বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে যারা অন্য কোনো দেশে পাড়ি জমিয়েছেন তাদেরকে সাধারণত প্রবাসী বাংলাদেশী বলা হয়। ভালো পরিবেশে বসবাস করা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও পরিবারকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করার আশায় বাংলাদেশীরা প্রবাসে পাড়ি জমায়। নানা স্বপ্ন, যন্ত্রণা-কষ্ট, পাওয়া-না পাওয়া, আনন্দ-বেদনা নিয়েই প্রবাসজীবনে তাদের পথচলা। সাধ-আহ্লাদ, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বাবা-মা-স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠিয়ে স্বদেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেছেন আমাদের এই রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। প্রবাসী বাংলাদেশীদের মধ্যে সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়াও আরব বিশ্বের কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কাতার ও বাহরাইনে প্রচুর পরিমাণে বাংলাদেশী প্রবাসী বসবাস করে। সেইসাথে মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ব্রাজিল, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, মালদ্বীপসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণে প্রবাসী বাংলাদেশীদের বসবাস। প্রক্রিয়াটি শুধু বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি নয়, দেশে বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহের অন্যতম উৎস। ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এক কোটিরও বেশি শ্রমিক বিদেশে গেছেন। এখানে মধ্যপ্রাচ্যের ৯টি দেশে গেছেন প্রায় ৮০ লাখ। এর প্রায় ৪০ শতাংশ শ্রমিক গেছেন সৌদি আরবে। বাংলাদেশীরা সাধারণত টেকনিশিয়ান, গৃহস্থালী কর্মী, শ্রমিক, ব্যবসায়ী এবং চাকরিজীবী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে যায়। এছাড়া বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী ইঞ্জিনিয়ার এবং চিকিৎসক রয়েছে। প্রবাসীদের অনেকেই নানা রকম সমস্যার মুখোমুখি। দেশের নারী অভিবাসী কর্মীসহ সকলের মর্যাদা, সামাজিক সুরক্ষা ও সম্মান সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া একান্ত কর্তব্য। অভিবাসী কর্মীদের সেবা প্রদানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়-বিষয়ক সংসদীয় কমিটি এবং অন্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বৃহত্তর সমন্বয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বিশ্ব শ্রমবাজার ও বাংলাদেশ
জীবনমান উন্নয়ন এবং আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর অনেক লোক বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তারা উদয়াস্ত হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করে বৈদেশিক রিজার্ভকে সমৃদ্ধ করছেন। দেশের ব্যবসায়-বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডেও এ অর্থ ব্যয় হচ্ছে। বিশ্ব ব্যাংকের তথ্য মতে, রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ ব্যয় হয় দৈনন্দিন খরচের খাতে। এতে ওই পরিবারগুলো দারিদ্র্য দূর করতে পারে। রেমিট্যান্স পাওয়ার পরে একটি পরিবারের আয় আগের তুলনায় ৮২ শতাংশ বাড়ে। রেমিট্যান্স সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে পারে বিনিয়োগের মাধ্যমে। প্রবাসীদের পরিবার-পরিজন অধিকাংশ গ্রামে বসবাস করেন। ফলে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আয় ও সঞ্চয় বাড়ার কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা বাড়ছে।
প্রবাসী বাংলাদেশীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ার প্রেক্ষাপটে বাড়ে আমাদের রেমিট্যান্সও। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে বাংলাদেশ পৃথিবীর শীর্ষ ১০ দেশের একটি। ১৯৬৭-৭৭ সালে প্রবাসী ছিল মাত্র ১৪ হাজার। ২০০৭-০৮ সালে তা পৌঁছে ৯ লাখ ৮১ হাজারে। তবে ২০০৮ সাল ২০১৪-১৫ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা কমলেও ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের দিকে খানিকটা উন্নতি হতে শুরু করে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ১৯৭৬ থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ১ কোটি ২১ লাখ ৯৯ হাজার ১২৪ জন নারী ও পুরুষ কর্মী বৈদেশিক কর্মসংস্থান লাভ করেছেন। এর মধ্যে ২০০৯-২০১৮ সময়ে ৫৯ লাখ ৩৩ হাজার ৯৫ জন কর্মী বিদেশ গেছেন। তবে রেকর্ড পরিমাণ ১০ লাখ ৮ হাজার ৫২৫ জন কর্মী বিদেশ গেছেন ২০১৭ সালে। ২০২১ সালেই মোট ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন। ২০২২ সালে গেছেন ১১ লাখ ৩৬ হাজার। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৮ লাখ ৮২ হাজার বাংলাদেশী বিদেশে গেছেন। সরকারি হিসেবের বাইরেও অনেক বাংলাদেশী আছেন যাঁরা বিভিন্ন উপায়ে বিদেশে গেছেন এবং বৈধ-অবৈধভাবে সেখানে অবস্থান করছেন। তাই প্রবাসী কর্মীর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি হবে বলা যায়। আবার অনেকে প্রবাসে স্থায়ীভাবে সপরিবারে বসবাস করলেও নিয়মিত দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।
দেশের অর্থনীতির বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ থেকে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়ে দেশের মূল অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক হাজার ৮২০ কোটি ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন। ২০২০-২১ অর্থবছরে সব মিলিয়ে প্রবাসী আয় এসেছিল প্রায় দুই হাজার ৪৭৮ কোটি ডলার। এটা কেবল বৈধভাবে পাঠানো টাকার হিসেব। এর বাইরে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে আসে বিভিন্ন উপায়ে। এর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে হুন্ডি।
ইতোমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সুবিধাসৃষ্টির চেষ্টা চলছে। মানব পাচার বন্ধে ২০১২ সালে আইন প্রণীত হয়েছে। ২০১৩ সালে নিরাপদ অভিবাসন আইন প্রণীত হয়েছে। রিক্রুটিং এজেন্সির কার্যকলাপ দেখে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়কে দেখার জন্য আছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। মালদ্বীপে কর্মরত অভিবাসী শ্রমিকের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন হয়েছে। তবে কর্মপরিবেশ-সংক্রান্ত এবং তাদের কর্মসংস্থান ম্যাট্রিক্সের নানা দিকে তারা বিভিন্ন জটিলতার মুখোমুখি হয়ে আসছেন। প্রবাসীদের কল্যাণ ও তাদের সমস্যাসমূহ সমাধানের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে প্রবাসী কল্যাণ শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। প্রবাসীগণ হয়রানির শিকার হলে এই শাখার মাধ্যমে তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। কোনো প্রবাসী বিদেশে মৃত্যুবরণ করলে তাদের উত্তরাধিকারীগণকে সহজে আর্থিক সুবিধা প্রদানে প্রবাসী কল্যাণ শাখা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে।
ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড প্রবাসী কর্মী ও তাঁদের পরিবারের সুরক্ষায় অনেক সেবা দেয়। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে বঙ্গবন্ধু ওয়েজ আর্নার্স সেন্টার আছে। সেখানে প্রবাসী কর্মীদের জন্য নিরাপদে মাত্র ২০০ টাকায় আবাসনের সুযোগ রয়েছে। ২০২৩ সালের আগস্ট পর্যন্ত ২ হাজার ৯৩ জন প্রবাসী কর্মী এ সেবা গ্রহণ করেছেন। বিদেশফেরত অসুস্থ কর্মীদের সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা করে চিকিৎসা সহায়তা প্রদান করা হয়। প্রবাসী কর্মীর মেধাবী সন্তানদের এসএসসি ও এইচএসসি ক্যাটাগরিতে বার্ষিক যথাক্রমে ২৭ হাজার ৫০০ ও ৩৪ হাজার টাকা শিক্ষাবৃত্তি প্রদান করা হয়। প্রবাসী কর্মীর প্রতিবন্ধী সন্তানদের মাসে ১ হাজার টাকা ভাতা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া বিদেশ থেকে মৃতদেহ দেশে আনা, লাশ পরিবহন ও দাফন বাবদ ৩৫ হাজার টাকা প্রদান এবং মৃতের পরিবারকে ৩ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদানসহ বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়। কর্মীদের মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ, বকেয়া বেতন ও ইনস্যুরেন্সের অর্থ আদায়ের জন্য দূতাবাসের সহায়তায় মামলা পরিচালনা করা হয়। ক্ষতিপূরণ মামলার কাগজপত্র তৈরিতে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডে একটি লিগ্যাল সেল রয়েছে। এর মাধ্যমে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি তৈরিতে কর্মীদের পরিবারকে সহায়তা করা হয়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে বিদেশগামী সব কর্মীকে বীমার আওতায় আনা হয়েছে। ২০২৩ সালের বছরের জুলাই পর্যন্ত বিমাকৃত কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ ৭৯ হাজারের বেশি। শ্রমকল্যাণ উইংয়ের মাধ্যমে আইনগত সহায়তা প্রদান করা ও শ্রম কল্যাণ উইংয়ে প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়।
