তৃতীয় দফায় নির্বাচনে জয়ের পর এরদোগানের দুই দশকের ক্ষমতার পরবর্তী মেয়াদ শুরু হয়েছে। এই মেয়াদ যে তুর্কি প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র নায়কদের একজন হয়ে ওঠা এরদোগানের জন্য অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের হবে সেটি নতুন মেয়াদের শুরুতেই বোঝা যাচ্ছে। এই প্রতিবেদন লেখার সময়টাতে তুরস্কে দুটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এর একটি হলো সমকামীদের সংগঠন এলজিবিটিকিউ দেশের গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ পালন করছে। অন্যটি হলো ন্যাটোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সম্মেলনে উপস্থাপিত মানচিত্রে সাইপ্রাসকে গ্রীসের অংশ দেখানোর প্রতিবাদে তুরস্ক এই কৌশলপত্র অনুমোদনে ভেটো প্রদান করে। দুটি ঘটনাই তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমটিতে বর্তমান শাসনের বিরুদ্ধে এক ধরনের সামাজিক প্রতিরোধ তৈরির পরিকল্পনার সংশ্লিষ্ট রয়েছে বলে মনে হয়। এর বাইরে দেশের স্কুলগুলোতে নৈতিক শিক্ষার জন্য ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্তের বিষয়টিও প্রধান বিরোধী দল সিএইচপির তীব্র বিরোধিতার মুখে পড়েছে। দেশটির জন্য নতুন সংবিধান তৈরির উদ্যোগও চ্যালেঞ্জহীন যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
এরদোগান সম্ভবত তার এই মেয়াদে তুর্কি রাষ্ট্রের দীর্ঘ মেয়াদী দিক নির্দেশনার ভিত্তি দিতে চাইছেন। যার অংশ হিসাবেই তিনি শিক্ষার কারিকুলাম এবং সংবিধান লেখার কাজে হাত দিযেছেন। দুটির কোনোটাই তার জন্য সহজ হবে না। তবে এরদোগান তার পূর্বেকার দুই দশকের শাসনে তুরস্ককে আঞ্চলিকভাবে ক্ষমতাধর এবং অন্যের নির্দেশে চলার অবস্থা থেকে তুলে এনেছেন। অভ্যন্তরীণভাবে সামরিক ও বিচার প্রতিষ্ঠান আগের মতো ধর্মহীন উগ্র সেক্যুলার ব্যবস্থার রক্ষকের ভূমিকায় নেই। তাঁর সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হলো তুরস্ককে নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার ঝুঁকি থেকে মুক্ত করে একটি ক্ষমতাধর মুসলিম বলয় তৈরি করার যে স্বপ্ন তিনি দেখেন সেটির বাস্তবায়ন করা।
পশ্চিমের সাথে দূরত্ব
তৃতীয় মেয়াদে এরদোগান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর যে সব ইস্যু সামনে রয়েছে তাতে পশ্চিম বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সাথে কিছুটা দূরত্ব তৈরি হতে পারে, যার সূচনা ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের কৌশলগত সম্মেলনে দেখা গেছে। ইউড্র ইউলসনের জেমস এফ. জেফরি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘এরদোগানের নেতৃত্ব সম্ভবত পশ্চিমাদের বিরক্ত করতে থাকবে, তবে ওয়াশিংটন যদি তুরস্কের নিকটবর্তী বৈদেশিক উদ্বেগগুলি বোঝার চেষ্টা করে তবে তারা সম্পর্কের উত্তেজনা কাটিয়ে উঠবে।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কঠিন প্রতিদ্ব›িদ্বতার মুখে রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের অভ‚তপূর্ব তৃতীয় মেয়াদে জয় এবং সে সাথে তুর্কি সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে মনে হয় তিনি আরও ৫ বছর তুরস্কের নেতা থাকবেন এবং পশ্চিমের পক্ষে আগামী কয়েক বছর ধরে তার নীতি কিছু ক্ষেত্রে বিপত্তিকর হয়ে থাকতে পারে। তবে তুরস্ক ও তার শক্তিশালী জি-২০ আকারের অর্থনীতি, কূটনৈতিক দক্ষতা, সামরিক শক্তি এবং সর্বোপরি ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, এই বিপজ্জনক সময়ে পশ্চিমের জন্য একেবারে অপরিহার্য।
বাইডেন প্রশাসন তার অক্টোবর ২০২২ এ ঘোষিত জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে বলেছে, ‘আমরা আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার ভবিষ্যত গঠনের জন্য একটি কৌশলগত প্রতিযোগিতার মধ্যে রয়েছি,’ এবং ‘আমরা যে কোনও দেশের সাথে অংশীদার হব যে দেশটি আমাদের এই মৌলিক বিশ্বাস ভাগ করে নেয় যে নিয়ম-ভিত্তিক আদেশ বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির ভিত্তি হতে হবে।’ তুরস্ক সেই ‘যেকোনো জাতির’ মানদণ্ড পূরণ করে। যদিও সতর্কতাসহ এবং তার গুরুত্ব বিবেচনা করে, এই কৌশলগত প্রতিযোগিতায় দেশটির সাথে কার্যকরভাবে সম্পর্ক নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ।
এখান থেকে মনে হয় এরদোগান ও বাইডেন প্রশাসন পরষ্পরিক স্বার্থে বিরোধ ও দূরত্বকে একপাশে সরিয়ে তারা একসাথে কাজ করবেন। যদিও ইউক্রেন ইস্যুর মতো দুই পক্ষ কিছু ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ থেকে আবার কিছু ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার সম্ভাবনা রয়েছে। তুরস্কের যে ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান এবং ইউরোপের সাথে অর্থনৈতিক নির্ভরতা তৈরি হয়ে আছে তাতে কেউ কাউকে ছাড়তে পারবে না। আবার রাশিয়ার উপর তুরস্কের অর্থনৈতিক নির্ভরতা এবং তুর্কি রাষ্ট্র সমূহের যে বলয় রয়েছে তাতে তুর্ক স্বার্থ কেন্দ্রিক নানা কার্যক্রম ন্যাটো বা পশ্চিমারা পুরোপুরি পছন্দ করতে পারবে না। তুরস্কের পক্ষেও অভিন্ন ন্যাটো দেশ হওয়া সত্তে¡ও আঙ্কারাকে অব্যাহতভাবে সন্দেহের চোখে দেখে গ্রীসের প্রতি পক্ষপাতিত্ব মেনে নেওয়া কঠিন। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোন কোন দেশ পিকেকে এবং এর সাথে জড়িতদের যেভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসেছে সেটিকে তুরস্ক মেনে নিতে পারবে না।
এরপরও জেমস এফ. জেফরি মনে করেন, এরদোগানের সাথে জড়িত হওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তবে সবচেয়ে কঠিন পদক্ষেপ। তিনি, বেশিরভাগ তুর্কির মতো, গত বিশ বছরে আমেরিকান এবং ইউরোপীয় আচরণের প্রতি গভীর ও ন্যায়সঙ্গত (কিছু মাত্রায়) বিরক্তি পোষণ করেন। কিন্তু অনেক তুর্কিদের থেকে ভিন্ন এরদোগান সাংস্কৃতিক ও আবেগগত দিক থেকে পশ্চিমের প্রতি অনুরাগী হবার চেয়ে অধিক বৈরি বলে মনে হয়।
তবে এর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো এরদোগান সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে লেনদেনে বিশ্বাসী। ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলস আশা করে যে ‘অধীনস্থ’ অংশীদাররা লেনদেনমূলক না হয়ে অন্তত প্রকাশ্যে অনুগত হবে, যা এরদোগানের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। এতদসত্ত্বেও, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এখন এতটাই বিপজ্জনক, এবং তুরস্ক এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাইডেন প্রশাসনকে এরদোগানের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। এরদোগানের বিজয়ের পর ৩০ মে এরদোগানের কাছে বাইডেনের আহ্বান ছিল এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রথম পদক্ষেপ।
তুরস্কের সীমান্তবর্তী কিছু সমস্যা দীর্ঘকাল ধরে তুরস্ককে বারবার ওয়াশিংটন এবং ইইউ-এর সাথে দ্বন্দ্বে নিয়ে এসেছে। তদুপরি, তুরস্ক ও পশ্চিমের দীর্ঘমেয়াদী মানসিকতার কারণে এসব ক্ষেত্রে বিদ্যমান উত্তেজনার সমাধান বা পরিচালনা করা বাধাগ্রস্ত হতে দেখা যায়। আঙ্কারার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য পশ্চিমাদের অন্তত সেই বিষয়গুলোয় তুর্কি স্বার্থ বুঝতে হবে এবং কাটিয়ে উঠতে হবে আবদ্ধ মানসিকতা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও তুরস্কের নিরাপত্তা সিদ্ধান্তের উপর এ জোট বেশি নির্ভরশীল। তবে, গ্রীস ও সাইপ্রাস ইস্যু সমাধানের মতো কূটনৈতিক জটিলতা নিরসনের জন্য ওয়াশিংটনের নেতৃত্বের প্রয়োজন হবে।
পিকেকে সংকট
তুরস্ক অস্তিত্বগতভাবে রাশিয়ান সম্প্রসারণবাদের বিরোধী। ২০২০ সাল থেকে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়া, লিবিয়া, ককেশাস এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইউক্রেনে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার কর্মকাণ্ডে এটি দেখা গেছে। তবে তুরস্কেরও জটিল আগ্রহ ও দুর্বলতা রয়েছে, যার কারণে মস্কোকে ডিল করতে বিশেষ যত্ম নেওয়ার প্রয়োজন হয়। বাস্তবতা হলো রাশিয়ার সাথে তুরস্কের দ্বিমুখী বাণিজ্য ৬০ বিলিয়ন ডলারের বেশি, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিগুণ। এর মধ্যে আবার ৪০-৫০ শতাংশ গ্যাস আমদানি রয়েছে যা তুরস্কের শক্তির প্রধান উৎস।
অধিকন্তু, রাশিয়া ও ইরানের তুরস্কের সবচেয়ে বড়ো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা উদ্বেগ পিকেকেকে কাজে লাগানোর সক্ষমতা রয়েছে। সুতরাং, রাশিয়া নীতিতে, ন্যাটোর দৃষ্টিকোণ থেকে তুর্কি গ্যাস মাত্র দুই-তৃতীয়াংশ পূর্ণ। কিন্তু তা পুরোপুরি পূরণ করার চেষ্টা করা, তুরস্কের রাশিয়ার উপর ন্যাটো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার দাবি অথবা এস-৪০০ ক্রয় প্রত্যাহার করার চাপ, সামান্য লাভের জন্য ক্রমাগত মাথাব্যথা তৈরি করবে।
পিকেকে, ১৯৮৪ সাল থেকে সক্রিয় একটি তুর্কি-কুর্দি সন্ত্রাসবাদী বিদ্রোহী আন্দোলন। এটি সবচেয়ে জটিল তুর্কি সমস্যা। প্রতিবেশী দেশগুলির বিপরীতে কুর্দিরা সীমান্ত অঞ্চলে কেন্দ্রীভ‚ত হয়, তুরস্কের বৃহৎ কুর্দি জনসংখ্যার বেশিরভাগই (সামগ্রিকভাবে ২০ শতাংশ পর্যন্ত) দেশটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তারা বাকি জনসংখ্যার সাথে একীভ‚ত হয়ে আছে। অধিকন্তু, ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্ত জুড়ে পিকেকে-এর সামরিক বাহিনী রয়েছে, যা তুরস্কের জন্য হুমকি বাড়িয়ে চলেছে। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই ইস্যুটির প্রাধান্যের জন্য কিছুটা বিড়ম্বনা রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে পিকেকেকে একটি সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং এর বিরুদ্ধে আঙ্কারাকে সহায়তা করেছে। কিন্তু ২০১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ার পিকেকের সামরিক শাখা ওয়াইপিজিকে (ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে তার পিকেকে লিঙ্কগুলিকে ছদ্মবেশ ধারণ করার জন্য পরে সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস বা এসডিএফ নামকরণ করে) সমর্থন করার পরে এই ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসে। এটি প্রাথমিকভাবে একটি বড়ো সমস্যা ছিল না; আঙ্কারা তখন পিকেকে-এর সাথে যুদ্ধবিরতি করেছিল এবং ওয়াইপিজি-সম্পর্কিত সিরিয়ান কুর্দিদের সাথেও সংলাপ চালিয়েছিল। পরে সেটি এক পর্যায়ে জটিল রূপ নেয়।
উত্তর-পূর্ব সিরিয়া
২০১৫-১৬ সালে সিরিয়ার স্থিতাবস্থা বেশ খানিকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। তুরস্কের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে পিকেকে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দেয় এবং পিকেকে-বিরোধী অবস্থান সরকার আরও কঠোর করে। এরমধ্যে, ইসলামিক স্টেটের ইউফ্রেটিস শক্তিশালী ঘাঁটিগুলিকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ১ লক্ষের শক্তিশালী বাহিনীকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য এসডিএফকে সজ্জিত করে আমেরিকানরা। এই উচ্চাকাক্সক্ষা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সিরিয়ার ২০ শতাংশ এলাকা এবং লক্ষ লক্ষ সিরীয়ের ভূমি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়। এটি তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উত্তেজনা সৃষ্টি করে। আমেরিকানরা প্রতিশ্রুতি দেয় যে এসডিএফ-কে সমর্থন করা হবে শুধুমাত্র কৌশলগত, অস্থায়ী এবং লেনদেনমূলকভাবে। কিন্তু তুর্কিরা সেই বয়ান মেনে নেয়নি।
তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন এবং পরবর্তীতে সেক্রেটারি অফ স্টেট মাইক পম্পেওর প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও, ওয়াশিংটন এসডিএফকে ইউফ্রেটিস পেরিয়ে মানবিজ শহর থেকে পশ্চিমে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেনি। বরং, ২০১৮ সালে ইসলামিক স্টেট পরাজিত হওয়ার পরে এবং তুর্কি সীমান্তে আমেরিকান সৈন্যদের অবস্থান করার পর এটি ২০১৮ সালে এসডিএফকে সশস্ত্র করা শুরু করে। এটি দু’দেশের সম্পর্র্কে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। পরে একপর্যায়ে তুরস্ক একটি বাফার জোন প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
কুর্দি ইস্যুটি তুরস্কের জন্য অখণ্ডতার ইস্যু এবং এ নিয়ে সমঝোতার কোন সুযোগ দেশটির নেই। এই ইস্যুটি নিয়ে টানাপোড়েনের মধ্যে তুরস্কে ২০১৬ সালের অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে। এটি তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্র দুই দেশের মধ্যে আরও অবিশ্বাস তৈরি করে। আর এবারের তুরস্কের নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রশাসন সরাসরি বিরোধী পক্ষকে সমর্থন করে। এরপর যদি বাইডেন প্রশাসন এরদোগানের সাথে কাজ করতে চায় তাহলে স্থিতি ফিরতে পারে। সুইডেনের ন্যাটোভুক্তিসহ অন্য যেসব বিরোধপূর্ণ ইস্যু রয়েছে তারও সমাধান হতে পারে। সেটি না হয়ে গ্রীসকে এজিয়ান সাগর ও সাইপ্রাস ইস্যুতে ইউরোপ আমেরিকা এক তরফা মদদ দিতে থাকলে দু’পক্ষের দূরত্ব বাড়বে।
সাইপ্রাস ও ককেশাস
গ্রীক-তুর্কি উত্তেজনার ঐতিহাসিক শিকড় রয়েছে, তবে বর্তমানে ১৯১৪ এবং ১৯৪৮ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক চুক্তি এবং ১৯৬০ সালের লন্ডন-জুরিখ চুক্তি সাইপ্রাসের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গ্রীক এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জকে প্রদত্ত সার্বভৌমত্বের উপর নির্ভর করে।
তবে এই চুক্তিগুলি এজিয়ান দ্বীপপুঞ্জের সামরিকীকরণ এবং সাইপ্রিয়ট তুর্কি সংখ্যালঘু অধিকারের মতো তুর্কি স্বার্থ রক্ষা করেছিল। কিন্তু ১৯৭০ এর দশক থেকে মূল ভূখণ্ড ও গ্রীক সাইপ্রিয়টরা সেই আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার উপাদানগুলিকে চ্যালেঞ্জ করে তুর্কি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তুরস্ক গ্রিসের সাথে সাইপ্রাসের এক হয়ে যাওয়া রোধ করার জন্য ১৯৭৪ সালের সাইপ্রাস আক্রমণ করে এবং এজিয়ানে চলাচলের বিমান ও নৌ স্বাধীনতা রয়েছে। সমুদ্রতটের গ্যাসের অধিকার নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে।
ককেশাসে রয়েছে তুরস্কের বিশেষ স্বার্থ, যেখানে জাতিগত, ভাষাগত, ভূ-কৌশলগত এবং শক্তি সম্পর্ক থাকা আজারবাইজানকে সমর্থন করছে। আবার এখানে রয়েছে রাশিয়া ও ইরানের স্বার্থ এবং তারা মোটা দাগে সমর্থন করে আর্মেনিয়াকে। আঙ্কারা চাচ্ছে আর্মেনিয়ার সাথে বিরোধ মিটিয়ে এই অঞ্চলে শান্তি ফিরিয়ে আনতে। তবে এজন্য রাশিয়া ও ইরানের বিশেষ সমর্থন প্রয়োজন।
বুঝুন এবং সঙ্কট কাটিয়ে উঠুন
তুর্কি দৃষ্টিভঙ্গি বোঝার জন্য ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসের ক্ষমতা বিভিন্ন লবি, জাতিগত আর্মেনিয়ান, গ্রীক ও কুর্দি গোষ্ঠী থেকে শুরু করে এরদোগান-বিরোধী নব্য-রক্ষণশীল, প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের এস-৪০০ ক্রয় এবং এই পদক্ষেপে বিক্ষুব্ধ হয়ে বিধিনিষেধ আরোপের বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয যথাযথভাবে ডিল না করার কারণে তুর্কি জনমত অনেক বেশি পশ্চিমা বিরোধী হয়ে উঠেছে, সে সাথে নমনীয়তা সীমিত করেছে সরকারের। ওয়াশিংটন এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে পারলেই সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অগ্রগতি টিকিয়ে রাখা যাবে।
এমনকি ১৯৯০-এর দশকে তুরগুত ওজালের অধীনে অথবা এরদোগান প্রাথমিকভাবে আনান সাইপ্রাস পরিকল্পনা গ্রহণ করে যখন তুরস্ক পশ্চিমা অনুরোধে সাড়া দিয়েছে তখনও কোনও কোনও বিষয়ে পাশ্চাত্য রবি আত্মসমর্পণের দাবিতে অবিচল থাকে। এর প্রতিক্রিয়ায়, তুর্কি জনমত অনেক বেশি পশ্চিমা বিরোধী হয়ে উঠে, এটি সরকারের নমনীয়তা সীমিত করে। ওয়াশিংটন এই বাধাগুলো অতিক্রম করতে পারলেই সুনির্দিষ্ট বিষয়ে অগ্রগতি টিকিয়ে রাখা যাবে। সৌভাগ্যবশত, এরদোগানের নির্বাচনী বিজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের জন্য নতুনভাবে শুরু একটি সুযোগও এনে দেয়। সর্বোচ্চ স্তরের এনগেজমেন্টের বাইরে, ওয়াশিংটন ও আঙ্কারার দ্রুত সংকট জয়ের জন্য কাজ করা উচিত যা এখন সম্ভব। যার মধ্যে রয়েছে সুইডেনের ন্যাটোতে যোগদান, এফ-১৬ বিক্রয়, পিকেকে এর সাথে যুদ্ধবিরতি, গ্রীকদের সাথে উত্তেজনা প্রশমন এবং সেক্রেটারি অফ স্টেট টনি ব্লিঙ্কেন দ্বারা প্রচারিত সাম্প্রতিক আর্মেনিয়ান-আজেরি সমঝোতার অগ্রগতি অর্জন করা।
নীরব পরিবর্তন
তুরস্কে গত ২০ বছরে যে নীরব পরিবর্তন এরদোগান নিয়ে এসেছেন তাতে বাইরের নির্দেশনায় দেশটি চলবে বলে মনে হয় না। প্রতিরক্ষা শিল্প থেকে শুরু করে সার্বিক অর্থনীতির যে অগ্রগতি গত ২০ বছরে হয়েছে তাতে দেশটি আঞ্চলিক শক্তির স্থান এর মধ্যে নিয়ে নিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও আফ্রিকা ও মধ্য এশিয়ায় তুরস্কের প্রভাব বেড়েছে অনেক। সৌদি আরব মিসর আমিরাতের সাথে সমঝোতা করে আঞ্চলিক বিরোধ এর মধ্যে অনেকখানি মিটিয়ে ফেলেছে। এই বাস্তবতার কারণে তুরস্ককে চাইলেই উপেক্ষা করতে পারবে না। এক্ষেত্রে ঐতিহাসিক শত্রুতার পরও তুরস্ক রাশিয়া ও চীনের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের পথে এগুতে পারে। ন্যাটো থেকে নিজের ইচ্ছায় তুরস্ক বিদায় নেবে এমনটিও মনে হয় না।
তুরস্ক যেভাবে উসমানীয় খেলাফতের ঐতিহ্যের পথ ধরে এগুচ্ছে তাতে নতুন করে খেলাফত হয়তো ফিরে আসবে না। তবে এই অঞ্চলের মুসলিম দেশগুলোর একটি অভিন্ন ইউনিয়ন তৈরি হতে পারে। এক্ষেত্রে এরদোগান তুর্কি শতাব্দী শুরুর যে ঘোষণা দিয়েছেন তা মুসলিম দুনিয়ার জন্য একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হিসাবে গণ্য হতে পারে। এই লক্ষ্য অর্জনই হবে এরদোগানের পরবর্তী লড়াই।
লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক