বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেছেন, রেলওয়ে কর্মরত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন যাবত বৈষম্যের শিকার হয়ে আসছে। সরকারি অন্যান্য সেবাখাতে কর্মরত শ্রমিকরা বেশ কিছু সুবিধা পেলেও রেলওয়ে শ্রমিকরা বঞ্চিত রয়ে গেছে। রেল শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি অবিলম্বে মেনে নিতে হবে।
তিনি আজ রাজধানীর একটি মিলনায়তনে বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের কার্যকরী কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আকতারুজ্জামান-এর সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম পাটোয়ারী-এর সঞ্চালনায় এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আতিকুর রহমান। এতে আরও বক্তব্য রাখেন এমপ্লয়ীজ লীগের কার্যকরী সভাপতি মোঃ আব্দুল আজিজ, সহ-সভাপতি সরকার নাহারুল ইসলাম, মোঃ হাফিজুর রহমান, আব্দুস সালাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রেনায়েল আলম, ওমর ফারুক, সাংগঠনিক সম্পাদক মনিরুল ইসলাম মজুমদার প্রমুখ।
অধ্যাপক হারুনুর রশিদ খান বলেন, দেশে সরকারি কিংবা ব্যক্তি মালিকাধীন প্রতিষ্ঠানে একই চিত্র দৃশ্যমান। সর্বক্ষেত্রে শ্রমিকদের ঠকানোর জন্য একদল মানুষ তৎপর থাকে। রেলওয়ে এদেশের সবচেয়ে বড়ো সেবাখাত গুলোর একটি। এখানে যারা মানুষের সেবায় নিয়োজিত তাদের নিজেদের জীবন বিপন্ন। তারা তাদের শ্রমের কাক্সিক্ষত মজুরি পায় না। একজন শ্রমিক যখন তার ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত হয় তখন তার পক্ষে মানুষকে সর্বোচ্চ সেবা উপহার দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে সাধারণ মানুষরা পদে পদে রেলওয়ের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। রেলওয়ের দুর্দশা কাটিয়ে উঠার জন্য সর্বপ্রথম রেল শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে রেলওয়ে সবচেয়ে বড়ো গণপরিবহন। অথচ আমাদের দেশে দিন দিন রেলখাতকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের মানুষ রেলের সেবা গ্রহণ করতে চায়। রেলের যে বিপুল পরিমাণ যাত্রী আছে তাতে কোনোভাবেই রেলখাত লোকসান হতে পারে না। একশ্রেণির অসৎ কর্মকর্তারা রেলখাতকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। তারা চায় না মানুষ রেলের সেবা গ্রহণ করুক। তাই তারা বিভিন্ন কৌশলে যাত্রীদের উন্নত সেবা বঞ্চিত করার জন্য রেলের সিট, বগি ও টয়লেট অপরিষ্কার-অপরিচ্ছন্ন রাখে। যাত্রার সময় ও অযথা বিভিন্ন স্ট্রেশনে যাত্রা বিলম্ব করে যাত্রীদের রেল থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করছে। এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ করার জন্য রেলওয়ে শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি ও নিজেদের দাবি পূরণে সোচ্চার আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে এমপ্লয়ীজ লীগের ২৩ দফা দাবি সমূহ
১.পদ্মা সেতুতে দ্রুত রেললাইন চালু করে দেশের ৬৪ জেলাকে রেল নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে।
২.রেলওয়ের আয় বৃদ্ধির লক্ষ্যে বন্দরসমূহে হ্যান্ডিলিংকৃত কন্টেইনারের ৫০% রেলের মাধ্যমে পরিবহনের দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং প্রস্তাবিত আইসিডিসমূহ নির্মাণ পূর্বক সকল রেল ট্র্যাক ডবল লাইনে উন্নীত করতে হবে সে মোতাবেক জনবল ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।
৩.বৈশ্বিক উষ্ণতা ও কার্বণ নিঃসরণ প্রশমনসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্রকল্পে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ ফান্ড পাওয়াসহ রেলওয়ের বিভিন্ন কেনাকাটায় কার্বন ট্রেড সুবিধা প্রাপ্য হবে।
৪.দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে ৯ম পে-কমিশন এর মাধ্যমে ১১-২০ গ্রেড এর বেতন বৈষম্য দূর করতে হবে এবং অন্তবর্তী সময়ের জন্য ৫০% মহার্ঘভাতা প্রদান করতে হবে।