২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সুইস এজেন্সি ফর ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কো-অপারেশন ও হেলভেটাস-এর সহযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি ও প্রথম আলোর আয়োজনে ‘অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের সুযোগ : আমাদের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা ও ন্যায়বিচারের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়েছে। সরকার প্রদত্ত সুবিধাসমূহের যথাযথ ব্যবহার নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।
প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রধান দায়িত্ব শ্রমকল্যাণ উইংয়ের। বিশ্বের ১৬৮টি দেশে বাংলাদেশী কর্মীরা গেলেও তাঁদের সুরক্ষা ও অধিকার রক্ষায় ২৬টি দেশের বাংলাদেশ মিশনে শ্রমকল্যাণ উইং আছে মাত্র ২৯টি। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব এবং ইতালিতে দুটি করে শ্রমকল্যাণ উইং আছে। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের ব্যবহারের জন্য সরকার এখন ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনার ব্যবস্থা করেছে এবং অর্থ পাঠানোর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে সহজ করা হয়েছে। কিন্তু এর পরও প্রবাসীরা বাংলাদেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হুন্ডিকে প্রাধান্য দেন। ২০০৬ সালে গ্লোবাল ইকোনমিক প্রসপেক্টের (জিইপি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে পাঠানো প্রবাসী অর্থের ৫৬ শতাংশই আসে হুন্ডির মাধ্যমে। প্রবাসীদের হুন্ডি ব্যবহারের প্রবণতার অনেক কারণ আছে। ব্যাংকের চেয়ে বেশি অর্থ পাওয়া ও কোনো জটিলতা না থাকা প্রধানতম। তবে অনেক অবৈধ প্রবাসী আছেন যাঁরা প্রয়োজনীয় কাগজের অভাবে বাধ্য হয়েই হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। কিন্তু এর বাইরেও কিছু বিষয় আছে, যা প্রবাসীরা বিবেচনায় নিয়ে থাকেন। বিদেশে থাকাকালে সংশ্নিষ্ট বাংলাদেশী দূতাবাসের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না পাওয়া, দেশের বিমানবন্দরে নাজেহাল হওয়া, লাগেজ চুরি বা হয়রানি ইত্যাদি বিষয় তাঁদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে; যা অস্বীকার করার উপায় নেই। পাসপোর্ট নবায়নে মাসের পর মাস লাগে; ফলে অনেকের কর্মক্ষেত্রে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। আবার বিদেশে থাকাকালে কোনো ধরনের সমস্যা হলে ওই দেশের বাংলাদেশী দূতাবাসের অবহেলা করার অভিযোগও রয়েছে। এমনকি প্রবাসে দেশের দূতাবাসের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করতেও বিড়ম্বনা পোহাতে হয় বলেই অনেকে বলেন। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে থাকা অদক্ষ বা স্বল্প শিক্ষিত শ্রমিকদের এমন অভিজ্ঞতা অনেক। এমনকি বিভিন্ন সেবার ফি নিয়েও আছে তাদের অভিযোগ।
প্রবাসী বাংলাদেশীদের চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকদের বিশাল অংশের গন্তব্য মূলত সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, ইরাক, লিবিয়া, বাহরাইন, ওমান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কোরিয়া, ব্রুনাই, মরিশাস, স্পেন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, লেবানন ইত্যাদি কয়েকটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রবাসীরা প্রায় সময় নানাভাবে বঞ্চনা, শোষণ, অবহেলা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। কখনও কখনও নির্যাতিত হচ্ছেন আবার অনেকেই ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো কোনো দেশের কারাগারে বাংলাদেশীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন।
