শ্রমিক কাজের লোক হলেও তাঁরাও মানুষ, তাঁদের দৈহিক গঠন রাজা-বাদশা, প্রধানমন্ত্রী, মালিকের মত। তাঁরা প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধা যেমন-অক্সিজেন, আলো বাতাস, রাত-দিন সমানভাবে লাভ করে। বৃষ্টি বাদল, মায়ের স্তনের দুধ বংশবলী প্রভৃতি। তাঁদের একটি মাত্র অপরাধ তাঁদের সম্পদ নেই। তাঁরা মালিকের অধীনে কাজ করে। তাঁরা কঠোর পরিশ্রমী না হলে মালিক, রাষ্ট্র-সমাজ অচল। অথচ তারা সমাজে অবহেলিত, বঞ্চিত এবং ঘৃণিত। দারিদ্রতার কারণে তাদেরকে সর্বস্তরে অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। কাজ করলে মজুরি দেয় না, আবার মজুরি দিলেও ঠকানো হয়, কম দেওয়া হয়, যা দেয় তা দিয়ে অর্ধাহারে অনাহারে পরিবার পরিজন নিয়ে দিন কাটাতে হয়।
দরিদ্র মোচনের জন্য কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে অথচ তা শুধু কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ি, বাগান বাড়ি ও কুকুরের জন্য ব্যয় হচ্ছে বাজেটের সিংহভাগ।
যারা সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করে মানুষের সুখ-শান্তির জন্য কাজ করে। তাঁদের অসহায়ত্ব দেখে দুঃখ-দুর্দশা দেখে তাঁদের প্রতি উপহাস কাভ হয়। হায়রে মানবতা! অথচ দুনিয়ার বড়ো বড়ো রাষ্ট্র, জাতিসংঘ মানবতার স্লোগান ফেরি করে বেড়ায় আর তাদের তদারকিতে মানবতা বিঘ্নিত। দরিদ্র মোচনের জন্য কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করা হচ্ছে অথচ তা শুধু কর্মকর্তাদের বিলাসবহুল বাড়ি গাড়ি, বাগান বাড়ি ও কুকুরের জন্য ব্যয় হচ্ছে বাজেটের সিংহভাগ। তাই গরিব ও অসহায় মানুষের জীবনের কোন পরিবর্তন হচ্ছে না, গরিব গরিবই থেকে যাচ্ছে।
পূর্বের যুগে কাজের লোকদেরকে বলা হতো গোলাম। যা গরু ছাগলের মত বাজার থেকে ক্রয় করা হতো। গরু ছাগলের খোয়াড়ে তাদের রাত্রিযাপন হতো, আর শুধু বেঁচে থাকার জন্য তাদেরকে খাবার দেওয়া হতো। তাদের মলমূত্রের মধ্যেই রাতে ঘুমাতে হতো।
মহান আল্লাহ বিশ্বের সর্বত্র জীবিকার উপাদান ছড়িয়ে রেখে দিয়েছেন। বান্দা পরিশ্রম করে আল্লাহর দেওয়া রিজিক হতে জীবিকা সংগ্রহ করবে, এটাই তার চিরন্তন বিধান। একজন কঠোর পরিশ্রম করে আর অন্য একজন শক্তির বলে কৌশল খাটিয়ে তাকে বঞ্চিত করে তার শ্রমের ফল ভোগ করবে এরূপ ব্যবস্থা জুলুম, শোষণ ও অমানবতা। যারা এরূপ জীবন ব্যবস্থা বা সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে সব জালেমদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা বা জিহাদ করা ঈমানদার ব্যক্তিদের ঈমানী দায়িত্ব।
শ্রমিক নির্যাতনের ইতিহাস
ইসলামের পূর্বে যেসব সভ্যতার কথা আজকের যুগেও সকলের কাছে পরিচিত এবং যাদের সুনাম আজকের যুগেও পশ্চিমা দেশগুলো গর্ববোধ করে থাকে যে সমাজেও খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার স্বীকার করা হয়নি। বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার জনক Frederick Winslow Taylor নিজেও শ্রমিককে মানুষ না বলে অর্থনৈতিক মানুষ (Economic Man) হিসাবে দেখেছেন। ফলে বস্তুবাদী সমাজে মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদাকে অস্বীকার করে মানুষকে নিছক ক্রয়-বিক্রয় যোগ্য পণ্য যন্ত্র অথবা একটি জন্তু মনে করে তাদের সাথে সেভাবে আচরণ করা হতো। মানব জাতিকে শক্তিমান ও দুর্বল শ্রেণিতে বিভক্ত করে Might is Right ফরমুলা আবিস্কার করে দুর্বলদের শ্রম ও অধিকার হরণ করা হচ্ছে।
