প্রথম পর্ব
রাসুল (সা.)-এর টার্গেট ভিত্তিক দাওয়াত ও আল্লাহর কাছে দুআ :
আল্লাহর রাসুল (সা.) আবু জেহেল ও উমর (রা.)-এর মধ্য থেকে যেকোনো একজনকে পাওয়ার জন্য ব্যাকুল ছিলেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রায়ই দুআ করতেন, “হে আল্লাহ ওমর বিন খাত্তাব ও আবু জেহেল এর মাঝে যে বেশি তোমার কাছে পছন্দনীয় তার দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করো।” একবার ওমর কাবা ঘরের গিলাফের ভিতর ঢুকে থাকেন। রাসুলে কারিম (সা.) নামাজে সুরা হাক্কাহ তিলাওয়াত করেন। এতে উল্লেখ করেন, এ কুরআন সম্মানিত রাসুলের বাণী এটাঁ কোন কবির বাণী নয়। তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো। ওমর মনে মনে ভাবলেন, এই ব্যক্তিতো দেখছি জৌতিষী। তখন তিনি তেলাওয়াত করেন, এটাঁ কোন গণকের কথা নয়। তোমরা অল্পই অনুধাবন কর। এটি সৃষ্টিকুলের প্রতিপালকের কাছ থেরক অবতীর্ণ। এই সময় ওমরের মনে ইসলামের বীজ অঙ্কুরিত হতে থাকে এবং ইসলাম গ্রহণ করার ঘোষণা দেন। হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণ করার পর তাঁর উপরও আক্রমণ হয়। অবশ্য তিনিও তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণ করার পর তিনি আল্লাহর রাসুলের কাছে বলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ আমরা কি সত্য দ্বীনের অনুসারী নই?” রাসুল (সা.) বলেন, “অবশ্যই।” তখন তিনি আবার বলেন, “যদি আমরা সত্য দ্বীনের উপর থাকি তাহলে কেন আমরা পালিয়ে বেড়াবো? আমরা প্রকাশ্যেই দ্বীনের দাওয়াত দিবো।” হযরত আবদুল্লাহ ইবন মাসউদ বলেন, হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সব সময় শক্তিশালী ও সম্মানিত ছিলাম। আমরা যারা বর্তমানে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ করছি আমাদেরও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নাম ধরে ধরে আল্লাহর কাছে দুআ করতে হবে এবং তাদের মাঝে পরিকল্পিতভাবে দাওয়াতি কাজ করতে হবে।
রাসুল (সা.)-এর দাওয়াত ছিল বিশ্বজনীন :
রাসুল (সা.) এর রিসালত ছিল সাদা, কালো, আরব অনারব সকল মানুষের জন্য। তিনি নির্দিষ্ট কোন জাতি বা গোত্রের জন্য প্রেরিত হননি। তার দাওয়াত ছিল বিশ্বব্যাপী ও সর্বজনীন। পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দেওয়ার সময় যারা উপস্থিত ছিল সকলেই ঈমানদার ছিলেন। কিন্তু বিদায় হজের ভাষণে তিনি একটি বারের জন্য হে ঈমানদারগণ অথবা হে মুসলমানগণ বলে সম্বোধন করেন নাই। হে মানবতা- ইয়া আইয়ু হান্নাস বলে সম্বোধন করেছেন ৭ বার। এথেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর রাসুল (সা.) এই ভাষণটি মুসলমানদের সামনে দিলেও তাঁর ভাষণের বিষয়বস্তু ছিল অনাগত কালের সমস্ত মানবতা। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে অশান্ত পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে তাঁর এই ভাষণের দিক নির্দেশনা অনুসরণ করা জরুরি। মহান আল্লাহ হচ্ছেন রাব্বুল আলামিন; তিনি শুধু রাব্বুল মুসলিমুন বারাব্বুন্নাস নন। সকলে প্রতিদিন নামাজে তারই ঘোষণা দিই “আল-হামদুলিল্লাহি রাব্বিল আলামিন।” রাসুল (সা.) হচ্ছেন রাহমাতুল লিল আলামিন। আর কুরআন হচ্ছে হুদাল লিননাস। আর মুসলমানরা হচ্ছে খায়রাহ উম্মাহ উখরিযাত লিননাস। অতএব, আকাশের চাঁদ ও সুরুয যেমনিভাবে সকলের জন্য কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয়। তেমনিভাবে ইসলাম মানবতা ও সৃষ্টিজগতের জন্য কল্যাণকর ও প্রয়োজনীয়। তাই আমাদের ভাবতে হবে আমরা যা ভাবি তাকি মানবতার জন্য; নাকি শুধু নিজেদের জন্য। আমাদের ভাবনা এবং কাজ সার্বজনীন হতে হবে।
