বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্রমিক অসন্তোষ বিশেষ করে গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের অসন্তোষ নতুন কোনো বিষয় নয়। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যখন আসন্ন, এমতাবস্থায় এ ধরনের একটি আন্দোলনের তৎপর্য অনেকটাই ভিন্নরকম এবং আরও বেশি ভিন্ন হতেও পারতো। দেশের সম্ভাবনাময় তৈরি পোশাক শিল্পখাতে চলমান শ্রমিক অসন্তোষের মূলে কাজ করছে নতুন মজুরি কাঠামো। আগের চেয়ে ৫১ শতাংশ মজুরি বাড়িয়ে করা নতুন কাঠামো কোনোভাবেই মানতে চান না শ্রমিকরা। আবার বাহ্যিক দৃষ্টিতে মেনে নিলেও নতুন কাঠামো নিয়ে আপত্তি রয়েছে মালিক পক্ষেরও। দেশজুড়ে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই তীব্র হয়ে উঠেছে শ্রমিক অসন্তোষ।
সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের গুলিতে দুই শ্রমিক নিহতের পর থেকেই বাড়তে থাকে অসন্তোষ। অন্যদিকে ন্যূনতম মজুরির দাবি আদায় না হওয়াতেও দিনে দিনে বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেন শ্রমিকরা। যা ধীরে ধীরে ঢাকার মিরপুর, আশকোনা, আশুলিয়াসহ গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানসহ দেশের আরও কিছু জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে। এরই মধ্যে শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ন্ত্রণে ৭ নভেম্বর পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। এতেও শ্রমিকদের দাবি পূরণ হয়নি। সরকার নির্ধারিত ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির সিদ্ধান্ত তারা প্রত্যাখ্যান করেন। আর এ কারণেই ন্যূনতম মজুরি ঘোষণার পরও দাবি আদায়ের আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আন্দোলন চালু রয়েছে। এই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই ৮ নভেম্বর গাজীপুরে বিক্ষোভে নামেন বেশ কয়েকটি গার্মেন্টের শ্রমিকরা। এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথেও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন তারা। এ সময় পুলিশের গুলিতে আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) নামের এক নারী শ্রমিক নিহত হন। দুপুরের এ ঘটনার পর শেষ বিকালে ফের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় পুলিশের এক সদস্যের হাতের কব্জি বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঘটনাও ঘটে।
পরিস্থিতির একপর্যায়ে গার্মেন্ট মালিকদের পক্ষ থেকেও বলা হয়, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের পরও শ্রমিকদের আন্দোলন দুঃখজনক। দাবি আদায়ে শ্রমিকদের আন্দোলনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধা, মালিকপক্ষের অনমনীয়তা, সবমিলিয়ে চরম পর্যায়ে যাচ্ছে পোশাক শ্রমিকদের মধ্যে বিদ্যমান অসন্তোষ। সমাবেশেরও ডাক দিচ্ছেন শ্রমিকরা। যা মোকাবিলা সরকারের জন্য অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হতে পারে বলেও ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য গাজীপুরের বিভিন্ন ফ্যাক্টরি এরই মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
এবারের শ্রমিক বিক্ষোভ দমনে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী রয়েছে জবরদস্তিমূলক কৌশলে। বিভিন্ন পত্রিকার অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঘোষিত মজুরি কাঠামো নিয়ে শ্রমিকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ থাকলেও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে সরকারের সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় নির্বাচনের আগে তারা কোনো জোরদার আন্দোলনে যায়নি। জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় তখন পোশাক কারখানা এবং শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোর ওপর কড়া নজরদারি আরোপ করে সরকার। গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য ছিল, নতুন মজুরি কাঠামোর বাস্তবায়ন নিয়ে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। জাতীয় নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে কোনো ধরনের শ্রমিক অসন্তোষের সৃষ্টি হলে সেটি জাতীয় নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে বলেও আশঙ্কা ছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। শিল্প পুলিশের পাশাপাশি শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় নজরদারি বাড়ায় গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
এরই মধ্যে র্যাব জানিয়েছে, শ্রমিক অসন্তোষ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। কোনো রাজনৈতিক দলের নাম উল্লেখ না করে র্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মোসতাক আহমেদ মিডিয়াকে বলেছেন, “শান্তিপ্রিয় শ্রমিকরা রাস্তাঘাট অবরোধ, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর করতে পারে বলে আমাদের মনে হয় না। আমরা বিশ্বাস করি, এর সঙ্গে অন্য শক্তি জড়িত। এটাতে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।” কর্ণেল মোসতাক আরও বলেন, “এরই মধ্যে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কিছু কুচক্রীমহল শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে পরিস্থিতি খারাপ করার চেষ্টা করছে। এজন্য ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পরিবেশ শান্ত রাখতে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি র্যাব সদস্যরাও কাজ করছেন। কিছু অসাধু বা কুচক্রীমহল কারখানা ভাঙচুর ও পরিবেশ অশান্ত করার চেষ্টা করছে। “গার্মেন্ট শিল্প আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটা যাতে কেউ অশান্ত করতে না পারে তার জন্য র্যাব-১ ও বিজিবি একসঙ্গে কাজ করছে। আমরা শ্রমিকদের কাজে ফেরানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছি।”
অন্যদিকে, শিল্প পুলিশের ডিআইজি মো. জাকির হোসেন খান বলেছেন, “গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিকের মজুরি বাড়ানোকে কেন্দ্র করে গাজীপুরে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। আমাদের কাছে তথ্য আছে ১২৩টি কারখানায় কমবেশি ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। বিভিন্ন থানায় ২২টি মামলায় এ পর্যন্ত ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শ্রমিকদের আন্দোলন কোনাবাড়িতে বেশি। আশুলিয়াতে কিছুটা আছে বা চট্টগ্রাম এলাকায় আন্দোলন নেই। কোনাবাড়িতে একটি গ্রুপ এখানে মদদ দিচ্ছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশ ও ইন্টিলিজেন্টস সেল আছে তারাও কাজ করছে।”
এ পর্যন্ত আলোচনায় এটি পরিষ্কার যে, চলমান শ্রমিক আন্দোলনের ভেতর একটি রাজনৈতিক ফ্লেভার আছে এবং সরকারি দল ও রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে এরকম একটি আন্দোলনের তথ্য আগে থেকেই ছিল। এবার চলমান আন্দোলনের যৌক্তিকতা একটু নিরুপণ করা যাক। পরবর্তী অংশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকার ওপরও আলোকপাত করা হবে।
মজুরি সংক্রান্ত রেকর্ড থেকে জানা যায়, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি সর্বপ্রথম নির্ধারিত হয়েছিল ১৯৮৫ সালে। এটি পোশাক শিল্পবিষয়ক প্রথম মজুরি বোর্ড। এ বোর্ড ঘোষিত শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ছিল ৬২৭ টাকা। পোশাক শ্রমিকদের জন্য দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড গঠিত হয় নির্ধারিত পাঁচ বছরের পরিবর্তে ৯ বছর পর, ১৯৯৪ সালে। দ্বিতীয় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ছিল ৯৩০ টাকা, যা প্রথম মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির ৪৮ শতাংশের অধিক। পোশাক শ্রমিকদের জন্য তৃতীয় মজুরি বোর্ড গঠিত হয় নির্ধারিত পাঁচ বছরের পরিবর্তে ১২ বছর পর, ২০০৬ সালে। তৃতীয় মজুরি বোর্ড ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ছিল ১৬৬২.৫০ টাকা, যা দ্বিতীয় মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির চেয়ে ৭৮ শতাংশের অধিক। চতুর্থ মজুরি বোর্ডটি নির্ধারিত পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে চার বছরের মাথায় ২০১০ সালে গঠিত হয়।
চতুর্থ মজুরি বোর্ড ঘোষিত সর্বনিম্ন মজুরি ছিল ৩০০০ টাকা যা তৃতীয় মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির ৮০ শতাংশের অধিক। চতুর্থ মজুরি বোর্ডের মতো পঞ্চম মজুরি বোর্ডটিও পাঁচ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার আগে তিন বছরের মাথায় ২০১৩ সালে গঠিত হয়েছে। পঞ্চম মজুরি বোর্ড ঘোষিত নিম্নতম মজুরি ছিল ৫৩০০ টাকা, যা চতুর্থ মজুরি বোর্ডের ঘোষিত মজুরির তুলনায় ৭৬ শতাংশের বেশি। আর এবার গঠিত ষষ্ঠ মজুরি বোর্ড আগেও মজুরি ৫১ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা নির্ধারণ করে।