রোম সাম্রাজ্যে দাস প্রথা প্রচলিত ছিল। আধুনিক সমাজের নিয়ন্ত্রণে যে দেশটি আছে যে দেশটি আমেরিকা সে দেশে এখনও গোলাম বাজারে বিক্রি হচ্ছে। কালো রংয়ের লোকগুলোকে তাদের দেশে সভ্য মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়। তাদের সাথে একত্রে বসাও তারা ঘৃণাবোধ করে। ভারতবর্ষে মনে করা হতো চণ্ডাল এবং অস্পৃশ্য এ দুই শ্রেণির লোক লোকালয়ের বাইরে অবস্থান করবে, খাদ্য পাত্র প্রভৃতি পৃথক থাকবে। কুকুর ও গাধা হবে তাদের একমাত্র সম্পদ। চণ্ডাল মৃতের কাপড় পরবে এবং ছিদ্রযুক্ত পাত্রে ভোজন করবে। (মনুস্মৃতি)
পুঁজিবাদের সমর্থক ম্যানডিভেল তার বই ‘ফিবল অব দি বিজ’ এ লিখে গেছেন, ‘গরিব ও অসহায় লোকদের থেকে কাজ নেওয়ার একমাত্র উপায় হলো তাদেরকে গরিব থাকতে দাও এবং সব সময় তাদেরকে পরনির্ভরশীল করে রাখো।
আধুনিক যুগে শ্রমিক শোষণের জন্য দায়ী দুটি মতাদর্শ
১। পুঁজিবাদ: আধুনিক যুগে পুঁজিবাদী সমাজে বিত্তবান ধনী শ্রেণির লোকেরাই হচ্ছে দেশ ও জনগণের মালিক। আর অসহায় শ্রমিক হচ্ছে তাদের আশা আকাক্সক্ষা পূরণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। একজন দুর্বল শ্রমিক মৃত্যু পর্যন্ত অক্লান্ত মেহনত করেও ধনী হবার সুযোগ লাভ করতে পারে না। বরং ধনী মালিকদের সেবা ও স্বাস্থ্য রক্ষা করার জন্য শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের প্রস্তুত থাকতে হয়। পুঁজিবাদের সমর্থক ম্যানডিভেল তার বই ‘ফিবল অব দি বিজ’ এ লিখে গেছেন, ‘গরিব ও অসহায় লোকদের থেকে কাজ নেওয়ার একমাত্র উপায় হলো তাদেরকে গরিব থাকতে দাও এবং সব সময় তাদেরকে পরনির্ভরশীল করে রাখো। এদের যা প্রয়োজন তা কিঞ্চিত পূরণ কর। খেটে খাওয়া মানুষকে স্বাবলম্বী করা আত্মঘাতী পদক্ষেপ বৈ কিছুই নয়।’ বিখ্যাত পুঁজিবাদী রাবার্ট ওয়ান তার নিউওয়ার্ক কারখানার শ্রমিকদের অবস্থা দেখে মন্তব্য করেছিল, ‘এরা আমার দাস, এদের জীবনের সবকিছু আমার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল।’ উল্লেখিত দৃষ্টান্ত থেকে পুঁজিবাদী সমাজের কুৎসিত চেহারা প্রকাশ পায়। যেখানে অসহায় শ্রমজীবী মানুষ ধনীদের গোলামে পরিণত হয়ে আছে। যে সমাজে শ্রমজীবী মানুষ বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত ও ঘৃণিত।