মহাগ্রন্থ আল কুরআন আরবি ভাষায় নাজিল হলেও তার পয়গাম সমস্ত মানবতা ও সৃষ্টিরাজির জন্য। এইপ্রসঙ্গে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন “হে লোকেরা! তোমাদের কাছে তোমাদের রবের পক্ষ থেকে নসীহত এসে গেছে। এটি এমন জিনিস যা অন্তরের রোগের নিরাময় এবং যে তা গ্রহণ করে নেয় তার জন্য পথনির্দেশনা ও রহমত।” (সুরা ইউনুস: ৫৭)। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরও বলেন, “হে লোকেরা তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে উজ্জল প্রমাণপত্র এসে গেছে এবং আমি তোমাদের কাছে এমন আলোক রশ্মি পাঠিয়েছি যা তোমাদের সুস্পষ্টভাবে পথ দেখিয়ে দেবে” (সুরা নিসা: ১৭৪)। মূলত বিদায় হজের ভাষণ হচ্ছে সাম্য, মানবীক মর্যাদার সনদ। আরাফাতের ময়দানে তিনি মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ও আভিজাত্য তুলে দেওয়ার জন্য ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন। হযরত ইবরাহিম ও হযরত ইসমাঈল (আ.)-এর সময়ে আরবে হজের সাধারণ পদ্ধতি ছিল এই যে ৯ই জিল হজ তারা মিনা থেকে আরাফাতে যেতো এবং ১০ তারিখ সকালে সেখান থেকে ফিরে এসে মুযদালিফায় অবস্থান করত। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারতীয় ব্রাক্ষণদের মতো আরবে কুরাইশদের ধর্মীয় প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলো। কুরাইশরা বলা শুরু করল আমরা হারামের অধিবাসী। সাধারণ আরবদের সাথে আরাফাত পর্যন্ত যাওয়া আমাদের জন্য মর্যাদা হানিকর। তাই তারা মুযদালিফা পর্যন্ত যেতো কেননা মুযদালিফা হরমের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর সাধারণ আরবদের আরাফাত পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ছেড়ে দিতো। কেননা আরাফাত হরমের বাহিরে ছিল। পরে বনি খুযাআ ও বনি কিনানা গোত্রদ্বয় এবং কুরাইশদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কযুক্ত অন্যান্য গোত্রও অভিজাতমূলক ব্যবস্থার অধিকারী হয়ে গেল। অবশেষে অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছলো যে কুরাইশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ গোত্রগুলোর মর্যাদাও সাধারণ আরবদের তুলনায় অনেক উঁচু হয়ে গেল। তারাও আরাফাতে যাওয়া বন্ধ করে দেয়।
হযরত জাবের বিন আবদুল্লাহ বলেছেন বিদায় হজের সময় আল্লাহর রাসুল (সা.) আইয়ামে তাশরিক (৯-১৩ তারিখ) সময়ের মাঝামাঝি বলেন, “হে মানুষেরা তোমাদের মালিক একজন, আর তোমাদের পিতাও একজন। শোনো! কোন আরবের উপর অনারবের প্রাধান্য নাই। কোন অনারব ব্যক্তিরও আরবের উপর প্রাধান্য নেই। শ্বেতাঙ্গের উপর কৃষ্ণাঙ্গের কোন প্রাধান্য নেই। কোন কৃষ্ণাঙ্গেরও প্রাধান্য নেই শ্বেতাঙ্গের উপর, একমাত্র তাকওয়া ছাড়া। আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান সে ব্যক্তি যে তোমাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশি তাকওয়াবান। “যদি একজন আবিসিনিয়ান গোলামকেও তোমাদের আমির বানিয়ে দেওয়া হয়, তার কথা শুন এবং আনুগত্য কর যতক্ষণ তিনি আল্লাহ পাকের কালামের ভিত্তিতে হুকুম দেন।”
আমরা বর্তমান বিশ্বে কি দেখছি? আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলা ২৭ বছরের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেয়ে রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগ পর্যন্ত সাদারা কালোদের উপর কী অত্যাচার করেছেন তা ইতিহাসে বিদ্যমান। আমেরিকায় সাদা এবং কালোর ভেদাভেদ সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। বারাক ওবামা আমেরিকার দুই দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও আজও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবধান রয়েছে। যেমন আমেরিকার ১৩% লোক কালো। কিন্তু সারা আমেরিকায় ড্রাগজনিত কারণে গ্রেফতারকৃতদের ৩৭% কালো। ২০১২ সালে ইউএস টুডের এক পরিসংখ্যানে এসেছে যে, ৫১ ভাগ আমেরিকান কালোদের ঘৃণা করে।
বর্তমানে ইসলামে নারীর অধিকার বিষয়ে অনেক অপপ্রচার চালানো হয়। অথচ ইসলামই প্রথম নারীকে মর্যাদা দেয়। ১৮৫০ সালের আগ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে সম্পত্তিতে নারীদের কোন অধিকার ছিল না। কোন নারী উত্তরাধিকার সূত্রে কোন সম্পদ পেলে তা স্বামীর সম্পদে পরিণত হতো। ১৯২১ সাল পর্যন্ত নারীর কোন ভোটাধিকার ছিল না। ১৯৩০ সালে যুক্তরাজ্যে নারীদের ভোটাধিকার দেওয়া হয় এবং ১৯৬৫ সালের আগে ইউরোপে নারীদের সার্বজনীন ভোটাধিকার দেওয়া হয়নি। রাসুলে কারিম (সা.) বিদায় হজের ভাষণে স্পষ্ট করেই বলেছেন, “মেয়েদের ব্যাপারে আল্লাহ পাককে ভয় কর। কেননা তাদের আল্লাহ পাকের আমানতের সাথে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহ পাকের কালামের মাধ্যমে হালাল করেছ। তাদের উপর তোমাদের অধিকার রয়েছে যে তারা তোমাদের বিছানায় এমন কাউকে আসতে দেবে না যাদের তোমরা পছন্দ কর না। যদি তারা এরূপ করে তবে তোমরা তাদের প্রহার করতে পারো। কিন্তু বেশি কঠোরভাবে প্রহার করো না। তোমাদের উপর তাদের অধিকার হচ্ছে এই যে, তোমরা তাদের ভালোভাবে পানাহার করাবে এবং পোশাক দেবে। ”
দাওয়াতের প্রতি রাসুল (সা.) এর দৃঢ়তা :
রাসুল (সা.) এর প্রকাশ্য দাওয়াত মক্কার কাফিরদের মাঝে নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করলো। যুগ-যুগ ধরে চলে আসা তাদের আকীদা ও সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাসুল (সা.) চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন। তারা ভয় ও লোভ দেখিয়ে রাসুল (সা.) এর চাচা আবু তালিবের নিকট গিয়ে রাসুল (সা.) কে এ কাজ বন্ধ করার প্রস্তাব দেয়। উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, “আল্লাহর শপথ তারা যদি আমার ডান হাতে সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ এনে দিয়ে চাইতো যে, আমি এ কাজ পরিত্যাগ করি, তথাপি আমি তা পরিত্যাগ করতাম না, যতক্ষণ না আল্লাহ এ কাজকে সফল ও জয়যুক্ত করেন, অথবা আমি একাজ করতে করতে শহীদ হয়ে যাই” (ইবনে হিশাম, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৬৬)। রাসুল (সা.) শত বাধা-বিপত্তি ও ঠাট্টা বিদ্রুপ সহ্য করে তার কাজ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ঘোষণা করেন। রাত-দিন গোপনে ও প্রকাশ্যে দাওয়াতের কাজে লিপ্ত থাকেন।
কাফের নেতাদের প্রতি সম্মান রেখেই দাওয়াত :
মুগীরা ইবনে শোবা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি এবং আবু জেহেল মক্কার কোন এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলাম পথে রাসুল (সা.) এর সাথে দেখা হলো। রাসুল (সা.) আবু জেহেলকে বললেন, হে আবুল হাকাম! তোমাকে আল্লাহর পথে আসার আহ্বান করছি, এখানে রাসুল (সা.) আবু জেহেলকে আল্লাহ তার রসুলের বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সম্মানের সাথে প্রকৃত নাম ধরে ডাক দিলেন।
চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে দাওয়াতি কাজ :
