প্রশ্ন ০১. শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যাল কী এবং কোথায় অবস্থিত?
উত্তর: শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যাল একটি আপীল আদালত। এটি একমাত্র শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যাল; যা রাজধানী ঢাকার কাকরাইলের আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম রোডে অবস্থিত। শ্রম আদালতের রায়, আদেশ ইত্যাদির বিরুদ্ধে আপীল সংক্রান্ত বিধান ২১৭ ধারায় উল্লেখ আছে। এই আইন সাপেক্ষে, শ্রম আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোনো রায়, সিদ্ধান্ত, রোয়েদাদ বা দণ্ডের বিরুদ্ধে কোন সংক্ষুব্ধ পক্ষ, রায় প্রদানের ষাট দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে আপীল দায়ের করতে পারবে এবং উক্তরূপ আপীলের ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হবে।
প্রশ্ন: ০২. শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যাল কীভাবে গঠিত হয় এবং আপীল ট্রাইবুন্যাল কী ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে?
উত্তর: শ্রম আইনের ২১৮ নং ধারায় শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল কীভাবে গঠিত হবে; সে সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। “(১) এই আইনের উদ্দেশ্যে, বাংলাদেশে একটি শ্রম আপীল ট্রাইব্যুনাল থাকিবে, যাহা একজন চেয়ারম্যান সমন্বয়ে গঠিত হইবে, অথবা সরকার উপযুক্ত বিবেচনা করিলে একজন চেয়ারম্যান এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত সংখ্যক সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হইবে।
(২) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান এবং সদস্যগণ, যদি থাকেন, সরকার কর্তৃক, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, নিযুক্ত হইবেন এবং তাহাদের চাকুরীর শর্তাবলী সরকার কর্তৃক নির্ধারিত হইবে।
(৩) ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান সুপ্রিমকোর্টের কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক অথবা অতিরিক্ত বিচারক হইবেন এবং উহার কোন সদস্য সুপ্রিমকোর্টের কর্মরত অথবা অবসরপ্রাপ্ত বিচারক অথবা অতিরিক্ত বিচারক হইবেন; অথবা অন্যুন তিন বৎসর কর্মরত আছেন বা ছিলেন এমন কোন জেলা জজ হইবেন।
(৪) যদি চেয়ারম্যান কোন কারণে অনুপস্থিত থাকেন বা তাহার কার্যসম্পাদনে অপারগ হন, তাহা হইলে সদস্যগণ যদি থাকেন, এর মধ্যে যিনি জ্যেষ্ঠ তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করিবেন।
(৫) যে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনালের কোন সদস্য নিযুক্ত থাকেন সে ক্ষেত্রে চেয়ারম্যান, আদালতের কার্য সুচারুরূপে সম্পন্ন করিবার জন্য, প্রয়োজনীয় সংখ্যক বেঞ্চ গঠন করিতে পারিবেন এবং উক্তরূপ বেঞ্চ এক বা একাধিক সদস্য সমন্বয়ে অথবা চেয়ারম্যান এবং এক বা একাধিক সদস্য সমন্বয়ে গঠন করা যাইবে।
(১০) ট্রাইব্যুনাল আপীলে শ্রম আদালতের কোন রায়, সিদ্ধান্ত, রোয়েদাদ বা দণ্ডাদেশ বহাল রাখিতে, সংশোধন বা পরিবর্তন করিতে বা বাতিল করিতে পারিবে অথবা মামলাটি পুনরায় শুনানীর জন্য শ্রম আদালতে ফেরত পাঠাইতে পারিবে; এবং অন্যত্র ভিন্নরূপ কিছু না থাকিলে, ট্রাইব্যুনাল এই আইনের অধীন প্রদত্ত শ্রম আদালতের সকল ক্ষমতাও প্রয়োগ করিবে
(১১) ট্রাইব্যুনালের রায় আপিল দায়ের করিবার ৬০(ষাট) দিনের মধ্যে প্রদান করা হইবে।
(১১ক) উপ-ধারা (১১) এর বিধান সত্তে¡ও, ৬০ (ষাট) দিনের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে রায় প্রদান করা সম্ভব না হইলে, উপযুক্ত কারণ লিপিবদ্ধ করিয়া ট্রাইব্যুনাল পরবর্তী ৯০ (নববই) দিনের মধ্যে রায় প্রদান করিতে পারিবে।]
(১২) ট্রাইব্যুনাল উহার অথবা কোন শ্রম আদালতের অবমাননার জন্য শাস্তি দিতে পারিবে, যেন উহা সুপ্রীমকোর্টের একটি হাইকোর্ট বিভাগ।
(১৩) ট্রাইব্যুনাল যদি উপ-ধারা (১২) এর অধীন কোন ব্যক্তিকে জেলের আদেশ দেয়া অথবা দুইশত টাকার অধিক জরিমানা করে, তাহা হইলে উক্ত শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তি হাইকোর্ট বিভাগে আপীল দায়ের করিতে পারিবেন
(১৪) ট্রাইব্যুনাল স্বইচ্ছায় অথবা কোন পক্ষের দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে কোন মামলা এক শ্রম আদালত হইতে অন্য শ্রম আদালতে হস্তান্তর করিতে পারিবে।
(১৫) সকল শ্রম আদালতের উপর ট্রাইব্যুনালের তত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকিবে।”
প্রশ্ন: ০৩. কোন কোন আদেশের বিরুদ্ধে শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যাল আপীল করা যাবে?