অভিযোগ আছে যে, বাংলাদেশী প্রবাসীদের সুরক্ষা নেই, ন্যায়বিচার নেই, মর্যাদা নেই। বিদেশি দূতাবাসে সাধারণ মানুষের জন্য যে বাথরুম, সেখানে দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসবে। অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণের ক্ষেত্রে একটা চক্র রয়েছে। পাসপোর্ট অফিস থেকে এটা শুরু হয়। বিদেশে যাওয়ার জন্য খোঁজখবর নেওয়া, যাওয়ার প্রস্তুতি, বিদেশে পৌঁছানো, কোনো কারণে বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর পুনঃঅন্তর্ভুক্তকরণ; এ ধরনের প্রতিটি পর্বেই সমস্যা। বিদেশে যাওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ সাধারণত যে দালাল ধরেন, সেই দালাল নিজেও কিছু জানেন না। বিএমইটিতে তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিতে হয়। কিন্তু এখানে যাঁরা প্রশিক্ষণ দেন, তাঁদের বিদেশে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে।
নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি প্রবাসী বাংলাদেশীরা। অনেক সময় দালালের খপ্পরে পড়ে এক সময় ভিসা পাসপোর্ট সবই হারাতে হয়। আবার আমাদের দূতাবাসের পক্ষ থেকেও সঠিক সময়ে সঠিকভাবে সহযোগিতা না পাওয়ায় ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে সাধারণ প্রবাসীদের। পত্রিকায় প্রায়ই দেখা যায় যে শ্রমিকেরা প্রতারিত হয়েছেন। নৌকায় সাগর পাড়ি দিয়ে কোনো একটি দেশে যাওয়ার সময় পানিতে ডুবে মৃত্যু হচ্ছে। আবার নির্দিষ্ট দেশে যাওয়ার পর দেখা গেল, সেখানে তাঁদের কাজ নেই। তাঁদের কোনো একটি এলাকায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশগামীদের অধিকাংশই অদক্ষ হওয়ায় বাংলাদেশের প্রবাসী শ্রমিকরা হাড়ভাঙা খাটুনি করেও ন্যায্য বেতন পাওয়ার ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অভিবাসন একধরনের ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। যাঁরাই অভিবাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাঁরাই এখানে মুনাফা করছেন। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়ার খরচ সবচেয়ে বেশি। আবার তাঁদের বেতন সবচেয়ে কম। বিদেশে এক রুমে অনেককে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। বিদেশের পুলিশ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য দেশের নাগরিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার সাহস দেখায় না। কারণ, ওই সব দেশ প্রতিক্রিয়া দেখায়। যে কোনো দেশেই দূতাবাসের সামনে আমাদের শ্রমিকদের লম্বা লাইন; রোদ বৃষ্টিতে তাঁরা কষ্ট পাচ্ছেন। প্রতারণার ব্যবসাও বেশ চোখে পড়ার মতো। মানুষ নৌপথে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার পথে মিয়ানমারে আটক আছেন। তাঁদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হচ্ছে। অনেকেই তিন মাসের ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে গেছেন। তাঁদের বলে দেওয়া হয়েছে যে মালয়েশিয়া, দুবাই বা সৌদি আরবে যাওয়ার পর ওয়ার্ক পারমিট করতে পারবেন। কিন্তু সরকারের কাছে কোন হিসেব থাকে না যে, কতজন ওয়ার্ক পারমিট পেয়েছেন, কতজন ফেরত এসেছেন বা কতজন জেলে আছেন। তারা শুধু বিদেশে পাঠাচ্ছে। ফলে অনেকেই বিপদে পড়ছেন। তাঁদের মানবাধিকারের কোনো বিষয় থাকে না।
অভিবাসীগণ সাধারণত যে ধরনের কাজ নিয়ে তাঁরা যান, সেটা পান না। তাঁদের থাকা-খাওয়ার সমস্যা রয়েছে। অনেককে জোর করে দেশে পাঠানো হয়। আবার অনেকে টিকতে না পেরে ফেরত আসেন। অনেক ক্ষেত্রে এজেন্টরা টাকা নিয়ে বিদেশে পাঠায় না, লেবার ভিসার কথা বলে অন্য ভিসা দিচ্ছে। অনেক বেতনের কথা বলে কম বেতন দিচ্ছে। ওভার টাইমের পারিশ্রমিক পাচ্ছে না। বিমানবন্দরে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় অভিবাসী শ্রমিকের মালিকেরা তাঁদের পাসপোর্ট আটকিয়ে রাখেন। অনেকে ঠিক সময় বেতন পান না। কোভিডের সময় যাঁরা ফেরত এসেছেন, তাঁদের অনেকেই বেতন পাননি।
মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসনের ভয়াবহ প্রভাবে একদিকে যেমন অভিবাসী শ্রমিকদের হুমকিতে ফেলছে। অন্যদিকে হাজারো অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীকে বিপজ্জনক সাগরপথের মধ্য দিয়ে ইউরোপে আশ্রয় লাভে বা অনুপ্রবেশে প্ররোচিত করছে। এতে অনেকের যেমন মৃত্যু হচ্ছে, তেমনি অনেকেরই জেল-জরিমানাও হচ্ছে। এটা মর্মান্তিক। এক্ষেত্রে প্রায়ই প্রস্থান পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছে লিবিয়া ও তুরস্কের সমুদ্র উপকূলবর্তী বেলাভূমি। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অসামর্থ্যের কারণে অবনতি হচ্ছে। শরণার্থীদের সুরক্ষায় নিয়োজিত ইউএনএইচআর ও এর সহযোগী এজেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন (আইওএম) এ নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থা, বিশেষত জিম্মি দশার কেন্দ্রগুলোয় কোনো সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। যদিও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ভূমধ্যসাগরের মধ্য দিয়ে অভিবাসীদের প্রবেশ প্রতিরোধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তারা বলেছে, ‘সংস্থাটি বৈশ্বিক অভিবাসন বন্ধ করতে চায় না; বরং তারা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সুচারুভাবে সামলাতে আন্তর্জাতিক সহযোগী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করতে, অভিবাসীদের মানবাধিকার নিশ্চিত, মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে অনিয়মিত বিপজ্জনক যাত্রা প্রতিরোধ এবং আইনসম্মত ও বৈধ পথের সুযোগ সৃষ্টি করতে চায়।’ তারা ‘বিভিন্ন চ্যানেল এবং একটি বহুপক্ষীয় কৌশলের মাধ্যমে বৈশ্বিক অভিবাসনের বিষয়টি সমাধানের’ ওপরও দৃষ্টি দিয়েছে। ফলে এটা অবৈধ অভিবাসীদের প্লাবন কিছুটা কমিয়েছে।
বাংলাদেশী নারী শ্রমিকদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। অধিকাংশ নারী দেশে কষ্টকর জীবন কাটাতে কাটাতে বিদেশে কাজ করতে যান। অথচ তাঁদের অনেকেই বিধ্বস্ত স্বপ্ন নিয়ে দেশে ফিরে আসেন। বিশ্বের ১৬৯টি দেশে প্রায় ১০ লাখ নারী। প্রায় ৭০ হাজার নারী কাজ করছেন সৌদি আরব ও জর্ডানে। এসব দেশে নারী শ্রমিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে অহরহ। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ফিরে আসা ব্যক্তিদের ৩৫ শতাংশ নির্যাতনের শিকার এবং ৪৪ শতাংশ নারী বেতন পাননি। অধিকার সচেতনতা ও বেতনে দর-কষাকষির দক্ষতা না থাকায় ওই সব দেশে ফিলিপাইনের নারীদের তুলনায় আমাদের নারী শ্রমিকদের বেতন কম এবং তাঁরা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন।
২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) গবেষণায় এ বিষয়ে কিছু অনুসন্ধান উঠে এসেছে। ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ৩২৩ জনের মধ্যে ৫৫ শতাংশ অভিবাসী নারী শ্রমিক কর্তৃপক্ষের কাছে বিভিন্ন মাত্রায় নির্যাতনের কারণে হয় অপ্রত্যাশিত অথবা বাধ্য হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। এরমধ্যে ২২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী কর্মী অভিবাসনের এক বছর শেষ হওয়ার আগেই চলে এসেছেন। অন্যদিকে প্রায় ১৭ দশমিক ৬ শতাংশ নারী শ্রমিক এক ও দুই বছর এবং ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ দু-তিন বছরের মধ্যে চলে এসেছেন। ফিরে আসা ৩৮ শতাংশই শারীরিকভাবে নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। আবার ৫২ শতাংশই বলপূর্বক শ্রমের শিকার হয়েছেন। অনেকেই ফিরে এসেছেন খালি হাতে ঋণের ভার নিয়ে। বিদেশফেরত নারী কর্মীদের প্রায় ৬১ শতাংশেরই জনপ্রতি ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৬ হাজার টাকা। তাদের অধিকাংশই সামাজিক কলঙ্কের পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুরবস্থার নতুন চ্যালেঞ্জেরও মুখোমুখি হচ্ছেন।
