কুরবানির পরিচয়?
কুরবানি আরবি শব্দ এর অর্থ হলো নৈকট্য লাভ করা, নিকটে আসা, ত্যাগ, উৎসর্গ ইত্যাদি। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো নুসুক। যেমন মহান আল্লাহ বলেন, ‘বলো! আমার নামাজ, আমার ইবাদাতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রব্বুল আলামিনের জন্য।’ (সুরা আল-আনয়াম: ১৬২)
পরিভাষায় ইবাদাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা। এই শব্দটি কুরআনে আল্লাহ বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহার করেছেন। অন্য জায়গায় তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি একটি ইবাদাতের পদ্ধতি নির্দিষ্ট করেছি যা তারা অনুসরণ করে। কাজেই হে মুহাম্মদ! এ ব্যাপারে তারা যেন তোমার সাথে ঝগড়া না করে। তুমি তোমার রবের দিকে দাওয়াত দাও। অবশ্যই তুমি সঠিক সরল পথে আছো।’ (সুরা হজ আয়াত: ৬৭)
‘প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানির একটি নিয়ম ঠিক করে দিয়েছি, যাতে সে উম্মতের লোকেরা সে পশুদের ওপর আল্লাহর নাম নেয় যেগুলো তিনি তাদেরকে দিয়েছেন। কাজেই তোমাদের ইলাহ ও সে একজনই এবং তোমরা তারই ফরমানের অনুগত হয়ে যাও। আর হে নবী সুসংবাদ দিয়ে দাও বিনয়ের নীতি অবলম্বনকারীদেরকে’ (সুরা হজ: ৩৪)। মহান আল্লাহ তার বান্দাকে বিভিন্ন ইবাদাতের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ করে দেন। এর মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়।
কুরবানির ধরন:
১. কুরবানির পূর্বশর্ত হলো তাকওয়া:
আমরা জানি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম কুরবানি বা আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দিয়ে। আদম (আ.) এর দুই সন্তান কুরবানির জন্য তাদের নিজেদের বস্তু সামগ্রী পেশ করেন। মহান আল্লাহ একজনের বস্তু কবুল করেন ও অন্য জনেরটা কবুল করেননি। এই ঘটনাকে মহান আল্লাহ কুরআনে এভাবে বর্ণনা করেন, ‘আর তাদেরকে আদমের দু-ছেলের সঠিক কাহিনী ও শুনিয়ে দাও। তারা দুজন কুরবানি করলে তাদের একজনের কুরবানি কবুল করা হলো, অন্য জনেরটা কবুল করা হলো না। সে বললো আমি তোমাকে মেরে ফেলবো। সে জবাব দিল, আল্লাহ তো মুত্তাকিদের নজরানা কবুল করে থাকে’ (সুরা মায়েদা: ২৭)। এখানে তিনি বলেন মুত্তাকীদের কুরবানিই আল্লাহ কবুল করেন।
২. আগুন এসে কবুলকৃত কুরবানির বস্তুকে জ্বালিয়ে ভষ্ম করে দিত:
প্রাচীনকালে মহান আল্লাহ কুরবানি কবুল কীভাবে করতেন তা তিনি সুরা আলে ইমরানে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘যারা বলে আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন, আমরা কাউকে রসুল বলে স্বীকার করবো না যতক্ষণ না তিনি আমাদের সামনে এমন কুরবানি করবেন যাকে আগুন খেয়ে ফেলবে। তাদেরকে বলো আমার আগে তোমাদের কাছে অনেক রসুল এসেছেন, তারা অনেক উজ্জ্বল নিদর্শন এনেছিলেন এবং তোমরা যে নিদর্শনটির কথা বলছো সেটিও তারা এনেছিলেন। এ ক্ষেত্রে যদি তোমরা সত্যবাদি হও তাহলে ঐ রসুলদেরকে তোমরা হত্যা করেছিলে কেনো?’ (সুরা আলে ইমরান: ১৮৩)।
৩. হারাম কুরবানি:
ক.বিভিন্ন দেব-দেবী ও মূর্তির জন্য কুরবানি: ‘যা তাদেরকে বিপদ হতে মুক্তি দেবে বলে তারা মনে করে বা মহান আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের জন্য চেষ্টা করে’ (সুরা আহকাফ: ২৮)।
কিন্তু আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব সত্তাকে তারা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম মনে করে উপাস্য বানিয়ে নিয়েছিল তারা কেন তাদেরকে সাহায্য করলো না। বরং তারা তাদের থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল। এটা ছিলো তাদের মিথ্যা এবং মনগড়া আকিদা বিশ্বাসের পরিমাণ, যা তারা গড়ে নিয়েছিলো। (সুরা আলে ইমরান: ১৮৩)
খ.যাদের কুরবানি বা ইবাদত আল্লাহ কবুল করেন না: কাফের মুশরিকদের কুরবানি আল্লাহ কবুল করেন না। তারা আল্লাহকে ছাড়া অন্য দেবদেবী পূজা করে এই মনে করে যে এই দেবদেবী তাদেরকে আল্লাহর নিকটে নিয়ে যাবে। তাদের ইবাদাত কে তারা কুরবানির মাধ্যমে মনে করে।
৪. বিভিন্ন নবির পরীক্ষা বা কুরবানি:
ক. নূহ (আ.) এর কুরবানি:
হযরত নূহ (আ.) আল্লাহ তাঁকে তাঁর সঙ্গীসহ ভাসমান জাহাজে করে উঠানোর সময় তার সন্তানসহ তিনি জাহাজে উঠতে চেয়েছেন কিন্তু তার সন্তান মুত্তাকি না হওয়ায় আল্লাহ তাকে অথৈ পানিতে তলিয়ে দিলেন। এটা একটা মহান কুরবানি।
হে পুত্র আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে যবেহ করছি, এখন তোমার সিদ্ধান্ত কী? সে বললো হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারী হিসেবে পাবেন’
নৌকা তাদেরকে নিয়ে পর্বত প্রমাণ ঢেউয়ের মধ্য দিয়ে ভেসে চলতে লাগলো। নূহের ছেলে ছিল তাদের থেকে দূরে। নূহ চিৎকার করে তাকে বললো, ‘হে আমার পুত্র! আমাদের সাথে আরোহণ করো, কাফেরদের সাথে থেকো না। সে পাল্টা জবাব দিল আমি এখনই একটি পাহাড়ে চড়ে বসছি। তা আমাকে পানি থেকে বাঁচাবে। নূহ বললো আজ আল্লাহর হুকুম থেকে বাঁচাবার কেউ নেই, তবে যার প্রতি আল্লাহর রহমত করেন সে ছাড়া। এমন সময় একটি তরঙ্গ উভয়ের মধ্যে আড়াল হয়ে গেলো এবং সেও নিমজ্জিতদের দলে শামিল হলো। এর পর নূহ (আ.) তাঁর রবকে ডাকলো বললো হে আমার রব! আমার ছেলে আমার পরিবারভুক্ত এবং তোমার প্রতিশ্রæতি সত্য আর তুমি সমস্ত শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো ও উত্তম শাসক। জবাবে বলা হলো হে নূহ! সে তোমার পরিবারভুক্ত নয়। সে তো অসৎ কর্মপরায়ণ। কজেই তুমি আমার কাছে এমন বিষয়ের আবেদন করো না যার প্রকৃত তত্ত¡ তোমার জানা নেই। আমি তোমাকে উপদেশ দিচ্ছি, নিজেকে অজ্ঞদের মতো বানিয়ে ফেলো না’ (সুরা হুদ: ৪২-৪৬)।
খ.হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর কুরবানি:
ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে তার প্রিয় বস্তু কুরবানি করেন। তার প্রিয় সন্তান ইসমাইল-ই হলো বৃদ্ধ বয়সে আল্লাহর পক্ষ হতে শ্রেষ্ঠ উপহার তা কিনা আবার আল্লাহর নিকট সোপর্দ করতে হবে। আল্লাহ বার বার স্বপ্নে এই বিষয়টি ইঙ্গিত দেওয়ার পর তিনি তার সন্তান ইসমাইলকে কুরবানির করার জন্য প্রস্তুতি নিলেন। যার চিত্র আল্লাহ এভাবে বর্ণনা করেন, ‘সে পুত্র যখন তার সাথে কাজকর্ম করার বয়সে পৌঁছলো তখন হে পুত্র আমি স্বপ্নে দেখি তোমাকে যবেহ করছি, এখন তোমার সিদ্ধান্ত কী? সে বললো হে আমার পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে তা করুন, আপনি আমাকে ইনশাআল্লাহ সবরকারী হিসেবে পাবেন’ (সুরা সাফফাত: ১০২)।
বুঝা গেল আল্লাহর আনুগত্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করাই বা সকল কিছু মহান আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করাই হলো কুরবানি। নিজের চাওয়া পাওয়া সব কিছু তারই নির্দেশমত তার চাওয়া মত হওয়াই হলো কুরবানির মূল চেতনা।
কুরবানির উদ্দেশ্য:
কুরবানি শব্দটির পশু যবেহ করার অর্থে তথা নিজের সম্পদ যা মূলত আল্লাহর পক্ষ হতে দান তা তার পথে ব্যয় করার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশ। যেমন সুরা কাওছারে রাসুল (সা.) কে আল্লাহ বলেন হে রাসুল আপনি নামাজ পড়ুন ও কুরবানি করুন অর্থাৎ পশু যবাই করুন।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, বলো! আমার নামাজ, আমার ইবাদাতের সমস্ত অনুষ্ঠান, আমার জীবন ও মৃত্যু সবকিছু আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য’ (সুরা আল-আনয়াম: ১৬২)। এই আয়াতে নুসুক বলতে পশু যবাইকে বুঝানো হয়েছে।
আল্লাহর রাস্তায় সম্পদ দানের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাসিল করা: যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আরব বেদুইনদের মধ্য থেকে কিছু লোক এমনও আছে যারা আল্লাহ ও কেয়ামাতের দিনের প্রতি ইমান রাখে এবং যা কিছু খরচ করে তাকে আল্লাহর দরবারে নৈকট্য লাভের উপায় এবং রাসুলের কাছ থেকে রহমত লাভের উপায় হিসেবে গ্রহণ করে। হ্যাঁ অবশ্যই তা তাদের জন্য নৈকট্য লাভের উপায়। আল্লাহ তাদেরকে রহমতের মধ্যে প্রবেশ করাবেন। অবশ্যই আল্লাহ ক্ষমাশীল ও করুণাময়’ (সুরা তাওবা আয়াত: ৯৯)।
যারা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সম্পদ, সন্তান ও সময় কুরবানি করে আল্লাহর ভালবাসায় সিক্ত হতে চায় তাদের উচিত সমাজের সকল অসঙ্গতি দূর করে সমাজে আল্লাহর নির্দেশ প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন। আর এজন্যই নবী রাসুলগণ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষার ময়দানে নিজেদেরকে পেশ করেন ও এই সকল পরীক্ষা তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন।
আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের গুরুত্ব: রাসুল (সা.) বলেন, ‘যখন বান্দা আমার আমার একদিকে এক বিঘত পরিমাণ অগ্রসর হয় আমি তার দিকে এক হাত অগ্রসর হই। আর যখন সে এক বিঘত অগ্রসর হয় আমি তার দিকে একগজ অগ্রসর হই। সে আমার দিকে হেটে আসলে আমি তার দিকে দৌড়ে আসি।’ (হাদিসে কুদসি)
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘বান্দা যখন সেজদা করে তখন সে তার রবের খুব কাছে চলে যায়। সুতরাং তোমরা তখন বেশি বেশি করে দোয়া করো’ (মুসলিম)
কুরবানির শিক্ষা: কুরবানির ফজিলত খুব অল্প কথায় বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। তবুও এর সংক্ষিপ্ত কিছু শিক্ষা আমরা তুলে ধরছি-
১. যে কোন ধরনের কুরবানি লোক দেখানো হওয়া যাবে না।
২. কুরবানি ইসলামের অন্যতম নিদর্শন, তাই এর ইতিহাস ও কারণ জেনে আমল করা অত্যাবশ্যক।
৩. আল্লাহর প্রেমে নিজেকে পুরোপুরি উৎসর্গ করার অপর নাম কুরবানি।
৪. পশু কুরবানির সাথে সাথে আল্লাহর নিজের অজ্ঞতা ও পশুত্বকে ত্যাগ করে আল্লাহর বিধানের সামনে মাথা নত করার জন্য কুরবানি।
৫. কুরবানি আমাদেরকে সাম্য ও সামাজিকতা শিক্ষা দেয়।
৬. কুরবানি আমাদেরকে ধৈর্য শিক্ষা দেয়।
৭. সব কিছুর চাইতে আল্লাহর নির্দেশকে প্রাধান্য দেওয়াই মূল শিক্ষা।
৮. দুনিয়ার বুকে মানুষ কুরবানি করে যেহেতু এতে পার্থিব লাভ রয়েছে; তেমনি এর পরকালীন কল্যাণ লাভ করতে চাইলে সমাজে তার আনুগত্যের সর্বোচ্চ নজরানা পেশ করতে হবে। সমাজে মহান আল্লাহর বিধানকে প্রতিনিয়ত দলিত মথিত করা হচ্ছে হাজার বার। যারা আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সম্পদ, সন্তান ও সময় কুরবানি করে আল্লাহর ভালবাসায় সিক্ত হতে চায় তাদের উচিত সমাজের সকল অসঙ্গতি দূর করে সমাজে আল্লাহর নির্দেশ প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়ন। আর এজন্যই নবী রাসুলগণ আল্লাহর জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ করেছেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষার ময়দানে নিজেদেরকে পেশ করেন ও এই সকল পরীক্ষা তাঁরা উত্তীর্ণ হয়েছেন।
লেখক: অধ্যক্ষ, তালিমুল মিল্লাত ইসলামিয়া মাদরাসা, ঢাকা।