৫.পেনশন ৯০% এর স্থলে ১০০% এবং গ্র্যাচুইটি প্রতি টাকায় ২৩০ টাকা এর স্থলে ৫০০ টাকা প্রদান করতে হবে। কর্মচারীদের ইন্স্যুরেন্স সরকার ঘোষিত ৮,০০,০০০/- (আট লক্ষ) টাকা ও দাফন-কাফন বাবদ ৩০,০০০/- (ত্রিশ হাজার) টাকা প্রদান করতে হবে।
৬.সকল ট্রেড ইউনিয়নের মতামতের ভিত্তিতে নিয়োগ বিধি ২০২০ এর প্রয়োজনীয় সংশোধন করে দ্রুততার সাথে শুন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রদান করতে হবে। নিয়োগ বিধিতে মঞ্জুরিকৃত সকল পদের বিপরীতে পদোন্নতির ব্যবস্থা সংযোজন করতে হবে।
৭.রানিং স্টাফদের দীর্ঘদিনের প্রতিষ্ঠিত মাইলেজ সুবিধা বাতিল করা যাবে না। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন ও বাংলাদেশ বিমানের সাথে মিল রেখে সুবিধাদি আপগ্রেড করতে হবে।
৮.রেলওয়ের কল্যাণ ট্রাস্টকে সেনা কল্যাণের ন্যায় ঢেলে সাজাতে হবে এবং অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের দায়িত্ব প্রদান করতে হবে।
৯.রেলওয়ের অপচয় ও দুর্নীতি রোধে টেকনিক্যাল নিরীক্ষা কমিটি গঠন করতে হবে।
১০.নিয়োগ বিধিতে ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিসদের প্রশিক্ষণকাল ০২ বছর নির্ধারণ করতঃ পূর্বের ন্যায় স্কিল গ্রেড-২ পদের বিপরীতে আত্মিকরণ করতে হবে।
১১.রেলওয়ে হাসপাতাল ও ডিসপ্রেন্সরীসমূহে নিয়মিত ডাক্তারসহ জরুরি ঔষধ ও অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস নিশ্চিত করতে হবে।
১২.নিয়োগযোগ্য শুন্য পদ পূরণের জন্য স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রেলপোষ্যদের ৪০% চাকরি কোটা নিশ্চিত ও সুষম বণ্টন করতে হবে।
১৩.দ্রুততম সময়ের মধ্যে দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ, খুলনা-মংলা রেলপথ, বগুড়া-জামতৈল রেলপথ চালু করতে হবে।
১৪.লাকসাম-ঢাকা কর্ড রেলপথ, নোয়াখালী-সুবর্ণচর, সোনাইমুড়ি-লক্ষ্মীপুর, পদ্মাসেতু লিংকে ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বরিশাল-কুয়াকাটা, ভাটিয়ারী-ষোলশহর, সান্তাহার-আমনুরা, আবদুলপুর-রাজশাহী ডুয়েলগেজ, ঢাকা-মানিকগঞ্জ, আরিচা-পাটুরিয়া রেল লাইনসহ প্রস্তাবিত সকল রেলপথ বাস্তবায়ন চাই।
১৫.নিরাপত্তা ও দ্রুত গতির স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ লেবেল ক্রসিংসমূহে ইন্টার লকিং সিস্টেম এবং আন্ডারপাস ও ওভারপাস চালু করতে হবে।
১৬.০৩.১২.২০১৭ ইং মহাপরিচালকের পত্রের মর্ম মতে সকল টি.এল.আর সাবস্টিটিউটদের আত্মীকরণ করতে হবে। দক্ষ টিএলআরদের বাদ দেওয়া যাবে না এবং আউটসোসিং সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে।
১৭.পাহাড়তলী, সৈয়দপুর, কেলোকো-কারখানাসমূহকে আধুনিকায়ন করে ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগন সংযোজনের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
১৮.রেলওয়ে আবাসন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন করতে হবে এবং স্থান ও আয়তনভিত্তিক বাসা ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। রেলওয়ের অতি পুরাতন (৫০ বছর ঊর্ধ্ব) বাসা-বাড়িসমূহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের লক্ষ্যে ৫% বাসা ভাড়া কর্তন সাপেক্ষে বরাদ্দ দিতে হবে। এতে রেলের সকল বাসা-বাড়ি রেল কর্মচারীদের ব্যবহার নিশ্চিত হবে।
১৯.মহিলা কর্মচারীদের জন্য চাইল্ড কেয়ার সেন্টার, পৃথক ইবাদত খানা ও ওয়াশরুমের ব্যবস্থা করতে হবে।
২০.রেলের অব্যবহৃত ভূমি রেল কর্মচারীদের স্থায়ী আবাসনের জন্য বরাদ্দ প্রদান করতে হবে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত আবাসিক ভবন নির্মাণ করতে হবে ও পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
২১.প্রস্তাবিত মেডিকেল কলেজে ৪০% কোটা নির্ধারণপূর্বক ৫০% রেয়াতীহারে রেলপোষ্যদের অধ্যয়নের সুবিধা দিতে হবে।
২২. iBAS++ সংক্রান্ত সৃষ্ট জটিলতা দ্রুত নিরসন করতে হবে।
২৩.এলএম, এএলএম, ইঞ্জিনিয়ারিং স্টাফ, অফিস সহকারী, মেডিকেল স্টাফ, ট্রেড এ্যাপ্রেন্টিস, অফিস সহায়ক, টিটিই, গার্ড, কন্ট্রোল কর্মচারী ও কেবিন মাস্টারদের ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ করতে হবে।