রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে তাঁর সঙ্গে বহু নারী সাহাবি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের অন্যতম উম্মে আম্মারা নুসাইবা বিনতে কাআব (রা.)। যিনি মহানবি (সা.)-এর সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং অসীম বীরত্বে লড়াই করেন। হিজরতের তৃতীয় বছর উহুদ যুদ্ধে তিনি তাঁর স্বামী এবং দুই সন্তানসহ অংশগ্রহণ করেন। তিনি গিয়েছিলেন মূলত একটি মশক নিয়ে মুজাহিদদের পানি পান করাতে। মুসলিম বাহিনীর এক অংশ বিজয় অর্জিত হয়েছে ভেবে নবিজি (সা.) এর নির্দেশ ভুলে গিয়ে নির্দেশিত অংশ থেকে সরে যায় তখন কাফের বাহিনী সে স্থান দিয়ে এগিয়ে এসে পিছন দিক থেকে মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে। একটা ভুলের কারণে যুদ্ধের দৃশ্য বদলে যায় এবং মুজাহিদরা বিশৃঙ্খলার শিকার হয়। রাসুল (সা.) এর নিকট হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন জীবন উৎসর্গকারী রয়ে গিয়েছিলেন। এ সংবাদ যখন উম্মে আম্মারার (রা.) কানে আসে তিনি দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। এ অবস্থা প্রত্যক্ষ করে তিনি মশক ছুড়ে ফেলেন রাসুল (সা.) এর জীবন রক্ষায় ছুটে যান, তরবারি এবং ঢাল হাতে তুলে নিলেন এবং রাসুল (সা.) এর নিকট কাফেরদের সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে গেলেন, এটা অত্যন্ত ভয়ংকর সময় ছিল। বড়ো বড়ো বাহাদুরের পা টলে গিয়েছিল, কিন্তু এই ব্যাঘ্র অন্তর মহিলা অটল পাহাড়ের মত রাসুল (সা.) সামনে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করেন।
এমন সময় এক মুশরিক তার মাথার উপর পৌঁছে তরবারি চালাচ্ছিল। উম্মে আম্মারা (রা.) তাকে নিজের ঢাল দিয়ে প্রতিরোধ করলেন আর তাঁর ঘোড়ার পায়ের উপর তরবারির এমন আঘাত হানলেন যে ঘোড়া এবং সওয়ার উভয়েই মাটিতে পড়ে যায়। রাসুল (সা.) এ দৃশ্য দেখে উম্মে আম্মারার (রা.) পুত্র আব্দুল্লাহ (রা.) ডেকে বললেন, ‘আব্দুল্লাহ তোমার মাকে সাহায্য কর’। আব্দুল্লাহ (রা.) তার তরবারির এক আঘাতে সেই মুশরিককে জাহান্নামে পাঠিয়ে দেয়। ঠিক এ সময়ে অন্য এক মুশরিক দ্রুত এগিয়ে এসে আব্দুল্লাহর (রা.) বাম বাহুতে আঘাত করে। উম্মে আম্মারা (রা.) স্বহস্তে আব্দুল্লাহ (রা.) ক্ষতস্থান বাধলেন এবং বললেন ‘পুত্র, যাও যতক্ষণ দম আছে ততক্ষণ লড়াই কর’। ছেলের আঘাতে মোটেই না ঘাবড়িয়ে বীরত্বের সাথে কাফেরদের উপর তিনি হামলা চালাচ্ছিলেন। এক সময় তার কাধে মারাত্মক আঘাত লাগলো। তার দেহ রক্তাপ্লুত হয়ে পড়ে। রাসুল (সা.) সামনে উপস্থিত থেকে উম্মে আম্মারার ক্ষত স্থানে পটি বাঁধা হচ্ছে সেসময় তিনি কয়েকজন বীর সাহাবির নাম উল্লেখ করে বলেন, আল্লাহর কসম, আজ উম্মে আম্মারার অবদান এদের চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। উম্মে আম্মারা (রা.) আরজ করলেন, “ইয়া রাসুলাল্লাহ, আপনি আল্লাহর কাছে দোয়া করুন, জান্নাতে যেন আমরা আপনার সাথী হতে পারি।” রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁদের জন্য দোয়া করলেন, “ইয়া আল্লাহ, আপনি তাদেরকে জান্নাতে আমার সাথী হিসেবে কবুল করেন।” নবিজির দোয়া শুনে উম্মু আম্মারা বলেন, “এখন আর আমি কোনো কিছুরই পরোয়া করি না, দুনিয়ার যত কঠিন বিপদই আসুক না কেন।”
উম্মে আম্মারা (রা.) সাহসিকতার কারণেই আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর প্রশংসা করেছেন এবং তাঁর মর্যাদা বয়ান করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন- “আজ (উহুদ যুদ্ধের দিন) নুসাইবা বিনতু কা’বের ভূমিকা অমুক অমুকের চেয়ে অনেক বেশি। (কেননা) আমি ডানে, বামে যেদিকেই তাকিয়েছি আজ, সেদিকেই উম্মে আম্মারাকে যুদ্ধ করতে দেখেছি।” রাসুল (সা.) নুসাইবা বিনতু কা’বের ছেলে আব্দুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পরিবারের ওপর বরকত নাজিল করুক। তোমার মায়ের মর্যাদা অমুক অমুকের চেয়ে অনেক বেশি। তোমার বাবার মর্যাদা অমুক অমুকের চেয়ে অনেক বেশি। তোমার মর্যাদা অমুক অমুকের চেয়ে অনেক বেশি। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের পরিবারের ওপর রহম করুক।”
যখনি উম্মে আম্মারার বীরত্বপূর্ণ সেবার কথা কোনো মজলিসে আলোচনা হতো তখন রাসুল (সা.) বলতেন, “আমি ওহুদ যুদ্ধে তাঁকে সব সময় আমার ডানে-বায়ে যুদ্ধ করতে দেখেছি।” যুদ্ধে এক কাফেরের পাথরের আঘাতে নবিজী (সা.) এর দান্দান মুবারক শহিদ হয়। ইতোমধ্যে ইবনে কেমইয়া তরবারি দিয়ে আক্রমণ করে নবিজি (সা.) এর চেহারা মুবারকে। তার চেহারা মুবারক থেকে দরদর করে রক্ত প্রবাহিত হতে থাকে। উম্মে আম্মারা (রা.) এ অবস্থা দেখে মরিয়া হয়ে ইবনে কেমইয়ার উপর আঘাত হানেন। কিন্তু এর কোনো ফল হয়নি। কারণ তার পরিধানে ছিল লৌহ নির্মিত বিশেষ পোশাক। এছাড়াও উম্মে আম্মারা (রা.) রাসুল (সা.) এর সঙ্গে উহুদ, খন্দক, মক্কা অভিযান ও হুনাইন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। হিজরতের আগে বাইয়াতে উকবার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান, হুদাইবিয়ার সন্ধিচুক্তি, উমরা সফরে মহানবি (সা.) এর সঙ্গী ছিলেন।
উম্মে আম্মারা ছিলেন কঠিন হিম্মতের অধিকারী এক নারী। তিনি সবসময় চাইতেন, মুসলিম পুরুষের পাশাপাশি মুসলিম নারীরও স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি হোক। তিনি দেখলেন, কুরআন সবসময় পুরুষদের সম্বোধন করে কথা বলে আর এই সম্বোধনের আওতায় পরোক্ষভাবে শামিল থাকে নারীরা। তার মনে প্রশ্ন জাগে এটা নিয়ে। হাজির হন নবিজির কাছে। প্রশ্ন করেন, “ইয়া রাসুলুল্লাহ, আমি তো দেখছি সবকিছু পুরুষদের জন্যই। কোথাও কোনো ব্যাপারেই আমাদের নারীদের কোনো উল্লেখ করা হচ্ছে না।” স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁর এই প্রশ্নের জবাব দিলেন। আসমানের আমিন জিবরাঈল (আ.) চলে আসলেন জমিনের আমিন মুহাম্মাদ (সা.) এর কাছে। নিয়ে আসলেন কুরআনি ওহি, যাতে উল্লেখ করা হচ্ছে নারীকে; পুরুষের আওতায় নয়, বরং তার পাশাপাশি। আল্লাহ তায়ালা বলছেন, “একথা সুনিশ্চিত যে, যে পুরুষ ও নারী মুসলিম, মু’মিন, হুকুমের অনুগত, সত্যবাদী, সবরকারী, আল্লাহর সামনে বিনত, সাদকাদানকারী, রোজা পালনকারী, নিজেদের লজ্জাস্থানের হেফাজতকারী এবং আল্লাহকে বেশি বেশি স্মরণকারী আল্লাহ তাদের জন্য মাগফিরাত এবং প্রতিদানের ব্যবস্থা করে রেখেছেন।” (সুরা আহযাব : ৩৫)
সংগ্রামী এই নারী শুধু নবি (সা.) জীবিত থাকা অবস্থায় ইসলামের জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন না; বরং নবিজির মৃত্যুর পর হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) যখন খলিফা নির্বাচিত হলেন, তখন আরবে ধর্ম দ্রোহিতার ফিতনার আগুন প্রজ্জলিত হয়ে উঠলো। ধর্মদ্রোহীদের মূলোৎপাটনের জন্য বিভিন্ন যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিথ্যা নবুয়তের দাবিদার মুসাইলামাতুল কাজ্জাবের বিরুদ্ধে যে বাহিনী পাঠানো হয়েছিল তাতেও তিনি স্বতঃস্ফ‚র্ত অংশগ্রহণ করেন। যে তার নবুয়তকে অস্বীকার করত মুসায়লামা কাজ্জাব তার উপর কঠোর নির্যাতন চালাতো। উম্মে আম্মারা (রা.) এক পুত্র হাবিব (রা.) তার নবুয়ত অস্বীকার করায় মুসায়লামা ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে তার ১টি হাত কাটে পরে অপর হাত কাটে। এরপরও তাকে নবি হিসাবে স্বীকার না করায় তাকে শহিদ করে টুকরা টুকরা করা হয়। উম্মে আম্মারার (রা.) পুত্র হাবীব (রা.) শহিদ হলেও হক পথ থেকে বিচ্যুত হননি।
উম্মে আম্মারা (রা.) মুজাহিদ পুত্রের নির্যাতনমূলত শাহাদাতের খবর পেয়ে তার গুণের দৃঢ়তা ও অটলতার জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। আর প্রতিজ্ঞা করেন যে, মুসাইলামার এই জুলুমের প্রতিশোধ অবশ্যই নিবেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.), হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কে মুসাইলামাকে উৎখাতের জন্য নিয়োগ দেন। তখন উম্মে আম্মারা (রা.) খালিদ (রা.) বাহিনীতে যোগ দেন।
রাসুল (সা.) এর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা, গভীর শ্রদ্ধাবোধ, দ্বীনের জন্য তার জান, মাল সন্তানের কুরবানি তাকে অনেক উচ্চ মর্যাদার আসনে আসীন করেছে। উম্মে আম্মারার যুদ্ধ কৌশল খালেদের ন্যায় মহাবীরকে বিস্মিত করেছিল, মুগ্ধ করেছিল। সমস্ত শরীরে ক্ষত বিক্ষত। কিন্তু কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই, বৃদ্ধ বয়সেও তার অন্তরে ছিল দুর্জয় সাহস, মুখে মহীমার দীপ্ত। রাসুল (সা.) জীবন রক্ষার্থে অগণিত শত্রু সেনার ভিতর প্রবেশ করতে অন্তর একটুও বিচলিত হয়নি। আল্লাহদ্রোহী, ইসলামের শত্রুকে তিনি ধ্বংস করেছেন এ চিন্তায় তার দেহ মন ছিল পরিপূর্ণ। তাইতো সিংহের মত শত্রুর বুঁজ্জ ভেদ করে সামনে এগিয়ে গিয়েছেন। শত্রুর তরবারি থেকে রাসুল (সা.) কে রক্ষার জন্য বীরদর্পে অস্ত্র চালনা করেছেন।
আমিরুল মুমিনিন হযরত ওমর ফারুকের (রা.) খিলাফতকালে একবার গনিমতের মাল আসে তাতে অনেক মূল্যবান কাপড় ছিল। কাপড়ের মধ্যে একটা দামী দোপাট্টা ছিল। তিনি পরামর্শ চাইলেন কাকে এ দোপাট্টা দেওয়া যায়। অনেকে তার পুত্রবধুকে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, “না এটা আমি উম্মে আম্মারা (রা.) কে দেব।” তখনও তিনি জীবিত ছিলেন। ওমর (রা.) স্মরণ করেন রাসুলের সেই উক্তি ‘‘ডানে বামে যেদিকে তাকিয়েছি উম্মে আম্মারাকে আমি আমার চারপাশে যুদ্ধ করতে দেখেছি।” উম্মে আম্মারা (রা.) নিকট সেই দোপাট্টাটি পাঠিয়ে দেওয়া হল। রাসুলের (সা.) স্মৃতি অন্তরে জাগরুক রেখে মদিনার এক জায়গায় তিনি জীবনের শেষ সময় পার করছিলেন। রাসুল (সা.) এর প্রতি সীমাহীন ভালবাসা এবং হকের পথে জীবন, সন্তান, সম্পদ কুরবানির আবেগ এতোপ্রোজ্জ্বল ছিল যে, ফারুকে আযমসহ (রা.) সকল সাহাবি (রা.) তাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং ‘খাতুন ওহুদ’ বলে স্মরণ করতেন।
সংগ্রামী এই মহীয়সী নারী মদিনায় ১৩ হিজরিতে ইন্তেকাল করেন এবং জান্নাতুল বাকিতে তাঁর দাফন হয়। মহান আল্লাহ সংগ্রামী এই নারীর মর্যাদা আরো বৃদ্ধি করুন। ইসলামের পথে আমাদের নারীদেরও নিবেদিতপ্রাণ হওয়ার তাওফিক দান করুন।
লেখিকা: কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।