উত্তর: শ্রম আইনের ১৭২ ধারায় শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যাল আপীলে আপীল সংক্রান্ত বিধান রাখা হয়েছে।
“(১) এই অধ্যায়ের অধীন প্রদত্ত শ্রম আদালতের নিম্নলিখিত আদেশের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আপীল করা যাইবে, যথাঃ-
(ক) ক্ষতিপূরণ হিসাবে থোক অর্থ রোয়েদাদের আদেশ, উহা মাসিক অর্থ পরিশোধ করিয়া হউক অথবা অন্যভাবে হউক, অথবা থোক অর্থ প্রদানের দাবী সম্পূর্র্র্ণ বা আংশিক না মঞ্জুরের আদেশ;
(খ) অর্থ পরিশোধ করতঃ মাসিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের দায় হইতে মুক্ত হওয়ার আবেদন প্রত্যাখানের আদেশ;
(গ) কোন মৃত শ্রমিকের পোষ্যগণের মধ্যে ক্ষতিপূরণের অর্থ বণ্টনের ব্যবস্থা সম্বলিত আদেশ, অথবা উক্তরূপ পোষ্য বলিয়া দাবীদার কোন ব্যক্তির ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দাবি না মঞ্জুরের আদেশ;
(ঘ) ধারা ১৬১ (২) এর অধীন ক্ষতিপূরণের কোন অর্থ দাবি মঞ্জুর বা না মঞ্জুরের আদেশ;
(ঙ) চুক্তির স্মারকলিপির রেজিস্ট্রিকরণ প্রত্যাখ্যান, অথবা উহার রেজিস্ট্রিকরণ অথবা উহার শর্তসাপেক্ষে রেজিস্ট্রিকরণের আদেশ; অথবা
(চ) ধারা ১৫৫ (৭) এর অধীন আদেশ।
(৫) এই ধারার অধীন আপীলের জন্য তামাদির মেয়াদ হইবে ষাট দিন।
(৬) তামাদী আইন, ১৯০৮ (১৯০৮ সনের ৯নং আইন) এর ধারা ৫ এর বিধান এই ধারার অধীন আপীলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হইবে।”
প্রশ্ন: ০৪. শ্রম আইনের কোন ধারায় আপীলের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে কতিপয় পরিশোধ স্থগিতকরণ করা যায়?
উত্তর: শ্রম আইনের ১৭৩ ধারায় আপীলের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে কতিপয় পরিশোধ স্থগিতকরণ করা যায়। যে ক্ষেত্রে কোন মালিক ধারা ১৭২ (১) (ক) এর অধীন কোন আপীল দায়ের করেন, সে ক্ষেত্রে শ্রম আদালত, আপীলের সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে, উহার নিকট জমাকৃত কোন অর্থ পরিশোধ স্থগিত রাখিতে পারিবে এবং ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিলে উহা অবশ্যই স্থগিত রাখিবে।
প্রশ্ন: ০৫. শ্রম আপীল ট্রাইবুন্যালে কী কী বিষয়ে আপীল চলবে না?
উত্তর: শ্রম আইনের ১৭২ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে, “পক্ষগণ কর্তৃক শ্রম আদালতের সিদ্ধান্ত মানিয়া চলিতে সম্মত হওয়ার ক্ষেত্রে অথবা পক্ষগণের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি কার্যকর করার জন্য শ্রম আদালত কর্তৃক প্রদত্ত কোন আদেশের বিরুদ্ধে আপীল চলিবে না।
(৩) মালিক কর্তৃক উপ-ধারা (১) (ক) এর অধীন কোন আপীল দায়ের করা যাইবে না যদি না আপীলের স্মারকলিপির সহিত শ্রম আদালত কর্তৃক প্রদত্ত এই মর্মে প্রত্যয়নপত্র থাকে যে, আপীলকারী উক্ত আদালতে সংশ্লিষ্ট আদেশের অধীন প্রদেয় অর্থ জমা দিয়াছেন।
(৪) কোন আদেশের বিরুদ্ধে কোন আপীল চলিবে না যদি না আপীলে কোন উল্লেখযোগ্য আইনগত প্রশ্ন জড়িত থাকে, এবং উপ-ধারা (১) (খ) এ উল্লিখিত কোন আদেশ ব্যতীত অন্য কোন আদেশের বিরুদ্ধে কোন আপীল চলিবে না, যদি না আপীলে বিরোধীয় অর্থের পরিমাণ অন্যূন এক হাজার টাকা হয়।”
প্রশ্ন: ০৬. শ্রম আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ধর্মঘট বা লক-আউট নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা আছে কতটুকু?