কথার চেয়ে চারিত্রিক মাধুর্যতা দিয়ে দাওয়াত দেওয়াকেই গুরুত্ব দিতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্যতায় আকৃষ্ট হয়েই অনেকই ইসলাম কবুল করেন। এই ক্ষেত্রে সেই বুড়ির কথা উল্লেখ করা যায়; যিনি আল্লাহর রাসুল (সা.) সম্পর্কে পরিচালিত অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে নিজের ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটে চলে। পথিমধ্যে আল্লাহর রাসুল (সা.) উক্ত বুড়ির সাথে দেখা হয়। রাসুলে কারিম (সা.) উক্ত বুড়িকে তার গন্তব্যস্থলে পৌঁছিয়ে দেন। কিন্তু বুড়ি আল্লাহর রাসুলের পরিচয় জানতো না। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর বুড়িটি আল্লাহর রাসুলের পরিচয় জানার সাথে সাথেই ঈমান কবুল করে। কেননা সে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে তার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্থ হয়েই নিজের ঘর ত্যাগ করেছিল।
পরিবার পরিজনের মাঝে দাওয়াতি কাজ :
রাসুলে কারিম (সা.) সর্বপ্রথম হযরত খাদিজার কাছেই সত্য প্রকাশ করেছেন এবং সত্যের দাওয়াত দিয়েছেন। আর হযরত খাদিজাই সর্বপ্রথম ইসলাম কবুল করেন। এ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, আমরা যে সত্যে বিশ্বাসী তা প্রথমেই নিজ পরিবার পরিজনের কাছে তুলে ধরতে হবে। আর ব্যক্তি নিজ আদর্শের প্রতি কতটুকু নিষ্ঠাবান তা তার আপন লোকেরাই সবচেয়ে বেশি বলতে পারেন। আমাদের পরিবার পরিজনের মাঝে দাওয়াতি কাজ করতে হবে। আর আল্লাহর শেখানো ভাষায় তাঁর কাছে ফরিয়াদ জানাতে হবে, হে আমার রব! আমাকে নামাজ প্রতিষ্ঠাকারী করো এবং আমার বংশধরদের থেকেও (এমন লোকদের উঠাও যারা এ কাজ করবে)। পরওয়ারদিগার! আমার দোয়া কবুল করো। হে পরওয়াদিগার! যেদিন হিসেব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো” (সুরা ইরবাহীমের: ৪০-৪১)।
ইন্নাকা লাতাহদি মান আহ্বাবতা :
দাওয়াত দানের দায়িত্ব আমাদের কিন্তু হেদায়াত আল্লাহর হাতে। আল্লাহর রাসুল (সা.) অনেক চেষ্টা করার পরও তাঁর চাচা আবু তালিব এর ভাগ্যে কালেমা নসীব হয়নি যদিও তিনি সারা জীবন আল্লাহর রাসুলকে সকল ধরনের সহযোগিতা করেছেন। মুসায়েব ইবন হাযন বলেন, আবু তালিবের মৃত্যুর সময় রাসুলে কারিম (সা.) তাঁর কাছে এসে বললেন চাচা আপনি বলুন, “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” এর দ্বারা আমি আল্লাহর দরবারে আপনার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করব। সে সময় আবু জেহেল ও আব্দুল্লাহ ইবন আবি উমাইয়া সেখানে উপস্থিত ছিল। তারা বলতে লাগল, “হে আবু তালিব আপনি কী আবদুল মোত্তালিবের দ্বীন থেকে বিমুখ হয়ে যাচ্ছেন?” তখন আবু তালিব বলেন, আমি আবদুল মোত্তালিবের দ্বীনের উপর আছি। সেই সময় আল্লাহর রাসুল বলেন আমাকে নিষেধ করার আগ পর্যন্ত আমি তার জন্য প্রার্থনা করব। তখন আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করেন, “আত্মীয়স্বজন হলেও মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা নবী ও মুমিনদের জন্য সংগত নয়। একথা তাদের কাছে স্পষ্ট হওয়ার পরও যে তারা জাহান্নামী। অতঃপর আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করেন, “হে নবী আপনি যাকে ভালোবাসেন ইচ্ছা করলে তাকে হেদায়েত করতে পারেন না। কিন্তু আল্লাহ যাকে চান তাকেই হেদায়েত করেন। আর তিনি হেদায়েত কবুলকারীদের ভালোকরেই জানেন” (সুরা আল কাসাস: ৫৬)। এ থেকে বুঝা যায় যে, দাওয়াত দানের দায়িত্ব আমাদের কিন্তু হেদায়াত আল্লাহর হাতে।
আল-হিরস:
আল্লাহর রাসুলের পরিচয় কুরআনে এই ভাবে তুলে ধরা হয়েছে, লাকাদ যাআকুম রাসুলুন মিন আনফুসিকুম আজিজুন আলাইহি মা আনিততুম হারিসুন আলাইকুম বিলমুমিনা রাউফুর রাহীম। আল্লাহর রাসুল দাওয়াত দিয়ে কত বেশি পেরশান ছিলেন তা দুইটি আয়াত থেকে স্পষ্ট। সুরা কাহফের ৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ফালাআল্লাকা বাখিয়ুন নাফসাকা আলা আসারিহিম ইনলাম য়ুমিনু বিহাযাল হাদিসে আসাফা। সুরা মায়েদার ৪১ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, “ইয়া আইয়ু হার রাসূলু লা য়াহযুনকা আল লাযিনা য়ুসারিউনা ফীল কুফরি মিনাললাযিনা কবঅরু আমান্না বিআফওয়াহিহিম ওয়া লাম তুমিন কলুবাহুম।” অন্যত্র বলা হয়েছে, “ইন তাহরুস আলা হুদাহুম ফা ইন্নাল্লাহা লান য়াহদি মান য়াদিল্লু।” হযরত আবু হুরাইরার মা মুশরিকা ছিলেন। তিনি একদিন কান্না জড়িত কণ্ঠে রাসুলে কারিম (সা.)-এর কাছে আবেদন করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ আপনি আমার মায়ের জন্য দুআ করুন।” আল্লাহর রাসুল (সা.) দুআ করলেন, “হে আল্লাহ আবু হুরাইরার মাকে হেদায়াত দান করুন।” এরপর আবু হুরাইরা ঘরে যাওয়ার পর তার মা বললেন, হে আবু হুরাইয়ারা! “আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসুলুল্লাহ।”
ক্ষমা :
লা তাসরিবা আল ইয়াওম। রাসুলে কারিম (সা.) মক্কা বিজয়ের দিন সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। প্রতিশোধ পরায়ণতা দায়ীর মনে থাকবে না। আব্বাস (রা.) মক্কা বিজয়ের দিন রাসুলে কারিম (সা.)-এর কাছে বললেন হে আল্লাহর রাসুল! “আবু সুফিয়ান গর্ব করা পছন্দ করেন, তার জন্য একটা কিছু করেন।” তখন রাসুলে কারিম (সা.) বললেন, “মান দাখালা দারা আবি সুফিয়ান ফাহুয়া আমিন। ওয়া মান আগলাকা আলাইহি বাবুহু ফাহুয়া আমিন। ওয়া মান দাখালাল মাসজিদ আল হারাম ফাহুয়া আমিন।” আবু সুফিয়ান তার পর ইসলাম কবুল করেন।
সবর:
আল্লাহ তায়ালা হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-কে লক্ষ্য করে ইরশাদ করেন, “অতএব, হে নবী, দৃঢ়চেতা রসুলদের মত ধৈর্য ধারণ করো এবং তাদের ব্যাপারে তাড়াহুড়া করো না। এদেরকে এখন যে জিনিসের ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে যেদিন এরা তা দেখবে সেদিন এদের মনে হবে যেন পৃথিবীতে অল্প কিছুক্ষণের বেশি অবস্থান করেনি। কথা পৌঁছিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবাধ্য লোকেরা ছাড়া কি আর কেউ ধ্বংস হবে?” (সুরা আল-আহক্বাফ: ৩৫)। উলুল আযম সম্পর্কে কয়েকটি অভিমত রয়েছে, সমস্ত নবী, নুহ, ইবরাহিম, মুসা ও মুহাম্মাদ এই চারজন। কারও মতে হযরত ঈসা সহ পাঁচ জন। কারও মতে ছয় জন হযরত হারুন/দাউদ। কারও মতে সাত জন হযরত আদম। নিম্নে কয়েকজন নবী-রাসুলের জীবন থেকে দাওয়াত ইলাল্লাহর কপিতয় শিক্ষা তুলে ধরছি।
হযরত নূহ (আ.) সাড়ে নয়শত বছর দাওয়াতি কাজ করার পরও মাত্র ৪০ জন কিংবা মতান্তরে ৮০ জন তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। অধিকাংশই তাঁর বিরোধীতা করে। এমনকী তারা বললো, হে নূহ! তুমি যদি বিরত না হও তাহলে তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দেওয়া হবে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ ইরশাদ করছেন, “তারা বললো, হে নূহ! তুমি যদি বিরত না হও তাহলে তোমাকে পাথর মেরে শেষ করে দেওয়া হবে। নূহ দোয়া করলেন, হে আমার রব! আমার কাওম আমাকে মিথ্যা মনে করছে। কাজেই এখন আমার ও তাদের মধ্যে চ‚ড়ান্ত ফায়সালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথে যেসব মুমিন আছে তাদের নাজাত দাও। অবশেষে আমি তাঁকে ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের একটি জাহাজে তুলে বাঁচিয়ে দিলাম। এরপর বাকি লোকদের ডুবিয়ে দিলাম। নিশ্চয়ই এর মধ্যে এক নিদর্শন রয়েছে। আর তাদের বেশির ভাগ লোকই মুমিন ছিল না। নিশ্চয়ই আপনার রব মহাশক্তিশালী ও দয়াবান” (সুরা শোয়ারা: ১১৬-১২২)
সকল পরিস্থিতি ধৈর্যের সাথে মোকাবিলা করতে হবে। তাহলেই আমরা সফলকাম হব। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ পাক বলেন, “হে ঈমানদারগণ সবরের পথ অবলম্বন করো, বাতিলপন্থিদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা দেখাও। হকের খিদমত করার জন্য উঠে পড়ে লাগো এবং আল্লাহকে ভয় করতে থাকো। আশা করা যায় তোমরা সফলকাম হবে” (আলে-ইমরান: ২০০)। মাওলানা মওদুদি (রহ.) বলেন, এই আয়াতে উল্লেখিত সাবিরূ শব্দের দুইটি অর্থ হয়,
১.কাফিরেরা কুফরির ব্যাপারে যে দৃঢ়তা, অবিচলতা দেখাচ্ছে এবং কুফরির ঝান্ডা সমুন্নত রাখার জন্য যে ধরনের চেষ্টা করছে তোমরা তাদের মোকাবিলায় তাদের চাইতেও বেশি দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতি দেখাও।
২.তাদের মোকাবিলায় দৃঢ়তা, অবিচলতা ও মজবুতি দেখানোর ব্যাপারে তোমরা পরস্পর প্রতিযোগিতা করো।
হাস্যোজ্জল চেহারা :
রাসুলে কারিম (সা.) বলেন তোমরা হাসি মুখে যদি নিজের ভাইয়ের দিকে তাকাও তাও সদকা। হাসি খুশি চেহারা দেখলে লোক তার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হয়। আর গোমরা শুখের কারও সাথে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে না। খিট খিটে মেজাজের অধিকারী কারও সাথে কেউ সম্পর্ক তৈরি করতে চায় না।
কম কথা বলা এবং অপরকে কথা বলার সুযোগ দান :
রাসুলে কারিম (সা.) খুব সংক্ষিপ্ত ভাষায় কথা বলতেন। অপরের কথা মনোযোগ সহকারে শুনতেন। আল্লাহ তায়ালা আমাদের দুইটি কান দুইটি চোখ ও একটি মুখ দিয়েছেন। এর অর্থ হচ্ছে আমরা অপরের কথা শুনব বেশি দেখব বেশি এবং নিজে কথা বলব কম। কথা বলার ধরন হতে হবে মার্জিত। কেউ কোন কিছু ভুল বললেও সরাসরি এই কথা বলা ঠিক নয় যে, আপনি বুঝেননি বা আপনি ভুল বলেছেন। কথা বলার এবং ভুল সংশোধনের অনেক পন্থা আছে। যার সাথে কথা বলা হচ্ছে তার মন-মানসিকতার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। সে বিরক্তিবোধ করছে কি না? আবার সময়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় একজন ব্যক্তি বিশেষ কোন সমস্যায় আছে বা কাজে ব্যস্ত তখন তার কাছে ভালো কথাও ভালো লাগবে না। দায়ীকে আরেকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যুক্তি তর্কে পরাজয়ের ভাব পরিহার করতে হবে। নিজের মতো প্রতিষ্ঠিত করেই ছাড়তে হবে এমন দৃষ্টিভঙ্গি পরিহার করতে হবে। যেসব ব্যাপারে মতের মিল রয়েছে তার উপর ভিত্তি করেই সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
কথা ও কাজে মিল থাকা :
আল্লাহর রাসুল (সা.) ছিলেন কুরআনের মূর্তপ্রতীক। অতএব যারা কুরআনের কথা বলেন এবং আল্লাহর পথে মানুষদের ডাকেন তাদের কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “মুমিনগণ! তোমরা যা কর না তা কেনো বল? তোমরা যা কর না তা বলা আল্লাহর কাছে খুবই অসন্তোষজনক” (সুরা সফ: ২-৩) আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, “তোমরা কি মানুষকে সৎ কর্মের নির্দেশ দাও এবং নিজেরা নিজেদের ভুলে যাও অথচ তোমরা কিতাব পাঠ কর? তবুও কি তোমরা চিন্তা কর না?” (সুরা বাকারার: ৪৪)। রাসুলে কারিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, কতিপয় জান্নাতবাসী কতক জাহান্নামীকে প্রশ্ন করবেন তোমরা কিভাবে দোজখে প্রবেশ করলে অথচ আল্লাহর কসম আমরা তো সেসব সতকাজের বদৌলতে জান্নাত লাভ করেছি, যা তোমাদের কাছ থেকেই শিখেছিলাম। সেসব দোজখবাসীরা জবাবে বলবে আমরা মুখে তা অবশ্য বলতাম কিন্তু নিজে তা কাজে পরিণত করতাম না। উপরিউক্ত আয়াত ও হাদিসের আলোকে উলামায়ে কেরামের কারও কারও বক্তব্য হচ্ছে কোন আমলহীন ব্যক্তির পক্ষে ঐ আমল করার উপদেশ দেওয়া জায়ে নাই। কিন্তু অনেক উলামায়ে কেরাম মনে করেন যে, আমলে সালেহ করা নেকির কাজ। আর আমর বিল মারুফ ও নেহী আনিল মুনকারের কাজও নেকির কাজ। কেউ যদি আমল না করে তারপরও সে উক্ত আমলের উপদেশ দিতে পারবে। কোন ব্যক্তি নামাজ না পড়লেও অপরকে নামাজ পড়ার উপদেশ দিতে পারবে। আশা করা যায় এর মাধ্যমে তার মাঝে উক্ত আমল করার অনুভ‚তি সৃষ্টি হবে। এই কারণে জনৈক ইসলামি চিন্তাবিদ বলেন, দাওয়াতি কাজ হচ্ছে বিনা পয়সার সাবান।
আদর্শের কথা বলা বা আদর্শের দিকে মানুষকে আহ্বান জানানো সহজ। কিন্তু উক্ত আদর্শ বাস্তব জীবনে অনুসরণ ও অনুশীলন করে সত্যের সাক্ষ্য হিসাবে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করা কঠিন। মিথ্যা বলা পাপ এই কথা বলা সহজ কিন্তু জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সত্য বলা এবং মিথ্যা না বলার দৃষ্টান্ত কতজনইবা স্থাপন করতে পারেন। আমানতদারীতা মুমিনের বৈশিষ্ট্য আর খিয়ানতকরা নেফাকীর আলামত। এই ছোটো কথাটি কম বেশি সকলেই জানি। কিন্তু ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে তার অনুসরণ কতজনই বা সঠিকভাবে করি? বাস্তব কথা হচ্ছে কোন আদর্শ বাস্তবায়নে একজন কত বেশি নিষ্ঠাবান এবং সচেষ্ট তা নির্ভর করছে উক্ত আদর্শের প্রতি তার হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা ও ঈমানের গভীরতার উপর। আর ঈমানের সাথে আমলের সম্পর্ক অত্যন্ত গভীর। আমল বিহীন ঈমান মূল্যহীন। তেমনিভাবে কথা ও কাজে মিল না থাকলে কারও কথায় প্রভাব পড়ে না। আজকের সময়ে আদর্শের প্রচারকের অভাবের চেয়ে বেশি অভাব হচ্ছে আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার সাথে আমল করার মতো লোকের। আল্লাহর রাসুলের সাহাবারা কথার চেয়ে কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করেছেন ইসলাম শান্তি ও কল্যাণের দ্বীন। তাঁরা কথার চেয়ে কাজের মাধ্যমে সত্যের সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আজকে এই ধরনের সত্যের সাক্ষ্য দেওয়ার মতো লোকের অভাব রয়েছে। মূলত ইসলামের ইতিহাসে হাজারো জীবন্ত উদাহরণ রয়েছে যার ফলেই অনেক অমুসলিমের মন ও মনন আকৃষ্ট হয়েছিল। আজকের যুগেও এই ধরনের উদাহরণ স্থাপনকারী কিছু মডেল প্রয়োজন। যারা হবেন আদর্শের মূর্তপ্রতীক।
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর চারিত্রিক মাধুর্যতায় আকৃষ্ট হয়েই অনেকই ইসলাম কবুল করেন। এই ক্ষেত্রে সেই বুড়ির কথা উল্লেখ করা যায় যিনি আল্লাহর রাসুল (সা.) সম্পর্কে পরিচালিত অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে নিজের ঘর ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেওয়ার জন্য ছুটে চলে। পথিমধ্যে আল্লাহর রাসুল (সা.) উক্ত বুড়ির সাথে দেখা হয়। রাসুলে কারিম (সা.) উক্ত বুড়িকে তার গন্তব্যস্থলে পৌছিয়ে দেন। কিন্তু বুড়ি আল্লাহর রাসুলের পরিচয় জানতো না। গন্তব্যস্থলে পৌঁছার পর বুড়িটি আল্লাহর রাসুলের পরিচয় জানার সাথে সাথেই ঈমান কবুল করেন। জনৈক সাহাবা নিজ দোকানে মাল থাকা সত্তে¡ও শুধুমাত্র অপর একজন ইহুদি দোকানদারকে সহযোগিতার উদ্দেশ্যে কাস্টমারকে তার কাছে পাঠিয়েই তো ক্রেতার মন জয় করেছেন ফলে সে ইসলাম কবুল করেছে।
নতুনদের সম্পৃক্ত করা এবং সোহ্বার মাধ্যমে মান উন্নয়ন করা :
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর হাদিস অনুযায়ী দায়ীর চেয়ে দাওয়াত প্রাপ্ত ব্যক্তি অনেক সময় আন্দোলন গতিশীল রাখতে অধিক অবদান রাখতে পারেন। আমাদের মনে রাখতে হবে যে আমাদের পরিচয় হচ্ছে আমরা দায়ী ইলাল্লাহ। আমরা নিছক কোন প্রজেক্ট ম্যানেজার কিংবা নেতা বা কর্মী নই। আল্লাহর রাসূল রাসুল (সা.) আবু বকর, উমর, উসমান, আলি (রা)-এর মতো ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছিলেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর ব্যক্তিগত সোহ্বার বিরাট প্রভাব ছিল। আজকের সময়ে আমরা প্রোগ্রামাদিতে মতো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি যে নিজেদের আমলী জিন্দেগির প্রতি খেয়াল রাখার কোন সুযোগ পাই না। আপন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, পরিবার, আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী কারও কাছে দাওয়াত ইলাল্লাহর দায়িত্ব পালনের সুযোগ হয় না। সব সময় ব্যস্ত থাকি প্রোগ্রাম নিয়ে। এর ফলে পরিবার, আত্মীয় স্বজন ও সমাজের মানুষের সাথে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। আর প্রোগ্রামাদিতে একগেঁয়েমী থাকলে অনেক সাধারণ মানুষ নতুনভাবে শামিল হয়ে ২/৩টা প্রোগ্রামে উপস্থিত হয়ে পরবর্তী সময়ে প্রোগ্রামে উপস্থিত হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। অতএব, প্রোগ্রামাদিতে বৈচিত্র আনা এবং একঘেয়েমি দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
রাসুলে কারিম (সা.)-এর সাহাবাদের তালিম ও তারবিয়াত প্রদান করতেন সংক্ষিপ্ত কথায়। তিনি মাঝে মধ্যে মাটিতে অঙ্কন করে বুঝাতেন। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তিনবার বলতেন। প্রোগ্রামাদিতে সৃষ্টিশীল কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) যখন কথা বলতেন তখন সকলে মনমুগ্ধ হয়ে শোনতেন। যারফলে মক্কার সম্পূর্ণ এক বৈরী পরিবেশেও তিনি মানুষের হৃদয় আকৃষ্ট করে সকলের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছিলেন। তার প্রশিক্ষণ ছিল বাস্তব ভিত্তিক। তিনি শুধু থিউরিটিক্যল তত্ত্ব দিয়ে বেড়াননি। তার আদেশ-উপদেশ ছিল সমাজ ও বাস্তবতার নিরীখে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।
আল্লাহর রাসুল (সা.) ওফাতের কিছুদিন আগে মুতা অভিযানে শাহাদাত প্রাপ্ত যায়িদ ইবন হারিসা, জাফর ইবন আবি তালিব ও আবদুল্লাহ ইবন রাওয়াহার রক্তের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য একটি বাহিনী তৈরি করেন এবং এই বাহিনীর নেতৃত্ব প্রদানের দায়িত্ব দেন নওজয়োন ত্রিশ বছর বয়সী উসামাহ বিন যায়েদকে। এরইমধ্যে আল্লাহর রাসুলের ওফাত হলে আনসারদের একটি দল উসামাকে কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে অন্য কোন বয়স্ক সাহাবিকে তাঁর স্থলে নিয়োগ করার দাবি জানায়। সকলের পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি হযরত উমর খলিফার কাছে পেশ করেন। প্রস্তাব শুনে হযরত আবু বকর রাগে উমরের দাঁড়ি ধরে বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যাকে নিয়োগ করেছেন আবু বকর তাকে অপসারণ করবে? আবার হযরত উমরও ও ছিলেন এই বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত একজন সৈনিক। কিন্তু মদিনাতে তাঁর থাকা একান্ত প্রয়োজন। খলিফা ইচ্ছা করলে নিজেই তাঁকে মদিনায় থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি উসামার ক্ষমতায় হস্তক্ষেপ না করে তাঁর কাছে আবেদন জানালেন উমরকে মদিনায় রেখে যাওয়ার জন্য। উসামা খলিফার আবেদন মঞ্জুর করেন।
হযরত উমর ইবন অব্দুল আযিয খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর লোক মারফত তাউসের কাছে উপদেশ চান। তাউস এক লাইনে একটি চিঠি লিখেন, “যদি আপনি চান আপনার সব কাজ ভালো হোক তাহ লে ভালো লোকদের নিয়োগ করুন ওয়াসালাম।”
(চলবে)
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও গবেষক