আমাদের দেশের নারীরা প্রায় কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ও প্রস্তুতি ছাড়া বিদেশে যাচ্ছেন। এ জন্য তাঁরা গৃহকর্মীর কাজ ছাড়া আর তেমন কিছু করতে পারেন না। বিদেশে নানা কারণে তাঁরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে বেতন পাচ্ছেন না। আমাদের জেন্ডার সংবেদনশীল নীতিমালা করতে হবে। দায়িত্ব ও দায়বদ্ধতা শুধু প্রেরণ ও গ্রহণকারী দেশের মধ্যে থাকছে না। জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত বিদেশে প্রায় ১৫০ জনের বেশি আত্মহত্যা করেছেন। সালমা আলী একটা অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘হবিগঞ্জের একটা মেয়ের বয়স ১৪ বছর। তাকে ২৭ বছর বয়স দেখিয়ে তার পাসপোর্ট করা হয়েছে। তারপর তাকে বিএমইটির সব নিয়ম মেনে সৌদি আরব নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সেখানে সে নানা নির্যাতনের শিকার হয়ে আইওএমের সহযোগিতায় দেশে ফিরেছে। বিমানবন্দরে আমরা তাকে গ্রহণ করেছি।’ আরও অনেক ছোট মেয়ে বিদেশে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। প্রতিবছর কতজন শ্রমিক মারা যান, কেন মারা যান, ক্ষতিপূরণ আদায়ের সর্বশেষ অবস্থা কী, কর্মীরা বিপদে পড়েছেন কি না, এ সবের বিস্তারিত প্রতিবেদন লেবার উইং থেকে দেওয়ার কথা থাকলেও এ কাজ ঠিকমতো হয় না।
২০০৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৪৭ হাজার ৭২৪টি মৃতদেহ বাংলাদেশে এসেছে। এ ক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে এসেছে ২৭ হাজার ২৩১ জন। স্ট্রেনদেন্ড অ্যান্ড ইনফরমেটিভ মাইগ্রেশন সিস্টেম (সিমস) এর পক্ষ থেকে নাফিজ ইমতিয়াজ হাসান জানান, গত ১৪ বছরে প্রতিদিন গড়ে ৯টি মৃতদেহ বাংলাদেশে এসেছে। এসব মৃতদেহের দ্বিতীয়বার কোনো তদন্ত হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে এর সঠিক তদন্ত দরকার। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার দিক থেকে এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। স্ট্রেনদেন্ড অ্যান্ড ইনফরমেটিভ মাইগ্রেশন সিস্টেম (সিমস) কর্তৃক জরিপ প্রকল্পের আওতায় নরসিংদী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামে ১ হাজার ৩৫৯টি অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার ৯৪ শতাংশ অভিযোগ পুরুষদের কাছ থেকে, ৬ শতাংশ অভিযোগ এসেছে নারীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে ২৮ শতাংশ প্রতারণা, ৩৫ শতাংশ চুক্তি না মানা, ২২ শতাংশ মৃত্যু, ভিসা, ইমার্জেন্সি সাপোর্ট ৬ শতাংশ এবং অন্যান্য ৯ শতাংশ। দুর্বল দালিলিক তথ্যের জন্য অনেক ক্ষেত্রে মামলা ফলপ্রসূ হয় না। তখন আবার তাঁরা মানসিক চাপে ভোগেন। অভিবাসীরা আদালতে মামলা করলেও দীর্ঘসূত্রতার জন্য অনেক সময় তাঁদের হতাশ হতে হয়।
বাংলাদেশে শ্রমিকদের দক্ষ করে গড়ে তোলা হচ্ছে না। মালয়েশিয়া বিমানবন্দরে বাংলাদেশের সুইপার, ভেনিসে কুলি। এমনও অভিবাসী আছেন, যিনি তিনবার সাগর পাড়ি দিয়ে বিদেশে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি চতুর্থবারও যেতে চেয়েছেন। আরেকজন ৮৮ লাখ টাকা খরচ করেও প্রতারিত হয়েছেন। আমাদের কর্মীরা নির্যাতনের শিকার হলে যতটুকু সহায়তা পাওয়ার কথা, সেটা তারা দূতাবাসে বা দেশে ফিরে পাচ্ছে না। অথচ মালয়েশিয়ার এক পুলিশ সদস্য এক ভারতীয় শ্রমিকের পাসপোর্ট ছুড়ে ফেলায় মালয়েশিয়াকে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। আমাদের বিএমইটি, বিমানবন্দর, দূতাবাস, এরা যদি অভিবাসী শ্রমিকদের সম্মান না দেয়, তাহলে বিদেশের মানুষও আমাদের অভিবাসীদের মর্যাদা দেবে না।
প্রবাসী কল্যাণে আমাদের করণীয়
প্রবাসীরা প্রায় সময় নানাভাবে বঞ্চনা, শোষণ, অবহেলা ও নিগ্রহের শিকার হচ্ছেন। কখনও কখনও নির্যাতিত হচ্ছেন আবার অনেকেই ন্যায়বিচার থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো কোনো দেশের কারাগারে বাংলাদেশীরা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা যাতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার না হয় সেজন্য সরকারের দেশ-বিদেশে তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা আবশ্যক।
অভিবাসনের ক্ষেত্রে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ বিভাগের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ভূমিকা রয়েছে। কোনো একটা সমস্যা হলে এক মন্ত্রণালয় আরেক মন্ত্রণালয়ের ওপর দায় চাপায়। আবার প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বাজেট কম। একইভাবে শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়েরও বাজেট কম। অভিবাসী শ্রমিকের সুরক্ষা, ন্যায়বিচার ও নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে নির্বাচনী দলগুলোর ম্যানিফেস্টোতে থাকতে হবে। প্রবাসীকল্যাণ, পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়মিত সমন্বয় মিটিং করা উচিত। এসব মন্ত্রণালয় বিদেশে কর্মরত কর্মীদের জন্য সে দেশের দূতাবাস কী করছে, সেটা খোঁজ নিতে পারে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের দিকনির্দেশনা দিতে পারে, দায়বদ্ধ করতে পারে। অভিবাসনের ক্ষেত্রে সুশাসন ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
প্রবাসী দেশের জবাবদিহির জায়গা নেই। প্রবাসী দেশের আইনি প্রয়োগ কার্যকর করতে হবে। আমাদের দ্বিপক্ষীয় চুক্তি নেই। আছে সমঝোতা স্মারক। একজন ক্ষতিগ্রস্ত অভিবাসীকে যে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় তা কোনোভাবেই যথেষ্ট নয়। বিদেশে কোন কর্মী মারা গেলে সে দেশের সরকার, বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে।
বিদেশি শ্রমিকের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শ্রমিক যাচ্ছেন সৌদি আরবে। তাহলে অন্তত এই দেশের সমস্যা নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করা দরকার। কর্মীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকার সৌদি আরবের কিছু শহরে আইনি ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করতে পারে। ২০২০ সালে রিক্রুটিং এজেন্সির মান নির্ধারণের জন্য একটা বিধি হয়েছে। এই বিধি মোতাবেক রিক্রুটিং এজেন্সির মান নির্ধারণ করা হচ্ছে না। এসব বিষয়ে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
বিদেশে কর্মীদের নিজের অর্থ খরচ করেই আইনি সহায়তা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশী দূতাবাস অভিবাসীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নিতে পারে। অভিবাসীদের সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনালের বিষয়টি সরকারকে ভাবতে হবে। বিদেশের মাটিতে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আইএলও কনভেনশনের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আইনি সুরক্ষা পাওয়ার জন্য স্থানীয় ল ফার্মগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। বিদেশে নারীদের হেল্পডেস্ক বাড়াতে হবে। শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সচেতন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকের মর্যাদার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
বিশ্ব শ্রমবাজারে আজ আমাদের অন্যতম প্রতিদ্ব›দ্বী ভারত, চীন, নেপাল, ফিলিপাইন এবং শ্রীলঙ্কা। তুলনামূলক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে এসব দেশের শ্রমিকরা আমাদের দেশের তুলনায় বেশি দক্ষ। বিশ্ব শ্রমবাজারে আমাদের পাল্লা দিতে হলে অবশ্যই দক্ষ শ্রমিক তৈরি ও নিয়োগে সবচেয়ে বেশি মনোযোগী হতে হবে। এক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী যথাযথ সরকারি উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের এক্ষেত্রে একটি সুষ্ঠু ও সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে এগোতে হবে। বাংলাদেশের বিদেশগামী শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে বিদেশে পাঠানো হলে তারা আরও ভালো বেতনে চাকরি লাভের সুযোগ পাবেন। দেশও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হবে। এ ক্ষেত্রে রিক্রুটিং এজেন্টদের মুনাফা বাণিজ্য কমাতে হবে। বিদেশে নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করণে আরো সতর্ক হতে হবে। যিনি কাজে যাচ্ছেন, তাঁরও ওই দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, কাজের ধরন, উপযোগী দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণসহ সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কারিগরি শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করতে হবে। আমাদের ১৫০টির মতো বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কয়েক শ পলিটেকনিক আছে। বিদেশ থেকে যাঁরা ফেরত আসছেন, তাঁরাসহ সবাই মিলে পরিকল্পনা করলে ভালো প্রশিক্ষণ দেওয়া কোনো বিষয় নয়। কিন্তু সরকার ইটপাথরের বাইরে কোনো চিন্তা করছে না। রাষ্ট্র দক্ষতা বৃদ্ধি ও সুশাসন দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