উত্তর: শ্রম আইনের ধারা ২২৬ (১) বলা হয়েছে, “যে ক্ষেত্রে কোন শিল্প বিরোধ অনুসারে কোন ধর্মঘট অথবা লক-আউট ইতিমধ্যে শুরু হইয়াছে এবং শ্রম আদালতে উক্ত শিল্প বিরোধ সম্পর্কে কোন দরখাস্ত পেশ করিবার সময় অথবা আদালত কর্তৃক উহা বিবেচনাকালে উক্ত ধর্মঘট বা লক-আউট অব্যাহত থাকে, সে ক্ষেত্রে শ্রম আদালত, লিখিত আদেশ দ্বারা, উক্ত ধর্মঘট বা লক-আউট চালাইয়া যাওয়া নিষিদ্ধ করিতে পারিবে।”
কেস স্ট্যাডি:
মোখলেছুর রহমান (ছদ্মনাম) নামের একজন হোটেল শ্রমিক চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে একটি মোকাদ্দমা দায়ের করেন। শ্রমিকের অভিযোগ গত ২৮/২/২০১৫ ইং তারিখে কোন কারণ ছাড়া টার্মিনেশন করে এবং কোন পাওনাদি দেয়নি। বকেয়া বেতনসহ পাওনাদি চাইতে গেলে টাকা না দিয়ে হুমকি দেয় এবং গালিগালাজ করে। প্রথমে উক্ত শ্রমিক বাংলাদেশ শ্রম আইনের বিধান মোতাবেক পাওনা পরিশোধের জন্য গত ১১/৩/২০১৫ ইং তারিখে হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বরাবর একটি অনুযোগ পত্র প্রেরণ করেন এবং উক্ত অনুযোগ পত্রের অনুলিপি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং যুগ্ম পরিচালক, কল কারখানা পরিদর্শক বরাবর প্রেরণ করেন। কিন্তু এক মাসের মধ্যে অনুযোগ পত্রের জবাব বা প্রতিকার না পেয়ে বিগত ২০/৪/২০১৫ ইং তারিখে চট্ট্গ্রাম শ্রম আদালতে পাওনাদি চেয়ে মোকাদ্দমা দায়ের করেন। বিজ্ঞ শ্রম আদালত দীর্ঘ শুনানির পর বিগত ২৬/২/২০১৯ ইং তারিখে শ্রমিকের পক্ষে রায় ঘোষণা করেন। রায় হচ্ছে-ফেব্রæয়ারি মাসের বেতন, শ্রম আইনের ২৬(১) ধারায় টার্মিনেশন বাবদ চার মাসের নোটিশ পে অর্থাৎ চারটি বেসিক, শ্রম আইনের ২৬(৪) ধারায় সার্ভিস বেনিফিট বা ক্ষতিপূরণ অর্থাৎ পনের বছরের চাকরির পনের মাসের বেসিক বেতন, শ্রম আইনের ১১৭(৫) ধারায় ৬০ দিনের অর্জিত ছুটির টাকা। সর্ব সাকুল্যে বিজ্ঞ শ্রম আদালত হোটেল শ্রমিক মোখলেছুর রহমানকে ৩০ দিনের মধ্যে ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা প্রদান করতে হোটেলের মালিককে নির্দেশ প্রদান করেন। মালিক পক্ষ ২০ দিনের মধ্যে পাওনাদি না দিলে হোটেল শ্রমিক মোখলেছুর রহমান বিজ্ঞ আদালতের রায় বাস্তবায়নের জন্য বিগত ১৪/৩/২০১৯ ইং তারিখে পত্র প্রেরণ করেন। মালিক পক্ষ শ্রমিকের পাওনাদি না দিয়ে রায়ের ঘোষিত ১ লক্ষ ৬৫ হাজার টাকা চট্টগ্রাম শ্রম আদালতে জমা করে রশিদ নিয়ে শ্রম আপীল ট্রাইবুনালে আপীল করেন। দীর্ঘদিন আপীল ঝুলে থাকার পর বিগত ১৭/৫/২০২৩ ইং তারিখে আপীল খারিজ করে দিয়ে চট্টগ্রাম শ্রম আদালতের রায় বহাল রাখেন। হোটেল শ্রমিক মোখলেছুর রহমান বিজ্ঞ চট্টগ্রাম শ্রম আদালত হতে সমুদায় টাকা উঠিয়ে নিতে পারবেন।
লেখক: এডভোকেট আলমগীর হোসাইন, নির্বাহী সম্পাদক, দ্বি-মাসিক শ্রমিক বার্তা।