ার ফলাফল আমরা প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছি। ওপরতলা হতে সর্ব নিচের যেন অনিয়ম আর অনাচারের প্রতিযোগিতা চলে। শুধু কাগজে লেখা নিয়ম নয়। রাস্তা, পুল, কালভার্ট, ভবন নির্মাণ, পণ্য পরিবহন, শিল্প কারখানা এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সকল স্তরে যে সকল নিয়ম ও বিধি মেনে চলা দরকার প্রতিটি নাগরিক সে নিয়মের সাথে নিজেদের অভ্যস্ত করে তুলতে পারলে আমরা অসংখ্য বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। রাষ্ট্রের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তা কর্মচারীরা জনগণের তরে এবং জনগণের জন্য কল্যাণকর ও মানবসেবার ব্রত নিয়ে কাজ করলে আমরা একটি সুন্দর সমাজ একটি সুন্দর সমাজ পেতে পারি-আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। সকল সতর্কতা অবলম্বনের সাথে মৌলিকভাবে যে বিষয়টি সামনে রাখতে হবে এবং প্রাধান্য দিতে হবে তা হচ্ছে, বিপদ আপদ আসে আল্লাহর পক্ষ হতে আবার বিপদ থেকে উদ্ধার করেন একমাত্র মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। মানুষ পাপ করতে করতে যখন সীমা ছাড়িয়ে যায় তখন আল্লাহ সেই জাতিকে নানা বিপদ দিয়ে সতর্ক করেন। আজ যদি আমরা আমাদের ব্যক্তি, পরিবার এবং সমাজ জীবনের দিকে তাকাই তখন কি দেখি? সর্বত্র অন্যায়, আনাচার পাপ পঙ্কিলতা, জুলুম, নির্যাতন মাদক, ব্যভিচার, অশ্লীলতা আর পাপের ব্যাপক প্রসার। মানুষ পদে পদে আল্লাহর হুকুমকে লঙ্ঘন করছে। আল্লাহর হুকুম লঙ্ঘনের ফলে ইতঃপূর্বে আল্লাহ বহু জাতিকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, রাহমাতুল্লিল আলামিন মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) এর দোয়ার বদৌলতে আল্লাহ এখন আর মুসলিম উম্মাহর কোনো জনপদকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করবেন না। তবে তিনি বিপদ আপদ দিয়ে মানুষকে সতর্ক করবেন। এ বিপদ কখনো আসবে সতর্কতা হিসেবে, কখনো পরীক্ষা হিসেবে, কখনো গজব হিসেবে। এ থেকে বাঁচতে হলে আমাদেরকে আল্লাহর দিকেই ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে তাকওয়ামুখী জীবন গঠন করার তাওফিক দান করুক। তারই বিধানের আলোকে আমাদের জীবন ও সমাজ জীবন গঠন করার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন