আম একটি লোভনীয় ফল। আমের মৌসুমে এদেশের মানুষ অন্য এক আমেজে প্রকৃতির সাথে মিশে যায়। মহান প্রভুর দেওয়া প্রকৃতির এক সুস্বাদু, সুন্দর, সুগন্ধময় ও পুষ্টিমানে সমৃদ্ধ ফল আম। আম আমাদের জাতীয় ফল না হলেও আমগাছ আমাদের জাতীয় বৃক্ষ, আর আমকে বলা হয় ফলের রাজা। ভারত, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। আমাদের দেশের প্রায় সব এলাকায় কমবেশি আম জন্মালেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে বাণিজ্যিকভাবে উন্নতমানের আম উৎপন্ন হয়। অবশ্য সারা দেশে উৎপাদিত আমের প্রায় এক তৃতীয়াংশ আমই উৎপন্ন হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জে। এজন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জকে আমের রাজধানীও বলা হয়।
প্রসঙ্গত বলতেই হয় যে, সোনালী আঁশ পাটের সোনালী যুগ নেই। চিংড়ি রপ্তানিতেও ধরা খেয়েছি। তবে গার্মেন্টস টেক্সটাইল পণ্য, ঔষধ রপ্তানিতে সাফল্য ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। কিন্তু সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যেতে পারে আম শিল্প, আম বাণিজ্য। বিদেশে শুধু আম এবং আমের জুস রপ্তানি করে পাল্টে ফেলা যেতে পারে দেশের অর্থনীতির চাকা। সৌদি আরবের খেজুর যেমন গোটা বিশ্বে রাজত্ব করছে, বাংলাদেশের আম বিশ্ববাজারে তেমন জায়গা করে নিতে পারে। শুধু তাই নয়, দেশের মধ্যেও আম নিয়ে চলছে হাজার হাজার মানুষের কর্মযজ্ঞ। আমচাষি, পাইকার, ব্যাপারী, হাটের ইজারদার, আড়তদার, ট্রাকের মালিক, ড্রাইভার, কুরিয়ার সার্ভিস, ট্রেনের কুলি, আম বাগানের কর্মী, মালিক, উদ্যোক্তা, সবাই মহাব্যস্ত। এমনকি আম সরবরাহের জন্য বাঁশের-বেতের, প্লাষ্টিকের টুকরি, ক্যারেট, চটের বস্তা, বাগানের কার্টুন তৈরি ও বিক্রেতারা আম নিয়ে এখন মহাব্যস্ত সময় পার করছেন।
বাংলাদেশে উত্তরের জেলাগুলোতে কৃষক পর্যায়ে যে আমের উৎপাদন হয়, বাণিজ্যিকভাবে সেটার উৎপাদন বাড়িয়ে পরিকল্পিতভাাবে রপ্তানি এবং আমের জুসসহ আমজাত পণ্য রপ্তানি করে প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকা রপ্তানি খাতে আয় করা যেতে পারে। এজন্য প্রয়োজন শুধু রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা। বিশেষজ্ঞদের মতে, উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে যে পরিমাণ আমের ফলন হয়, তা সুচারুভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং প্রক্রিয়াজাত করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নবদিগন্তের পথের উন্মেচন হবে। পাশাপাশি সারা বিশ্বে আমের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের মাধ্যমে জানা গেছে যে প্রতি বছর আমের মৌসুমে এ জেলার ৮ থেকে ১০ লক্ষ লোক আমগাছ পরিচর্যা, বাগান পরিষ্কার রাখা, আম সংগ্রহ, বিক্রি ও পরিবহন ইত্যাদি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রতিবছর এ জেলা থেকে প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ কোটি টাকার আম বিক্রি উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮ম স্থানে রয়েছে। তবে বিশ্বের আম রপ্তানিকারক ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো স্থান নেই। কৃষি বিজ্ঞানীরা এজন্য বেশকিছু বিষয়কে দায়ী করেছেন। যেমন আমের মুকুল আসার পর থেকেই আম গাছের কিছু নিয়মতান্ত্রিক পরিচর্যার প্রয়োজন হয়, যা সবারই মেনে চলা উচিত। আম গবেষক ও কৃষি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে এবং তাদের অনুমোদিত পদ্ধতিতে ঝুঁকিমুক্ত ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন সম্ভব।
তবে বাংলাদেশে কী পরিমাণ জমি এবং ওই জমিতে কী পরিমাণ আম উৎপাদিত হয়, তার সঠিক তথ্য জানা গেলে বাংলাদেশের অবস্থান আট থেকে আরো ওপরে উঠে আসতে পারে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। বাংলাদেশে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর ২৭ হাজার হেক্টর জমি থেকে ৮ লাখ ৮৯ হাজার ১৭৬ মেট্রিকটন আম উৎপাদিত হয় বলে জানানো হয়েছে; কিন্তু বেশ কয়েক জন কৃষিবিজ্ঞানী ও আম গবেষক এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। কারণ মাঠপর্যায়ে ঘুরে দেখা গেছে বাংলাদেশের চাষাবাদের এলাকাটা আরও বেশি। অন্য আরেক তথ্যানুযায়ী চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২৪ হাজার ২৬০ হেক্টর, রাজশাহীতে ১৬ হাজার ৫১৯ হেক্টর। নাটোরে ৪ হাজার ১০০ হেক্টর ও নওগাঁয় ৯ হাজার ১৪৬ হেক্টর জমিতে আম চাষ হয়। এছাড়া দেশের অন্যান্য স্থানেও প্রচুর আম চাষ হচ্ছে। সে হিসেবে সঠিক পরিসংখ্যান হলে দেখা যাবে যে, সারাদেশে প্রায় ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ হেক্টর জমিতে আম চাষ হচ্ছে এবং এই পরিমাণ জমিতে উৎপাদিত আম হিসাব করলে উৎপাদনের পরিমাণও বেড়ে যাবে। সবকিছু মিলিয়ে যদি প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করা হয়, তাহলে আম উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান আরও উপরে উঠে আসবে। এই অবস্থান পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের আমের চাষাবাদের প্রতি উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে যাবে।
আম চাষিরা বলছেন, সৌদি আরবের মাটি যেমন খেজুর উৎপাদনের উপযোগী তেমনি বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ, নাটোর, রংপুরের মাটি আমের জন্য বিখ্যাত। জানা গেছে, দেশে প্রতি বছর ১ মিলিয়ন (১০ লাখ টন) আম উৎপাদন হয়। গত সেশনে দেশ থেকে ৩০০ টন আম রপ্তানি হয়েছে। আম উৎপাদনে দেশে নারীর বিপ্লব ঘটেছে। উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিত্যনতুন প্রযুক্তির প্রভাবে এখন বিপ্লব ঘটেছে। অথচ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিদেশে রপ্তানির ব্যাপারে পরিকল্পনার অভাবে প্রতি মৌসুমেই বিপুল পরিমাণ আম নষ্ট হয়।
রাজশাহী ব্যুরো জানায় যে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার আমের বামপার ফলন হয়েছে। মৌসুম জুড়ে খরাভাব বিরাজ করায় আমের আকার প্রমাণ সাইজের না হলেও স্বাদে মিষ্টতা বেশি। ফলে এবারের আম হয়েছে আরও বেশি স্বাদের। এবার রাজশাহী অঞ্চলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, নাটোরে আমের আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ৮৪ হাজার হেক্টর জমিতে সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিকটন আম উৎপাদনের। যার গড় বাজার মূল্য ৮ হাজার কোটি টাকা। বাস্তবে আমের বাগানের পরিধি বেড়েছে। নতুন বাগান হয়েছে, ফলনও বেড়েছে। বিশেষ করে ধান উৎপাদনকারী এলাকা নওগাঁ জেলায়। কৃষি বিভাগের মতে গত বছর জেলায় আম ২ লাখ ৭২ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছিল। এবার সেখানে সোয়া তিন লাখ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের আশা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে। সামনে আরও বিক্রি হবে। যার বাজারমূল্য দাঁড়াবে আড়াই হাজার কোটি টাকা, এমন প্রত্যাশা ব্যবসায়ীদের।
সম্প্রতি এক তথ্যে দেখা যায়, সারা বিশ্বে আম উৎপাদিত হয় ১ কোটি ৪২ লক্ষ টনের মতো। এর মধ্যে একমাত্র ভারতেই উৎপাদিত হয় ৯০ লক্ষ টনের মতো। আম উৎপাদনে বাংলাদেশ এক সময় ৪র্থ স্থানে ছিল কিন্তু গত শতাব্দীর শেষার্ধে ১০ম স্থানে অবস্থান করে। মেক্সিকো, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, পাকিস্তান, চীন প্রভৃতি দেশে এখন আম উৎপাদনে বাংলাদেশ অনেক ওপরে। সত্তর দশকের দিকে বাংলাদেশে আমের ফলন ছিল ৩ লাখ ৩৬ হাজার টন, আশির দশকের মাঝামাঝি তা কমে দাড়ায় ১ লক্ষ ৫৬ হাজার টনে।
যে সব এলাকায় বেশি আম উৎপাদিত হয়, এর মধ্যে আছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর এবং তিন পার্বত্য জেলা। এসব জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব অনেক বেশি। তাই পরিচর্যা করে আম উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য মোড়কজাত করতে ঢাকার শ্যামপুরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেখানে ডিএইর অধীনে যার নাম সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ।
বাংলাদেশে মাথাপিছু আম ব্যবহারের পরিমাণ ২ কেজিরও কম। অথচ ভারতে ১২ কেজি, পাকিস্তানে ৭ কেজি। অথচ বাংলাদেশে আম উৎপাদনে ঐতিহ্যবাহী অঞ্চল ছিল। এদেশে আম চাষে ব্যাপক প্রচার, প্রসার ও উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশে আজ থেকে ২ যুগ আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম গবেষণা কেন্দ্র (Mango Research Institute) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কিছু উন্নত জাতের আম বিদেশ থেকে এনে বাংলাদেশের আবহাওয়া উপযোগী করে চাষাবাদ করে তা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উৎপাদন বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন, মল্লিকা হাইব্রিড- ১০, আম্রপালি বারোমাসি, ফজলী, ক্ষীরসাপাতি, হিমসাগর, গোপালভোগ, মিসরিভোগ, বোম্বাই, কিষাণ, কোহিভুর, লক্ষণভোগ ও অন্যান্য জাতের আমের ফলন এদেশে ভালো হচ্ছে।
বাংলাদেশের উৎপাদিত আম বিদেশে যাবে এ লক্ষ্যে সম্প্রতি ৯৩০টি আম বাগানে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। জানা গেছে দেশের ৯৩০জন কৃষি উদ্যোক্তা এ মৌসুমে বিদেশে রপ্তানির জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় আম উৎপাদন অব্যাহত রেখেছেন। কাজটি হচ্ছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায়। দেশে এই প্রথম রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য উদ্যোক্তাদের সরকারিভাবে প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রকল্পের লক্ষ্য প্রাথমিক ভাবে ৯৩০ উদ্যোক্তাকে বেছে নেওয়া হলেও আগামী ৪ বছরের মধ্যে সংখ্যাটি ৮ হাজার ৪০০ জনে উন্নীত করা হবে। বাংলাদেশের আম তুলনামূলক যথেষ্ট সমৃদ্ধ। এজন্য বাংলাদেশের আমের চাহিদা বিশ্বব্যাপী। বিশেষ করে বিদেশে থাকা এক কোটি বাংলাদেশীর একটি বৃহৎ বাজার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাজ্য সৌদি আরব, ইতালী, কাতার ও কুয়েত।
কৃষি অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৭৫৭ মেট্রিক টন আম রপ্তানি হয়েছে, যা আগের বছর ছিল ৭৯১ টন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১২ লাখ টনের কিছু বেশি আম উৎপাদিত হয়।
বাংলাদেশ আম রপ্তানিকারক দেশের শীর্ষ তালিকায় নেই। ফলবাজার নিয়ে বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এক পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলছে সবচেয়ে বেশি আম রপ্তানিকারক দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তান রয়েছে ২০২২ সালে ভারত ১ লাখ ৭৩ হাজার টনের মতো আম রপ্তানি করেছে।
পাকিস্তানের রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৪১ হাজার টন। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করেছে মেক্সিকো-৪ লাখ ৬৮ হাজার টন। থাইল্যান্ডে রপ্তানি করেছে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার টন আম। রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালকের এক ভাষ্যমতে- বিদেশে আমাদের আমের বিরাট বাজার রয়েছে। এবার আমরা গত বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি অর্থাৎ, চার হাজার মেট্রিক টন আম রপ্তানি করতে চাই। সেজন্যই খামারী বা চাষী উদ্যোক্তাদের সাহায্য দেওয়া হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে আম রপ্তানিতে বেশকিছু মৌলিক অন্তরায় রয়েছে বলে গবেষকদের ধারণা। যার মধ্যে রয়েছে, দেশে পরিকল্পিতভাবে উত্তম কৃষি চর্চা অনুসরণ করে মান সম্মত নিরাপদ আম উৎপাদন করা হয় না। আম সংগ্রহের পর ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমদানিকারকদের সমন্বয়ের অভাব। আম সংগ্রহের পর আমের গুণগত মান বজায় রেখে যথাযথভাবে বাছাই (গ্রেডিং) ও মোড়কজাত করে শীতলীকরণ ব্যবস্থাসংবলিত বাহনের (কুলিং ভ্যান) মাধ্যমে পরিবহন করা হয় না। এছাড়া রপ্তানির জন্য আম উৎপাদনে যুক্ত উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের এসব সমস্যার বিষয়ে উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। আম চাষীদের কাছ থেকে আরও জানা গেছে যে, দেশের যে সব এলাকায় বেশি আম উৎপাদিত হয়, এর মধ্যে আছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর এবং তিন পার্বত্য জেলা। এসব জেলার সঙ্গে ঢাকার দূরত্ব অনেক বেশি। তাই পরিচর্যা করে আম উৎপাদন ও রপ্তানির জন্য মোড়কজাত করতে ঢাকার শ্যামপুরের উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। সেখানে ডিএইর অধীনে যার নাম সেন্ট্রাল প্যাকিং হাউজ। মূলত দূর থেকে আম এনে মান ধরে রাখা সম্ভব হয় না বলে মনে করেন রাজশাহী এলাকার আম চাষী ও উদ্যোক্তারা।
দেশের আম বিদেশে রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবলস অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্ট এক্সপোটার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির উপদেষ্টা দুটি সমস্যার কথা উল্লেখ করেন। আম বিদেশে পাঠানোর জন্য দরকারী উদ্ভিদ সঙ্গনিবোধ বা ফাইটো স্যানিটারী, সনদ পেতে দীর্ঘ সূত্রতা। আর উড়োজাহাজের ভাড়া বেশি। রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলায় গোপালভোগ, হিমসাগর, ল্যাংড়া, ফজলী, চোষা, ক্ষীরসাপাতি, আম্রপালিসহ বিভিন্ন আম চাষ হচ্ছে। রংপুরে চাষ হচ্ছে হাড়িভাঙ্গা নামের উন্নত জাতের সুস্বাদু আম। দেশের ভোক্তা চাহিদা মিটিয়ে এখন ব্যক্তি পর্যায়ে এসব আম বিদেশে যাচ্ছে। বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন সহ বিভিন্ন দেশে প্রতি বছর এক হাজার টনের বেশি আম রপ্তানি হচ্ছে। উন্নত এইসব দেশে ভারত পাকিস্তান মিয়ানমারের চেয়ে আমাদের দেশের আমের চাহিদা বেশি। বিদেশে বাংলাদেশের আমের বিপুল চাহিদার অন্যতম প্রধান কারণ বাংলাদেশের আম অন্য দেশের আমের চেয়ে অনেক বেশি সুস্বাদু। প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাশাপাশি বিদেশীদের কাছেও বাংলাদেশের আমের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে।
বাংলাদেশের আম মাটি ও জলবায়ু অঞ্চলভেদে বেশ ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। আর আম পাকার সময় ও আগে পরে হয়ে থাকে। গবেষণায় বলা হয়েছে, “এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে দেশের প্রধান আম উৎপাদনকারী এলাকাগুলোকে চারটি অঞ্চলে ভাগ করে এ গবেষণা সম্পন্ন করা হয়েছে। যেমন অঞ্চল ১. চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি অঞ্চল। অঞ্চল ২. যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, খুলনা। অঞ্চল ৩. নাটোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং অঞ্চল ৪. নওগাঁ, রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়।
এসব অঞ্চলে অঅম উৎপাদন ও সংগ্রহের ওপর প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত (মাটির উর্বরতা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত, তাপমাত্রা, সমুদ্র সমতল থেকে উচ্চতা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমাংস ও ভূ-উপগ্রহের তথ্য) সংগ্রহ করা হয়েছে। সব তথ্য উপাত্ত যথাযথ বিশ্লেষণের মাধ্যমে দেখা যায়। অঞ্চল-১ এ সবচেয়ে আগে পাকে আম। আর সবশেষে আম পাকে অঞ্চল-৪ এলাকায়।
এবার উৎপাদিত আমের পরিমাণ: কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে গত বছর দেশে ১ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ২৩ লাখ টন আম উৎপাদিত হয়েছিল। এবার তা বেড়ে ২ লাখ হেক্টর জমিতে ২৫ লাখ টন হতে পারে বলে মাঠ পর্যায়ের গবেষকদের ধারণা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আম হতে পারে নওগাঁ জেলায়। এরপরই রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা। এ দুটি জেলায় রয়েছে নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ আম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সাতক্ষীরার আম বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। প্রতি হেক্টর আমের ফলনের দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নওগাঁ জেলা। এ জেলায় প্রতি হেক্টরে ১৫ থেকে ১৮ টন আম হয়। কিন্তু আমের জন্য বিখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি হেক্টর জমিতে আম হয় ৮ থেকে ৯ টন। দেশের অন্যান্য জেলাগুলোতে হেক্টর প্রতি আম হয় ৫ থেকে ১০ টন। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসেবে আম দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ফসল। পৃথিবীর মোট উৎপাদনের প্রায় ৮০ ভাগ আম এ অঞ্চলে হয়। সারা বিশ্বের মোট চাহিদার অধিকাংশ সরবরাহ হয় এশিয়া থেকে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আম উৎপাদনে যথেষ্ট এগিয়ে রয়েছে।
একের ভিতর-৪: সারা বিশ্বে যে আমের চাহিদা রয়েছে তার সিংহভাগ দক্ষিণ এশিয়ায় উৎপাদিত হয়। বর্তমান বাংলাদেশ থেকে ২৩টি দেশে আম নিয়মিত রপ্তানি করা হচ্ছে। এদেশের মানুষ যেমন চাষাবাদে সফলতা লাভ করছে, পাশাপাশি বিদেশে রপ্তানিতেও আশানুরূপ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। সেক্ষেত্রে এদেশের মানুষ গ্রামেগঞ্জে বাড়ির আশেপাশে, উঠানে, ঘরের কোণে ও পতিত জমিতেও পর্যাপ্ত আমের চাষ করে যাচ্ছে। এমন কোনও বাড়ি পাওয়া যাবে না যে সেখানে আমের চাষ নেই। শুধু তাই না, ইতোমধ্যে ছাদকৃষিতে দেশের সৌখিন চাষিরাও বাজিমাত করছে। সারাদেশের কথা না হয় বাদ দিলাম, রাজধানী ঢাকায় হাজার হাজার বাড়ির ছাদে সুস্বাদু আম চাষে যথেষ্ট সফলতা পাওয়া গেছে। এছাড়া অত্যকর্ষণীয় যে ব্যাপারটি সারা দেশে সাড়া পড়ে গেছে, সেটা হলো, দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এখন ব্রনাইকিং জাতের আম উৎপাদিত হচ্ছে। যার ১টির ওজন ৪-৫ কেজির বেশি। তাহলে এ আমের চাষাবাদও সে পরিমাণে সফলতা আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস। কারণ ৪/৫ কেজি আমের ব্যাপার অনেকটা আশ্চর্যও বটে!
আম চাষ ও শ্রম বাজার: আম চাষে এ দেশের হাজার হাজার মানুষ আম্রমুকুলের পরিচর্যা থেকে শুরু করে পাকা আম দেশে বিদেশে মানুষের দৌড়গোড়ায় পৌছানো পর্যন্ত যে শ্রমজীবী মানুষ এ পেশায় নিয়োজিত থাকে, তাদের সংখ্যা অনেক। কিন্তু এসব শ্রমজীবী মানুষ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া সময়ের চাহিদা অনুযায়ী কাজ করে অর্থ উপার্জন করে। আম চাষে মানুষ আরও আগ্রহী হওয়ার কারণে এ পেশায় শ্রমজীবী আম শ্রমিকের সংখ্যা বেশ মোটা অঙ্কের। যাদের আয় উপার্জনে কয়েক লক্ষ মানুষ হালাল উপার্জনের সুযোগ পেয়েছে।
আমরা জানি, আম চাষকে কেন্দ্র করে কৃষক, পাইকার, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের মধ্যে বেড়ে গেছে কর্মচাঞ্চল্যতা। আম বাগান কেনেবেচা, বাগান লীজ দেওয়া, বাগান পরিচর্যা, বাগান পাহাড়া দেওয়া, আম বাগান গাছ থেকে বিশেষ কায়দায় নামিয়ে আনা, আম, বহন করা, বস্তা, ঝুড়ি ও কার্টুনে যথাযথভবে প্যাকেটিং করা। তার সাথে ঝুড়ি, টুকরি, রশি, আনুসাঙ্গিক হরেক রকম ব্যবসা রয়েছে আমের সাথে। কেউ বা হোটেল রেস্তোরা বা মোবাইল খাবার রেষ্টুরেন্ট আবার কেউ বা আবাসিক হোটেল ব্যবসা, অনেকে আম সংরক্ষণের জন্য জুস কোম্পানির কছে বিক্রির সুযোগ নেওয়ার জন্য হিমসাগরের ব্যবসাও করে থাকে। শুধু পুরুষরা নয়, এখানে নারী-পুরুষ, মহিলা, শিশুরা ও আম চাষে সম্পৃক্ত হয়ে যৌথভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা জানিয়ে দেন যে আম শুধু ঢাকায় পাঠানো নয়, কেউ শুকিয়ে আমচুর আবার কেউ পাকা আমের সুস্বাদু আমসত্ত¡ও তৈরিতে সাংঘাতিকভাবে ব্যস্ত থাকে। দেশে আমের জুস তৈরি করছে কিছু শিল্প প্রতিষ্ঠান। এসব শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতি বছরই উৎপাদিত আমের ১৫ থেকে ২০ শতাংশ সংগ্রহ করে ক্রমেই দেশীয় বাজারকে শক্তিশালী করে তুলছে। তারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে সৌদি আরব, কাতার, ইতালি, যুক্তরাজ্যের বাজারে জুস রপ্তানি করছে। আম এখন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।
আম উৎপাদনে চাষীদের মনোযোগীতা বাড়লেও পরিবহন, প্রক্রিয়াকরণ ও হিমাগারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর উৎপাদিত আমের ৩৩ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। পরিকল্পিতভাবে আম চাষের সাথে জড়িত ও সংশ্লিষ্ট শ্রমজীবী মানুষকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারলে আম উৎপাদনও বাড়বে। এ ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে আরও পরিকল্পিত উদ্যোগ নেওয়া দরকার। কয়েকটি বিষয়ে পরিকল্পিত দিকনির্দেশনার প্রতি খেয়াল রাখা দরকার।
১.উদ্যোক্তা চাষীদের সময়ের আধুনিক চাষাবাদ সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
২.আরও উন্নত জাতের আমের চারা সরবরাহ করা।
৩.চাষীদের মনোযোগীতা বাড়ানোর জন্য কৃষি ঋণ দেওয়া।
৪.আম চাষে শ্রমজীবী মানুষদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি মানগত মূল্যায়ন করা।
৫.আমের বাজার যথাযথভাবে পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পরিবহন সহজকরণ করা।
৬.আম সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত হিমাগারের ব্যবস্থা করা।
৭.আম প্যাকেজিং এর জন্য অঞ্চলভিত্তিক ব্যবস্থা থাকা।
৮.আমে অতিরিক্ত বিষাক্ত ঔষধ ছিটানো থেকে বিরত থাকা ও স্বাস্থ্য সম্মত উপায়ে আম সরবরাহ করা
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক