মুসলিম মানে অনুগত। আর ইসলাম অর্থ আনুগত্য। মুসলিমের কাজ হচ্ছে ইসলাম। আল্লাহ ও রাসুলের অনুগত ব্যক্তিকে মুসলিম বলে। মুসলিম সর্বদাই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের পছন্দ মত জীবন-যাপন করতে বাধ্য। ইসলামের দৃষ্টিতে মালিক শ্রমিক সকল মানুষই সমান, বিধায় ইসলাম উভয়কে সমান গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়। ইসলামে শ্রেণি ভেদ নেই, আছে শ্রেণি সমঝোতা। মালিকের পক্ষ থেকে প্রদত্ত কাজ ও সময় শ্রমিকের জন্য আমানত স্বরূপ। শ্রমিক যদি এ আমানত খেয়ানত করে তবে শ্রমিকের দায়িত্ব পালন হয় না, বরং কর্তব্য কর্মে ফাঁকি দেওয়া হয়। এ ধরনের শ্রমিক মালিকের জন্য সম্পদ নয়, আপদ। শ্রমিকের অধিকার তখনই জন্মাবে, যখন সে তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করবে। আল্লাহ বলেছেন, “সর্বোত্তম শ্রমিক সে, যে শক্তিশালি ও আমানতদার।” (আল-কাসাস: ২৬)
সুতরাং, শ্রমিককে সঠিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে হলে তাকে অবশ্যই আমানতদার ও শক্তিশালি হতে হবে। শ্রমিকের সুস্থ দেহ ও ভালো মন থাকতে হবে। শ্রমিক তার সমস্ত শক্তি দিয়ে বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা কাজে লাগিয়ে মালিকের কাজ সুষ্ঠু ও নিখুঁতভাবে আনজাম দেবে।
নিম্নে একজন মুসলিম শ্রমিকের কতিপয় দায়িত্বের কথা উল্লেখ করা হলো:
০১. উদ্ধম ও আগ্রহসহ স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করা : কাজে অলসতা অপরাধ। আদর্শ শ্রমিক কখনও মালিকের দেওয়া দায়িত্ব পালনে অলসতা করে না। আল্লাহ বলেন, “তুমি কখনও বলো না এ কাজটি আমি আগামিকাল করব” (সুরা কাহাফ: ২৩)। আল্লাহর রাসুল (স.) বলেন, “আল্লাহ তায়ালা তাঁর ঐ বান্দাহকে অপছন্দ করেন যে, ইহকাল ও পরকালের কাজ থেকে বিমুখ।” (মেশকাত) দায়িত্ব যত ছোটই হোক না কেন, তা অবহেলা করা যাবে না, সুষ্ঠু ও যথাযথভাবে করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, “সুঁই-সুতাও পরিশোধ করে দাও এবং খেয়ানত থেকে নিজেকে রক্ষা কর। কেননা, কেয়ামতের দিন এগুলো প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে।” (নাসাঈ)
০২. মালিক প্রদত্ত কাজ সুন্দরভাবে করা : শ্রমিককে প্রতিটি কাজ সুন্দর ও নিখুঁতভাবে করতে হবে। ক্রেতা কোনোদিন বস্তু খরিদ করার পূর্বে বস্তুটির সৌন্দর্য, টেকসই ও নিপুণতা যাচাই করেই ক্রয় করে থাকে। বস্তুটির উপযুক্ত মূল্য পাওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্তও বটে। তাই মালিকের ব্যবসা তখনই টিকে থাকবে ও লাভ হবে, যখন বস্তুটি সুন্দর ও টেকসই করে তৈরি করা হবে। আল্লাহর বাণী, “এটা আল্লাহর কারিগরী, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে মজবুত ভাবে সৃষ্টি করেছেন। তোমরা যা কিছু করছো, তা তিনি অবগত আছেন। যে কেউ উত্তম ভাবে কোনোদিন নেক কাজ সম্পাদন করবে, সে উৎকৃষ্ট প্রতিদান পাবে” (সুরা-আন নামল: ৮৮-৮৯)। প্রিয় নবি (সা.) বলেছেন, “মজবুত ভাবে কাজ করা আল্লাহর নিকট পছন্দনীয়।” কোনোদিন একটি ক্ববরে কিছুটা উঁচু নিচু রয়েছিল। আল্লাহর রাসুল (সা.) এটা সমান করার নির্দেশ দিলেন। তিনি বলেন, “তোমরা যখন কোনোদিন জিনিস বানাও, তখন সেটার সৌন্দর্যের দিকে লক্ষ রেখ।” জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল যে, কবর ঠিক করে দিলে কি মৃত ব্যক্তির কোনোদিন উপকার হবে? তিনি জবাব দিলেন, “এতে তার লাভ বা ক্ষতি হবে না, তবে জীবিতদের চোখে তা সুন্দর দেখাবে।” (তাবাকাতে ইবনে সাদ) হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “সে শ্রমিক কতইনা উত্তম, যাকে আল্লাহ আপন ইবাদত ও তার মনিবের আনুগত্যের মধ্যে মৃত্যুবরণ করার তৌফিক দান করেছেন।” আল্লাহর বিধানের বিপরীত নয়, এসব সব কাজ সুন্দর, পরিপাটি ও উত্তম ভাবে সম্পাদন করলে মালিক-শ্রমিক সকলেরই উপকারে আসে। দেখতে ভালো লাগে, মানসিক প্রশান্তি মিলে, শ্রমিকের জন্য এভাবে কাজ করা ইবাদতও বটে।
০৩. মালিকের কল্যাণ কামনা করা : একজন মুসলিম শ্রমিক মালিকের কল্যাণ কামনাকারী হতে হবে। প্রিয় নবি (সা.) বলেন, “দাস যখন মুনিবের কল্যাণ কামনা করে এবং ঠিকভাবে আল্লাহর ইবাদত করে, তখন তাকে দ্বিগুণ সওয়াব দেওয়া হয়” (বুখারি ও মুসলিম)। মালিকের ব্যবসায় যাতে কোনো প্রকার ক্ষতি বা লোকসান না হয় বরং উত্তরোত্তর লাভ ও উন্নতি হয়, সেদিকে লক্ষ্য রেখে কর্মচারি আন্তরিকভাবে তার দায়িত্ব পালন করলে, এটা তার নিজের জন্যও কল্যাণকর হয়।
০৪. বেতনের অতিরিক্ত মজুরি গ্রহণ না করা : মহানবি (সা.) বলেন, “যাকে আমরা কর্মচারি নিযুক্ত করি এবং তার জন্য যে পারিশ্রমিক ধার্য করে দেই, সে যদি এর অতিরিক্ত গ্রহণ করে, তবে তা আত্মসাৎ হবে” (আবু দাউদ)। কাজ করার পূর্বে অবশ্যই মালিক-শ্রমিক কাজের ধরন, পরিমাণ ও মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। কাজ সম্পাদন করে চুক্তিমত পারিশ্রমিক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে, আল্লাহ এতে বরকত দেবেন। কাজ করার পর অতিরিক্ত মজুরি দাবি করা শ্রমিকের জন্য বৈধ নয়, তেমনি মজুরি কম দেওয়াও মালিকের জন্য বৈধ নয়।
০৫. পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা : শ্রমিককে নিজ পেশা সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিয়ে পেশা চালাতে হবে, অন্যথায় নিজের ও সংশ্লিষ্টদের মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন গাড়ি চালাবার প্রশিক্ষণ না নিয়ে বা দক্ষ না হয়ে গাড়ি চালালে নিজের ও যাত্রীদের মৃত্যু হতে পারে। তেমনি ডাক্তারি পেশায় প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকলে রোগীর মৃত্যু ও শিক্ষকতার পেশায় যথাযথ জ্ঞান না থাকলে একটি জাতির মৃত্যু অনিবার্য হতে পারে। তাই প্রত্যেক শ্রমিককে তার পেশায় উপযুক্ত জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিতে হবে।
০৬. নিষ্ঠার সাথে কাজ করা : উৎসাহ, উদ্দীপনা, সততা, নিষ্ঠাসহ কাজ করা আদর্শ শ্রমিকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আদর্শ শ্রমিকের ৩টি মৌলিক গুণ: ১. কর্মক্ষেত্রে যে সময় দেওয়ার কথা, এর চেয়ে একটু বেশি সময় দেওয়া, ২. যে কাজ করার কথা তার চেয়ে একটু বেশি কাজ করা এবং ৩. সকলের সাথেই উত্তম আচরণ করা। এ ব্যাপারে বিশ্বনবি (সা.) বলেছেন, যে তোমার সাথে ভাল আচরণ করে তুমি তার সাথে ভাল আচরণ করবে। যে তোমার সাথে মন্দ আচরণ করে তুমি তার সাথেও ভাল আচরণ করবে এবং সকলের উপকার করার চেষ্টা করবে।
০৭. ইসলাম পরিপন্থী কাজ না করা : মালিক ও শ্রমিক উভয়ই একই আল্লাহর দাস। তাই তাদের সবাইকে মহান আল্লাহর হুকুম যথাযথ ভাবে পালন করতে হয়। তাছাড়া, আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) এর অপছন্দনীয় কোনো কাজই তারা করতে পারে না। কোনো প্রকার অনৈতিক কাজ, অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা, ভাঙচুর, কাজ বন্ধ রাখা ইত্যাদি নৈরাজ্যকর কার্যক্রম ইসলাম সমর্থন করে না বিধায় মুসলিম শ্রমিক এসব অপকর্ম থেকে দূরে থাকবে। কারণ, প্রতিষ্ঠান বাঁচলে শ্রমিক বাঁচবে।