ইংল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মালিক ও সরকারের অত্যাচারে নির্যাতনে অতিষ্ট হয়ে তাদের বেঁচে থাকর ন্যূনতম অধিকার আদায়ের জন্য অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে শ্রমিকদের প্রাথমিক ধরনের সংগঠন গড়ে উঠে। যেমন বক্স ক্লাব, সমিতি ইত্যাদি। শ্রমিকেরা জানতো না কীভাবে নতুন নতুন আবিস্কৃত যন্ত্র দানবের সাথে মোকাবেলা করে কাজ করতে হয়। ফলে তাদের কাজ আরও কঠোর হতে থাকে তাদের জীবনে বিশ্রামটুকু হারিয়ে ফেলে। ফলে যন্ত্র দানবই ছিল শ্রমিকদের বড়ো শত্রু। ১৭৬০ সালের তাদের মধ্যে জন্ম নেয় এক ক্ষণজন্মা এক নেতা। যার নাম লুড। লুডের নেতৃত্বে শ্রমিকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেশিন ভাঙা এবং কারখানায় আগুন দেওয়ার আন্দোলন শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই এ আন্দোলন সারা ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। ১৮১০ সাল এ আন্দোলন পর্যন্ত প্রাধান্য বিস্তার লাভ করে।
শ্রমিকেরা তাদের স্বল্প আয় থেকে সামান্য অর্থ প্রত্যেক সপ্তাহ বা মাসে একটি বিশেষ বক্সে জমা রাখত আন্দোলনের অর্থ জোগানোর জন্য। এজন্য এ আন্দোলনের নাম হয় বক্স ক্লাব।
এ বক্স ক্লাবের অর্থ দ্বারা শ্রমিকদের আন্দোলন ও সেবামূলক কাজ পরিচালিত হত। উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইংল্যান্ড জুড়ে এ ধরনের কয়েক হাজার ক্লাব গড়ে উঠে। এসব ক্লাব শক্তিশালী হয়ে উঠে। তারপর ক্রমেই এসব ক্লাব মজুরি, কর্মদিন, কর্মঘণ্টা সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে মালিক ও সরকারের সাথে দর কষাকষিতে জড়িয়ে পরে। এমন কী ধর্মঘট ও শ্রমিকদের আর্থিক সংকট মিটানোর জন্য ক্লাবগুলো এগিয়ে আসে। ফলে পুঁজিপতি শক্তিগুলো মনে করতে থাকে তাদের বিরুদ্ধে এ ক্লাবগুলোই শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তাই সমবায় ও ক্লাবগুলোর সকল অর্থ কেড়ে নিয়ে এগুলে অকেজো করে দেওয়া হলো। ক্লাবগুলোর কাজ সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং অন্যান্য কাজ করার জন্য ১৭৯৩ সনে রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য বাধ্যতামূলক করে আইন পাশ করা হয়।
১৭৯৯-১৮০০ সালের পর হতে অধিকার ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের মাধ্যমে আন্দোলন শক্তি লাভ করতে থাকে। ১৭৯৯-১৮০০ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আইন পাশ করে। তখন ইংল্যান্ডের শ্রমিকেরা গোপনে অনেক ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তোলে। অবশেষে শ্রমিকদের আন্দোলন ও জনমতের চাপে ১৮২৪ সালে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়।
অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিক অংশ হিসেবে ১৮৩০ সনে শ্রমিকরা গঠন করে National Assocition of the protection of labour. এর তিন বছর পর গঠিত হয় Grand National Consolidatea Trade Union নামে একটি সংগঠন। এ সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ছিল ৫ লাখ।
১৮৩০ থেকে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে ও জার্মানিতে নানা ধরনের আইন পাশ করে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আইন বন্ধ করার চেষ্টা করে। শত দমন নীতি জারী করার মধ্য দিয়ে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইউরোপ ও আমেরিকায় ধর্মঘট আন্দোলনের ব্যাপ্তি লাভ করে।