জাতীয় সংসদে নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে জোরালো আলোচনা করতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অভিবাসী শ্রমিকের প্রবাসে মৃত্যুর কারণ তদন্ত অত্যন্ত জরুরি। অভিবাসনের ক্ষেত্রে সুশাসন, মানবাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মজুরির পাশাপাশি শ্রমিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে সচেতন করতে হবে। নিরাপদ অভিবাসনের জন্য ফলপ্রসূ তদারক জরুরি। অভিবাসীদের সুবিচার নিশ্চিত করতে সরকারের আলাদা ট্রাইব্যুনাল করা উচিত। অভিবাসনসংশ্লিষ্ট সব পক্ষের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তাদের আরও কার্যকর ভ‚মিকা নিতে হবে।
বিদেশে বাংলাদেশী মিশনগুলো নিয়মিত সেখানে থেকে বাংলাদেশীদের সঙ্গে মতবিনিমিয় করবেন। তাঁদের সমস্যা জেনে সমাধানে কাজ করবেন। যেসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই, সেখানে থাকা কর্মীদের জন্য বিকল্প সেবা ও টাকা পাঠানোর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশে ফেরা প্রবাসী কর্মীরা যাতে বিমানবন্দরে কোনো ধরনের হয়রানির শিকার না হন, সেদিকটি নিশ্চিত করতে হবে। তাঁদের লাগেজ চুরি বা প্রতারকদের খপ্পরে পড়ে সব হারানোর ঘটনা কম নয়। তাই তাঁদের জন্য সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নিতেই হবে। একই সঙ্গে রেমিট্যান্স পাঠানোর ভিত্তিতে তাঁদের বিশেষ সুযোগ বা সম্মান দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। দেশে এলে তাঁদের জন্য বিমানবন্দরে বিশেষ ছাড় এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সুবিধা দিলে তাঁদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে বলে আশা করা যায়।
পরিশেষে বলা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স-প্রবাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে প্রবাসীরা মোট ১৭৩ কোটি ডলার অর্থ দেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু আগের অর্থবছরে একই মাসে এসেছিল ২১৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ গত সেপ্টেম্বর মাসে রেমিট্যান্স কমেছে ৪২ কোটি ৪৮ লাখ ডলার বা ১৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্স বিগত ১৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থায় রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কূটনীতিতে বিশেষ জোর দিতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে। দক্ষতা উন্নয়নের পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে বিদেশে আমাদের কর্মীদের জন্য বাড়তি কর্মসংস্থান তৈরি হবে। এক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি অর্জন করতে পারলে ইউরোপ, যুক্তরাজ্য, উত্তর আমেরিকাসহ এশিয়ার অন্য উন্নত দেশগুলোয়ও বাংলাদেশী নাগরিকদের চাহিদা বাড়বে বৈকি। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণের ক্ষেত্রে শ্রমিকরা যাতে হয়রানি ও প্রতারণার শিকার না হয় সেজন্য সরকারের দেশ-বিদেশে তদারকি ব্যবস্থাও জোরদার করা আবশ্যক। টেকসই উন্নয়ন এবং দরিদ্রতা কমাতে হলে বৈশ্বিক অভিবাসন বাজারে অব্যাহতভাবে জনসম্পদ পাঠানো এবং নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে দেশ-বিদেশে সরকারি মনিটরিং প্রয়োজন। দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি বৈদেশিক রেমিট্যান্স। এর গুরুত্বকে অনুধাবন করে জনশক্তি রপ্তানি খাতকে সরকারিভাবে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। জনসংখ্যার সমস্যাকে দক্ষ জনসম্পদে রূপান্তর করতে হবে। এক্ষেত্রে বিদেশ-গমনেচ্ছুদের জন্য প্রত্যেক জেলাতে একটি করে বিশেষায়িত কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করা এবং প্রশিক্ষিত শ্রমিকদের বিদেশ গমনের জন্য সহজশর্তে সরকারিভাবে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করে দেওয়া। জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে টাকার সমস্যা দূরীকরণে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি- বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কাজে লাগানো যেতে পারে।
লেখক: শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।