০৮. প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-কানুন মেনে চলা : শৃঙ্খলাই জীবন। কাজেই নিয়ম-কানুন ভঙ্গ করা মারাত্মক অপরাধ। কুরআন-হাদিস বিরোধী নয়, এমন প্রতিটি নিয়ম-কানুন মেনে চলা প্রতিটি শ্রমিকের অবশ্য কর্তব্য। পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম প্রাণী ও প্রতিটি অণু-পরমাণু থেকে শুরু কলে বিশাল প্রাণী এবং গ্রহ-নক্ষত্র, সূর্য, বায়ু, পানি সকলেই আল্লাহর দেওয়া নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলছে বিধায় কোনোদিন অশান্তি নেই। কাজেই শান্তি পেতে হলে শ্রমিক মালিক সবাইকেই নিয়ম-কানুন ঠিকমত মেনে চলতে হবে।
০৯. উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করা : ক্রমবর্ধমান জনশক্তির চাহিদা পূরণে অধিক উৎপাদনের বিকল্প নেই। যার যার অবস্থানে থেকে প্রত্যেক শ্রমজীবী মানুষকে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলেও অধিক উৎপাদনে সর্বাত্মক ও আন্তরিক চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
১০. সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো : বর্তমানে যে সময়টা অতিবাহিত হচ্ছে, তা আর জীবনে কোনোদিন ফিরে আসবে না, পাওয়া যাবে না। অথচ প্রতিটি মুহূর্তই আল্লাহর পছন্দের ভেতর না বাইরে অতিবাহিত হচ্ছে মৃত্যুর পর সে ব্যাপারে সকলকে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আখেরাতে পাঁচটি প্রশ্নের জবাব না দিয়ে কাউকে এক কদম নড়তে দেওয়া হবে না, ১. যৌবন কাল কোনোদিন পথে কাটিয়েছ? ২. জীবন কাল কোন পথে কাটিয়েছ? ৩. উপার্জন কোন খাত থেকে করেছ? ৪.অর্জিত উপার্জন কোন কোন খাতে ব্যয় করেছ এবং ৫. যতটুকু ইলম শিখেছ, সে অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছ?। সময় অত্যন্ত মূল্যবান। এ সময়ের মূল্য তখনই দেওয়া হয়, যখন সময় কাজে লাগিয়ে ভাল কিছু করা হয়। আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, অনন্ত কালের সুখের জন্য সময়কে কাজে লাগাব নাকি দুর্দশার পথে হাঁটব? মনে রাখবেন, অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। সময় কাটাবার জিনিস নয়, সময় খাটাবার জিনিস। সুতরাং মুসলিম শ্রমিক অলসভাবে শুয়ে-বয়ে কিংবা চা স্টলে বা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিয়ে গাল-গল্পে করে বা মোবাইল নিয়ে বাজে দৃশ্য দেখে সময় বা জীবনটাকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিবে না বরং অবসর থাকলে সময় কুরআন-হাদিস শেখার চেষ্টা করবে।
১১. অনর্থক কাজ থেকে দূরে থাকা : জান্নাতুল ফেরদাউসের উত্তরাধিকারীদের অন্যতম একটি গুণ হলো, তারা অনর্থক বা বেহুদা কাজ থেকে দূরে থাকে। যে কাজ দুনিয়া বা পরকালের কোনোদিন লাভ নেই, এমন অর্থহীন নাচ-গান, আমোদ ফূর্তি, খেলাধুলাতে আদর্শ শ্রমিক জড়াতে পারে না। কারণ, শ্রমিকরা আল্লাহর বন্ধু, তাঁরই দাস ও প্রতিনিধি। সেজন্য তারা আল্লাহর দাসত্ব করবে ও অন্যদেরকে তাঁর দাসত্ব করার জন্য আহ্বান করবে। তদুপরি তারা আল্লাহর নাফরমানিমূলক কোন কাজ করবে না, অন্যকেও তা করতে দেবে না। তারা আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে আল্লাহর আইন প্রতিষ্ঠার কাজে ব্যস্ত থাকবে। কাজেই অনর্থক কাজ করার তাদের সময় কোথায়?
১২. নামাজে বিনয়াবনত হওয়া : কাফের ও মুমিনদের মধ্যে পার্থক্য হল নামাজ। কাফের নামাজ পড়ে না, মুমিন নামাজ পড়ে এবং নামাজে নিষ্ঠাবান ও বিনয়ী হয়। আল্লাহ বলেন, “ঐ সমস্ত মুমিনরা সফল কাম হল, যারা নিজেদের নামাজে বিনয়াবনত হয়” (সুরা মুমিনুন: ২)। বুঝে শুনে নামাজে সুরা-কেরাত, দোয়া-দরূদ পড়লে এবং বাস্তব জীবনে সেগুলো মেনে চললে এ নামাজ নামাজিকে যাবতীয় অশ্লীল কার্যক্রম থেকে ফিরিয়ে রাখবে, ফলে সে সফল হবে।
১৩. সর্বদা আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করা : আল্লাহ ও রাসুল (সা.) যে কাজ ভাল বলে ঘোষণা করেছেন সে কাজকে মুসলিমগন ভাল বলে গ্রহণ করবে ও যে কাজ খারাপ বলে আখ্যা দিয়েছেন, সে কাজকে খারাপ বলে বর্জন করবে। এ ব্যাপারে পার্থিব যত ক্ষতি হয় বা যদি মনের বিরুদ্ধেও যায় কিংবা কোনো মানবগোষ্ঠীর বিরাগ ভাজন হলেও তা-ই করবে। অর্থাৎ সর্বদা আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর অনুগত হয়ে তারা জীবন-যাপন করবে।
১৪. সর্বদা ন্যায়ের পথে থাকা : মুসলিম শ্রমিকের দায়িত্বই হচ্ছে, অন্যায়-অবিচার ও জুলুম-শোষণ উচ্ছেদ করে ন্যায়-নীতি, ইনসাফ ও সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা। কাজেই মুসলিম শ্রমজীবী কখনো অন্যায় করা বা এর সমর্থন বা বরদাস্ত করতে পারে না। তারা সর্বদাই ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান নেয়।
১৫. যৌন বিষয়ে সংযমী থাকা : বিপরীত লিঙ্গের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ রয়েছে, এটা মানুষের সহজাত এবং আল্লাহ মানব জাতির বংশ জারি রাখার জন্যই তা করেছেন। এ আকর্ষণের মধ্যে অবশ্যই শালীনতা ও পবিত্রতা থাকতে হবে। বিবাহ ব্যতিত জন্তু-জানোয়ারের মত যৌনাচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমাজকেও এ ব্যাপারে পবিত্র রাখার দায়িত্ব আমাদের দেওয়া হয়েছে। তাই প্রত্যেককেই যৌন বিষয়ে কঠোর সংযমী হতে হবে।
১৬. নিজ পেশায় ট্রেড ইউনিয়ন করা : নিজের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, চাকরির নিশ্চয়তা বিধানে, বৈধ সুযোগ-সুবিধাসহ ন্যায্য দাবি-দাওয়া আদায়ের মজবুত সংস্থা হচ্ছে ট্রেড ইউনিয়ন। এ ইউনিয়ন করা দেশের সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকা মানে নিজের উন্নয়নের সাথে দুশমনি করা। তাই প্রতিটি মুসলিম শ্রমিকেরই নিজের স্বার্থেই ট্রেড ইউনিয়ন করা কর্তব্য।
১৭. ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়নে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা : শ্রমিকের হাতের ছোঁয়া ব্যতিত কোনো প্রকার উন্নয়ন তো দূরের কথা কারো পক্ষে সুষ্ঠুভাবে জীবন-যাপন করাও সম্ভব নয়। শ্রমিক ওষুধ তৈরি করেন, অথচ নিজেদের পরিজন-পরিজনের রোগের সময় মুখে ওষুধ দিতে পারে না। তারা পোশাক তৈরি করে কিন্তু তাদের স্ত্রী