কভিড পরবর্তী অর্থনৈতিক অবস্থা এবং বিশ্বজুড়ে এই মুহূর্তে একাধিক যুদ্ধ চলমান থাকায় দ্রব্যমূল্য ও জীবনযাত্রার ব্যয় যেভাবে বেড়েছে সেই বিচারে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি মোটেও যৌক্তিক হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই তাই পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৫০০ টাকা হওয়ার পরও সাভারের আশুলিয়ায় শ্রমিকদের ভেতর অসন্তোষ দেখা গেছে। কারখানায় প্রবেশ করে কাজ না করেই ফিরে যাচ্ছেন তারা। সকাল থেকে কয়েকটি কারখানায় শ্রমিকরা প্রবেশ করলেও তারা কাজে যোগ দেননি। শ্রমিকরা কারখানায় প্রবেশ করে কাজ না করে নিজ থেকে বেরিয়ে যান। আবার কিছু কারখানায় শ্রমিকরা কাজ শুরু করলেও আশেপাশের কারখানা ছুটি দিয়ে দেওয়ায় বিশৃঙ্খলার আশঙ্কায় তাদের কারখানায়ও ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়।
সাধারণ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অধিকাংশই নতুন মজুরিতে সন্তুষ্ট নন, মজুরি সাড়ে ১২ হাজার হলে কম হয়ে যায়। এতে আমরা খুশি নই। যদি একজন হয়, তাহলে হয়তো চলতে পারবে। তা না হলে বাসা ভাড়া, গ্যাস বিল ও অন্যান্য খরচ দিয়ে এই মজুরিতে চলা যায় না। মজুরি খুব বেড়েছে বলে মনে হয় না। চারজনের একটি পরিবার কোনোভাবেই বর্তমান বাজারে সাড়ে ১২ হাজার টাকা দিয়ে চলতে পারবে না। মজুরি বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রকারান্তরে মালিকপক্ষকে খুশি করারই প্রস্তাব।
বর্তমান মজুরির তুলনায় নিম্নতম মজুরি বাড়ছে মাত্র ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। অথচ ২০১৩ সালেই পোশাক খাতের নিম্নতম মজুরি ৭৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। যেখানে খাদ্য মূল্যস্ফীতি গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং গত ৪৬ বছরের মধ্যে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার সবচেয়ে বড়ো দরপতন হয়েছে, সেখানে ৫ বছরের আগের মজুরির চেয়ে মাত্র ৫৬ শতাংশ মজুরি বৃদ্ধি কোনোভোবেই পোশাক শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে না।
অন্যান্য দেশের মজুরির পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশে পোশাকশিল্পের বয়স চার দশকের বেশি সময় হলেও প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় এ খাতের শ্রমিকদের মজুরি সবচেয়ে কম। পোশাক শ্রমিকদের জন্য সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। সে সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ হাজার টাকা। ডলারের বিনিময় হার বিবেচনায় সে সময় ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। বর্তমানে সরকার নির্ধারিত ডলারের দাম বিবেচনায় নিলে মজুরি দাঁড়ায় ১১৩ ডলারের মতো।
চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীনে এ শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩০৩ ডলার। রপ্তানিতে বাংলাদেশের পরে আছে ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সিপিডির দেওয়া তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার ও ২৪৩ ডলার। এ দেশগুলোর সঙ্গে বিশ্বের একই বাজারে বাংলাদেশকে প্রতিযোগিতা করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব দেশের পোশাক কারখানার মালিকেরা পারলে বাংলাদেশের মালিকেরা কেন পারেন না?
কয়েক দশক ধরে বিশ্বে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের ব্র্যান্ডিং হলো সস্তা শ্রমের শ্রমিক। কিন্তু সেটা কতটা পর্যন্ত সস্তা হতে পারে? কত দিন পর্যন্ত সস্তা থাকতে পারে? কারখানার উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে হলে শ্রমিকদের খেয়ে-পরে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে হবে। যে জায়গায় তাঁরা থাকছেন, সেই বাসস্থানটা স্বাস্থ্যকর হতে হবে। কিন্তু যে মজুরিটা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, তাতে একজন শ্রমিকের পক্ষে তাঁর পরিবার নিয়ে ভালোভাবে টিকে থাকা কতটা সম্ভব?
ব্যবসা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তৈরি পোশাকশিল্প সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা পাওয়ার দিক থেকেও সবচেয়ে এগিয়ে। অন্যান্য শিল্পকারখানাকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে পোশাক কারখানার জন্য এই করের হার ১০-১২ শতাংশ। এ ছাড়া নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া ও শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পান পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এতটা সুবিধা পাওয়ার পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় শ্রমিকদের মজুরি দেওয়ায় এতটা পিছিয়ে থাকা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না।
আমাদের রাজনীতির বড়ো সংকট হলো, শ্রমিকদের দাবিগুলো এতটা ন্যায্য ও যৌক্তি হওয়ার পরও এই ইস্যুটি জাতীয় রাজনীতির একটি অংশ হয়ে উঠতে পারেনি। সরকারি দল যেহেতু ক্ষমতায় আছে এবং সামনেই জাতীয় নির্বাচন-তাই তারা যেনতেনভাবে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও মালিক পক্ষকে আস্থায় নিয়ে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা বিরোধী দলে আছেন, যারা সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলনে সক্রিয় রয়েছেন, তারা এই শ্রমিক অসন্তোষ এবং চলমান আন্দোলনকে নিজেদের আস্থায় নিতে পারলেন না, যা নিতান্তই দুঃখজনক।
জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দল এই বিষয়ে সরব হয়নি। সংসদের বাইরে প্রধান যে বিরোধী দল তারা এই ইস্যুকে লুফে নিতে পারেনি। অন্যান্য বিরোধী দলগুলো একটি বিবৃতি দিয়ে দায় সাড়ার চেষ্টা করলেও শুধুমাত্র শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে পৃথক কোনো অবস্থান নিতে পারেনি। শ্রমিক আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেনি। শ্রমিক সংগঠনগুলোর সাথে বসে চলমান বিরোধী দলের আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলনের মাঝে সমন্বয় করতে পারেনি। সাভারে একজন শ্রমিক এবং গাজীপুরে নারী শ্রমিক হত্যার পরও সমবেদনা জানানোর ক্ষেত্রে তারা কৃপণতা করেছেন। নিহত শ্রমিকদের পরিবারগুলোর পাশে গিয়ে তারা দাঁড়াতে পারেননি। চলমান অবরোধ যে রাজনৈতিক দাবিগুলোকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে সেখানে শ্রমিকদের যৌক্তিক মজুরি দেওয়ার দাবিটাও তারা সংযোজন করতে পারেননি।
রাজনীতি নিয়ে অনলাইনে অজস্র বিশ্লেষণ ও নানামুখী তৎপরতা চোখে পড়লেও শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি হাইলাইট হয়নি। বরং এভাবে বলা যায়, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে শ্রমিকদের আন্দোলন ও আত্মত্যাগের বিষয়টি উল্টো চাপা পড়ে গেছে। এতে করে আবারও বোঝা যায় যে, বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতি আসলে মানুষকে কেন্দ্র করে হয় না। যে পরিমাণ আগ্রহ ও তৎপরতা পরাশক্তিসহ নানা মহলের সমর্থন আদায়ের জন্য পরিচালিত হয় সেই তুলনায় শ্রমিক ও মজলুম মানুষগুলোর সমর্থন পাওয়ার জন্য খুব কম চেষ্টাই করা হয়। মানুষের জন্য রাজনীতি করার দাবি যারা করেন তাদের এই নিষ্ক্রিয়তা কার্যত তাদের নৈতিক অবস্থানকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে। শ্রমিকদের আন্দোলনকে জাতীয় ইস্যুতে পরিণত করার সুযোগ বিরোধী দলগুলো হাতছাড়া করলো বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
অনেকেই মনে করেন, সরকারি দল বিভিন্ন স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমস্যার ফায়দা নিচ্ছে। কথাটি হয়তো সত্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিরোধী দলগুলোও এরকম সুযোগ নিতে পারতো। কিন্তু সুযোগ নেওয়ার জন্য যে উদার মানসিকতা, দূরদর্শিতার প্রয়োজন ছিল সেক্ষেত্রে যথেষ্ট ঘাটতি থাকার বিষয়টি এবার আবারও স্পষ্ট হয়েছে। বিরোধী দলের চূড়ান্ত আন্দোলনের এই সময়ে পোশাকশিল্প সেক্টরে উত্তেজনা বিরোধী আন্দোলনের জন্য শাপেবর হতে পারতো। কিন্তু বিরোধীরা তা পকেটে নিতে পারিনি, ক্যাশও করতে পারিনি।
গার্মেন্টস শ্রমিক আনঞ্জুয়ারার মৃত্যু নিয়ে আমরা কেউ সরব হইনি। তার স্বামী জামাল যখন আকুতি করে বলছিলেন, “তার স্ত্রী ফ্যাক্টরি থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু সে রাস্তা চিনতে পারেনি। এ গলি সেই গলি ঘুড়ে বেড়িয়েছে আর তখনই পুলিশের একটি গুলি এসে তার শরীরে বিদ্ধ হয় যার ফলে সে মারা যায়।” তার স্বামী ও পরিজনদের সেই কান্না আর আহাজারিও আমাদেরকে রাজনীতিকে জনবান্ধব বিশেষ করে শ্রমিক বান্ধব করে তুলতে পারেনি। মূলধারার রাজনীতিবীদদের এই নিষ্ক্রিয়তার কারণে একটি সময়ে মনে অসন্তোষ পুষে রেখে কিছু লাশের বিনিময়ে শ্রমিক ভাই ও বোনেরা হয়তো ১২৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি বাধ্য হয়েই মেনে নিবেন, তবে জাতীয় রাজনীতিতে শ্রমিকদের এই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার বিষয়টি সামগ্রিকভাবে রাজনীতিকেই দুর্বল করে দিবে।