শ্রমিক শ্রেণি সর্বপ্রথম ফ্রান্সে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রাম সূচনা করে। ফ্রান্সের লিয়নস শহরে তাঁত শ্রমিকদের টানা তিন বছর রাজনৈতিক লড়াই চলে। অন্যান্য শিল্পের, পেশার শ্রমিকেরাও তাদের মাঝে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসে লক আউট ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে শ্রমিকগণ আওয়াজ তোলে। কাজ করে বাঁচতে চাই, নতুবা সংগ্রাম করে মরতে চাই। এ লড়াই তীব্র ও ব্যাপক আকার ধারণ করলে সরকারি সৈন্যবাহিনী শ্রমিকদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ লড়াই শুরু হয়। শ্রমিকগণ শহরের ক্ষমতা দখল করে নেয়। ১৫ দিন দখল করার পর সরকারি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে শ্রমিকদের অভিযান ব্যর্থ হয়।
১৮৩৬ সালে লন্ডনের দক্ষ কারিগররা শ্রমজীবী মানুষের সমিতি গঠন করে। ১৮৩৭-৩৮ সালে শ্রমিকদের দুইটি প্রাথমিক ধরনের রাজনৈতিক সংগঠনের সূচনা হয়। এ সংগঠন র্যাডিক্যাল বুর্জোয়াদের উত্থাপিত দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলন শুরু করে এবং তারা সরকারের নিকট দাবি দাওয়া পেশ করেন। ইংরেজিতে দাবিনামা বলা হয় তাই উক্ত আন্দোলন চার্টিস্ট আন্দোলন নামে পরিচিত। ১৮৪০ সালের জুলাই মাসে উক্ত দাবিগুলোর ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংগঠন জাতীয় চার্টার সমিতি গঠিত হয়। ১৮৪২ সালে আন্দোলন ব্যাপক জনসমর্থন ও শক্তি লাভ করে। ২রা মে উক্ত দাবিনামা পার্লামেন্টে জমা দেওয়ার সময় ৫ লাখ শ্রমিকের সমাবেশ ঘটে ছিল। উক্ত দাবিনামায় ৩৩ লাখের বেশি স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়। উক্ত আন্দোলন যদিও স্থায়ীত্ব লাভ করেনি। কিন্তু আন্দোলনের প্রভাবে বৃটিশ শ্রমিকেরা ১৮৪৭ সালে ১০ ঘণ্টা কর্ম দিবসের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়। ইতিহাসে সর্বপ্রথম সরকারের নিকট থেকে শ্রমিকগণ তাদের ন্যায্য দাবি আদায় করে নেয়। ১৬৮৪ সালে নিউইয়র্কে ঠেলা ওয়ালাদের ইউনিয়ন গড়ে ওঠে। ১৭৬৩ সালে চিমনি পরিষ্কারক শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধভাবে দাবিনামা পেশ করে এবং দাবি না মানা হলে কাজ করবে না বলে ঘোষণা দেয়। ১৭৭০ সালে নিউইয়র্কে পিপা প্রস্তুতকারক শ্রমিকেরা ইউনিয়ন গড়ে তোলে। ১৭৭৮ সালে নিউয়র্কে ছাপাখানার শ্রমিকেরা মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৭৮৬ সালে ফিলাডিলফিয়ার ছাপাখানায় শ্রমিকদের সর্বপ্রথম তীব্র ধর্মঘট করে তাদের দাবি আদায় করতে সক্ষম হয়।
১৮২৩ সালে আমেরিকার ইতিহাসে সর্বপ্রথম মহিলা শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধভাবে সাধারণ ধর্মঘট হয়। এ মহিলা শ্রমিকেরা ছিল নিউইয়র্কের দর্জি শ্রমিক। ১৮২৮ সালে সর্বপ্রথম মিল-কারখানায় শ্রমিকেরা আন্দোলনের সূচনা করে। ১৮৩৩ থেকে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত মজুরি বৃদ্ধি ও ১০ কাজের দাবিতে ধর্মঘট তীব্র আকার ধারণ করে। এ ৪ বৎসরে ১৬৮ টি ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনের ফলে কোথাও কোথাও ১০ ঘণ্টা কাজের সময় আদায় করে নেয়। এ সময়ের সারা দেশে ১৫০ টি শ্রমিক ইউনিয়ন গড়ে উঠে এবং শ্রমিক সমাবেশ ৩ লাখে উপনীত হয়।
পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য কিছু সুযোগ ছিল আন্দোলন করার। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে সে সুযোগটুকু হারাতে হয়েছে শ্রমজীবী মানুষকে। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তি মালিকদের শোষণ নির্যাতন আর সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকদের উপর চেপে বসেছে রাষ্ট্রীয় শোষণ, নির্যাতনের জগদ্দল পাথর যা অনেক অনেক গুণ শ্রমজীবী মানুষের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
আমেরিকাতে ১৮২৭ সালে ফিলাডেলফিয়ার মেকানিকদের ১৫টি শ্রমিক ইউনিয়নের সমন্বয়ে সর্বপ্রথম ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশন গড়ে ওঠে। ১৮৩৪ সালে জাতীয় ভিত্তিতে শ্রমিক ইউনিয়নগুলো ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে জাতীয় ট্রেড ইউনিয়ন গঠিত হয়।
১৮৪২ সালে আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণির ট্রেড ইউনিয়ন ও ধর্মঘট করার আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৪৭-১৮৬০ সালের মধ্যে ১০ ঘণ্টা শ্রম দিবস আমেরিকার সকল রাজ্যে আইনগত স্বীকৃতি লাভ করে। আমেরিকায় ১৮৬০ সালের ৮ মার্চ আমেরিকার নারী শ্রমিকেরা একত্র হয়ে নারী শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করে। নারী শ্রমিকদের ওপর বাড়তি শোষণ ও নির্যাতনের ফলে তারা স্বতন্ত্র আন্দোলন করতে বাধ্য হয়। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ৮ মার্চ দিনটি আন্তর্জাতিক নারী দিবসের স্বীকৃতি লাভ করে।
২।সমাজতন্ত্র: উপরে উল্লেখিত বর্ণনায় শ্রমজীবী মানুষের শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন, অধিকার থেকে বঞ্চনা এ সবই পুঁজিবাদী দেশের চিত্র এর তা থেকে মুক্তির আন্দোলন। পুঁজিবাদী সমাজে শ্রমজীবী মানুষের মুক্তির জন্য কিছু সুযোগ ছিল আন্দোলন করার। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক সমাজে সে সুযোগটুকু হারাতে হয়েছে শ্রমজীবী মানুষকে। পুঁজিবাদী সমাজে ব্যক্তি মালিকদের শোষণ নির্যাতন আর সমাজতান্ত্রিক সমাজে শ্রমিকদের উপর চেপে বসেছে রাষ্ট্রীয় শোষণ, নির্যাতনের জগদ্দল পাথর যা অনেক অনেক গুণ শ্রমজীবী মানুষের অসহায়ত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে। যা থেকে বাঁচা,মুক্তি পাওয়া শ্রমজীবী মানুষের জন্য অসম্ভব। কারণ ব্যক্তি মালিকানার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা সহজ রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা অনেক কঠিন কারণ দুটোই পুঁজিপতি। একটি ব্যাক্তি মালিকানা আরেকটি রাষ্ট্রিয় মালিকানা।