পরিবার পোশাকের অভাবে লজ্জা নিবারণ করতে পারে না। তারা খাদ্য তৈরি করে অথচ অনাহারে, অর্ধাহারে পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করে। কখনও মাসের পর মাস শ্রমিক মজুরি পায় না, ফলে রাজ পথে ভাত-কাপড়ের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়ন হলে শ্রমিক ন্যায্য প্রাপ্য পাবে এবং গায়ের ঘাম শুকানোর পূর্বেই তারা মজুরি পাবে। বছরান্তে লভ্যাংশসহ পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মানের সাথে জীবন-যাপন করার মত উপযুক্ত মজুরিও পাবে, ফলে শ্রমিকের মন ও স্বাস্থ্য ভাল থাকবে। সুতরাং প্রত্যেক শ্রমিককেই ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়নের জন্য একমাত্র পতাকাবাহী সংগঠন বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ইসলামি শ্রমনীতি বাস্তবায়নে পাগলের ন্যায় কাজ করতে হবে, অন্যথায় শ্রমিকের দুঃখ-দুর্দশা ঘুচবে না এবং ভাগ্যের পরিবর্তন আদৌ সম্ভব হবে না।
১৮. আমানতদার হওয়া : আল্লাহর রাসুল (সা.) প্রায়ই বলতেন, “যার চরিত্রে আমানতদারি নেই তার ঈমান নেই।” মালিক পক্ষের দেওয়া কাজ ও সময় গুরুত্বপূর্ণ আমানত, এ সম্পর্কে আল্লাহ হিসাব নিবেন, তাই মালিকের সাথে কৃত চুক্তি অনুযায়ী সময় দিয়ে কাজ করে আমানত রক্ষা করে ঈমান বাঁচিয়ে জান্নাতে যেতে হবে। কারণ ঈমান না থাকলে জান্নাতে যাওয়া যাবে না।
১৯. ওয়াদা পালন করা : কাজ হবে কথা অনুযায়ী। শ্রমিকের নিয়োগ পত্রের শর্তানুযায়ী তাকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, “যে ওয়াদা পালন করে না তার দ্বীন বা ধর্ম নেই। ওয়াদাও এক ধরনের ঋণ।” কাজের মজুরি, ধরন, সাইজ, পরিমাণ, কাজ সম্পন্ন করার সময়-সীমা, মজুরি পরিশোধের সময়, কাজের মান ইত্যাদি ঠিক রেখে কাজ যথাযথ সুন্দর ভাবে করে মালিকের সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করা শ্রমিকের কর্তব্য। তাছাড়া, মালিক শ্রমিক সকলকেই মূল মালিক আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা যা রুহের জগতে করা হয়েছিল, আল্লাহ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আমি কি তোমাদের রব নই? সবাই সমস্বরে বলে ছিলাম, হ্যাঁ, অবশ্যই আপনি আমাদের রব।” এ ওয়াদাও সবাইকে রক্ষা করতে হবে। আল্লাহকে রব মানার অর্থ, আল্লাহ একমাত্র উপাস্য, শুধু তাঁরই আদেশ-নিষেধ অনুযায়ী চলতে হবে, চলতে হবে রাসুল (সা.) এর দেখানো পথে। আল্লাহ ছাড়া কারো আইন বা হুকুম মানা যাবে না। তাই তাঁর আইন মানতে হলে সে আইন বিজয়ী করতে সংঘবদ্ধ চেষ্টা সাধনা করাই হচ্ছে আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা। মুসলিম শ্রমিকদের অবশ্যই এ ব্যাপারে তৎপর থাকতে হবে।
২০. সদা সত্য কথা বলা : “সত্যবাদিতা মানুষকে মুক্তি দেয়, মিথ্যা মানুষকে ধ্বংস করে।” আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) মুমিনদেরকে সর্বদা সত্য কথা বলতে নির্দেশ দিয়েছেন। যে মুখ দিয়ে কুরআন তেলাওয়াত করা হল, নামাজ ও তাসবিহ পড়া হয় সে মুখকে মিথ্যা দ্বারা কলুষিত করা যায় না। তাই মুসলিম শ্রমিক মাত্রই সদা সত্যভাষী হতে হবে।
২১. সাদা-সিধা জীবন-যাপন করা : “সরল ও সাদা-সিধা জীবন-যাপন করা ঈমানের অংশ” (আবু দাউদ)। শ্রমিকরা অল্পে তুষ্ট। তাদের চরিত্র হবে উন্নত আর জীবন-যাপন হবে সহজ-সরল। অযথা জাঁকজমক আল্লাহ ও রাসুলের নিকট অপছন্দনীয়। আল্লাহর রাসুল নিজেও শ্রমজীবী ছিলেন। তিনি নিজ হাতে বকরি দোহন, জামা-জুতো সেলাই করতেন, জামা-কাপড় ধৌত করতেন, ঘর ঝাড়– দিতেন, স্ত্রী ও অন্যদের কাজে সহায়তা করতেন এমনকি সফরেও তিনি গাছ কেটে লাকড়ি যোগাড় করতেন। তিনি অত্যন্ত সরল ও অনাড়ম্বর জীবন-যাপন করতেন। তাই রাসুলের উত্তরাধিকারি হিসেবে আমাদেরকেও সরল-সহজ জীবন-যাপন করতে হবে।
২২. নম্র-ভদ্র স্বভাবের অধিকারী হওয়া : বিশ্ব নবি ও বিশ্ব নেতা অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র স্বভাবের অধিকারী ছিলেন। তিনি অহংকার, কঠোরতা ও দুর্ব্যবহার পছন্দ করতেন না। মানুষের দিকে গাল ফুলিয়ে রাখা, অহেতুক উচ্চস্বরে কথা-বার্তা বলা আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) দারুনভাবে অপছন্দ করতেন। তাই ঈমানদার প্রতিটি শ্রমিক ভাই-বোনকে রাসুল (সা.)-এর যোগ্য উম্মত হিসেবে নম্র ও ভদ্র হতে হবে। মনে রাখতে হবে, নিজেকে ছোট মনে করা অনেক বড়ো নেকির কাজ, আর নিজেকে বড়ো মনে করা শয়তানি স্বভাব ও বড়ো গুনাহ যার পরিণতি ভয়াবহ জাহান্নাম।
২৩. ধৈর্যশীল হওয়া : দুনিয়ার জীবনটা দুঃখ-কষ্ট ও অভাব অভিযোগে ভরপুর। এ পৃথিবীটা শ্রমিকের জন্য কারাগার। মালিক যখন ন্যায়-অন্যায় বাছ-বিচার না করে অবৈধভাবে শাসন ও শোষণ করে, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তখন অপরিসীম ধৈর্যের প্রয়োজন হয়। আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয়ই আমি ধৈর্যশীলদের সাথে আছি” (আল-বাকারা: ১৫৩)। দেশের স্বার্থে, প্রতিষ্ঠান ও নিজের স্বার্থে সকল অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট, শাসন-শোষণ সহ্য করে আন্তরিকতার সাথে কাজ চালিয়ে মুসলিম শ্রমিকের দায়িত্ব।
২৪. সুনীতির প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা : হারাম পথে উপার্জন করা, স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-রিসাওয়াত ইত্যাদি অনাচার ঈমানদার শ্রমিক সহ্য করবে না। তাই স্বীয় কর্মক্ষেত্র ও সমাজ থেকে যাবতীয় দুর্নীতি উচ্ছেদে তাকে ভূমিকা রাখতে হবে। তাদের দায়িত্বই হচ্ছে দুর্নীতির উচ্ছেদে ও সুনীতির প্রতিষ্ঠা। তাই মুসলিম শ্রমিক কখনও দুর্নীতির আশ্রয় নেবে না এবং কাউকে এই আচরণ করতেও দেবে না।
২৫. আল্লাহর ওপর নির্ভশীল হওয়া : ঈমানদার শ্রমিক হালাল উপার্জন করবে। ন্যায়ের পক্ষে ও অন্যায়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে পাক-পবিত্র জীবন-যাপন করবে এবং যাবতীয় বিষয়ে একমাত্র আল্লাহর ওপর ভরসা করবে। মুসলিম শ্রমিকদের বিশ্বাস, শুধু আল্লাহই রিজিক ও জীবন-মৃত্যু মালিক। তাই তাঁরই ওপর ভরসা করে হালাল রুজি করলে তিনি সব অভাব পূরণ করতে পারেন। কেননা, সকল প্রকার বিপদাপদ ও প্রতিকূল অবস্থায় কেবল আল্লাহই সাহায্য করতে পারেন। তাই দৈহিক শক্তি, জনবল, অর্থবল ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর নয় শুধু আল্লাহরই ওপর নির্ভর করা মুসলিম শ্রমজীবী মানুষের কর্তব্য।
২৬. কুরআন পড়া ও বুঝার চেষ্টা করা: মহান আল্লাহ বলেন, “পড় তোমার সৃষ্টি কর্তা প্রভুর নামে” (সুরা আলাক: ১-২)। সুতরাং পবিত্র কুরআন পড়া, বুঝা ও মানা প্রতিটি মুমিনের জন্যই ফরজ। কুরআন হচ্ছে ‘মাস্টার কী’। জীবন সমস্যার যে কোনোদিকে একে ফিট করলে, অমনি সফলতার দ্বার খুলে যায়। এ কুরআন নাজিল করা হয়েছে আমাদেরকে ভাগ্যবান করার জন্য, উন্নতির চরম শেখরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য, এটি আল্লাহর দেওয়া সবচেয়ে বড়ো নেয়ামত। তাই যারা কুরআন পড়তে পারেন, তারা বাংলায় অর্থ বুঝে পড়বেন, যারা পড়তে পারেন না তাদের শেখাবেন এবং কুরআনের আহ্বান অন্যের নিকট পৌঁছে দেওয়া প্রতিটি মুসলিম শ্রমিক ভাই-বোনের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
২৭. দ্বীনে হকের সাক্ষ্য দানকারী হওয়া: মানব রচিত মতবাদের দিন বয়ে গেছে। পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষ মতবাদ, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদি সবই সেকেলে, এ সমস্ত বস্তাপঁচা মতবাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে। পৃথিবীবাসি বুঝেছে, একমাত্র আল্লাহর দ্বীন ইসলামই সকল মানুষের ইহ ও পরকালীন সুখ-শান্তি দিতে পারে। যেমন আল্লাহর বায়ু, পানি, সূর্য সকল মানুষেরই সমভাবে কল্যাণ করছে ও বাঁচিয়ে রাখছে। আর যাই হোক মানব রচিত, পক্ষপাত দুষ্ট কোনো আইন কোনোদিন মানুষকেই শান্তি দিতে পারে না, পারবে না, পারার কথাও নয়। তাই আমরা প্রতিটি মুসলিম ভাই ও বোন ইসলামের বাস্তব অনুসারী হয়ে, ইসলামের সাক্ষ্য হয়ে নিজেদের জীবনে ইসলামের কল্যাণকর দিকগুলো বিকশিত করে দুনিয়াবাসীকে বুঝিয়ে দেব যে, ইসলামেই শান্তি, যাতে অন্যেরা ইসলামের কল্যাণকর দিক দেখে ইসলামে দলে দলে দাখিল হয়।
পরিশেষে বলব, শ্রমিকগণ ঠিকভাবে হক আদায় করে কর্তব্য কর্ম করলেই দেশ ও দশের উন্নতি হবে; তারাও অধিকার প্রাপ্ত হবে। সুতরাং শ্রমিক বন্ধুগণ! স্বীয় দায়িত্ব-কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করে নিজ ও দেশের ভাগ্য বদলাবেন, এ প্রত্যাশা আমাদের সকলেরই।
লেখক: সাবেক সভাপতি, নারায়ণগঞ্জ জেলা, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।