সমাজতান্ত্রিক মতবাদ শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে, পুঁজিবাদী শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে বিভিন্ন দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার পর সরকার ও সমাজতন্ত্রী নেতারা দেশের সমস্ত ক্ষমতা অধিকার করে বসে। ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর নেতাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে মুখ খোলা, মিছিল করা, সংগঠন করা, মিটিং, পোস্টার করা, হরতাল ধর্মঘট করা সম্পূর্ণ বেআইনী ঘোষণা করে মৃত্যুযোগ্য শাস্তি ধার্য করা হয়। দেশের সকল সম্পদ লুণ্ঠন করে মাত্র কয়েকজন নেতা হয়ে বসেন তার মালিক যার নাম দেওয়া হল, রাষ্ট্রীয় মালিকানা দুনিয়ার সবচেয়ে নিষ্ঠুর দয়ামায়াহীন লোকগুলো হলো সমাজতান্ত্রিক দেশের নেতা।
রাশিয়ার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী সোলস নিৎসিন বলেন, লেলিনের হৃদয়ে দয়া-মায়ার নাম-গন্ধও ছিল না। জনগণের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সম্পূর্ণ অমানবিক। মন্দ বলতে দৈনন্দিন জীবনে যা বুঝায়, লেলিন ছিলেন তাই। এমন একজন নিষ্ঠুর হৃদয়হীন, নীতি বিবর্জিত নেতা কী কোন দিন মানবজাতির কল্যাণ করতে পারে? এমন একজন নেতার নিকট যারা কল্যাণ কামনা করে তারা বিবেকহীন ও ভ্রান্ত। তাই শ্রমিক রাজের স্লোগান দিয়ে বিপ্লবের নামে লেলিন ধোঁকার জাল বিস্তার করে মানুষের সবটুকু স্বাধীনতা ও অধিকার হরণ করে দেশটাকে একটি কয়েদখানায় পরিণত করেছে।
সমাজতন্ত্রের সমর্থক প্রখ্যাত রুশ লেখক একনব বলেছেন, ‘আমাদের মিল-কারখানার উৎপাদন এক বিরাট কয়েদী বাহিনীর ওপর নির্ভরশীল।’ অর্থাৎ সমাজতন্ত্রীক দেশের সকল শ্রমজীবী মানুষের অধিকার জেলখানা কয়েদীর চেয়ে বেশি কিছু নয়। প্রখ্যাত দার্শনিক বাট্রাঙ রাসেল বলেছেন, ‘পাশ্চাত্যের দেশ শোষিত হচ্ছে পুঁজিপতি শোষণ দ্বারা আর সমাজতান্ত্রিক দেশের জনগণ শাসিত হচ্ছে সামরিক জান্তাদারা।’
মে মাসের ঘটনা আগে ও পরে
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শেষ হবার পরেই কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন জাতীয় পর্যায় মিলিত হয়ে একটি ফেডারেশন গঠন করার আগ্রহ পোষণ করে। এ সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হয় ১৮৬৬ সালের ২২ আগস্ট ৬০ টি ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনের ৬০ হাজার শ্রমিক প্রতিনিধি নিয়ে বালটিমোর শহরে অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিদের সর্বসম্মত ঐক্যমতে ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা লাভ করে। লোহা ঢালাই শ্রমিকদের এক নেতা উইলিয়াস এইচ এ সংগঠনের নেতা নির্ধারিত হয়। এ সংগঠনের পক্ষ থেকে সর্বপ্রথম আমেরিকাতে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবি উত্থাপন করে এবং এ দাবির সমর্থনে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়ন প্রস্তাবটি গ্রহণ করার ১ মাস পর ১৮৬৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক জেনেভা কংগ্রেসে এ দাবির সমর্থনে প্রস্তাব পাশ করা হয়।
ন্যাশনাল লেবার ইউনিয়নের প্রচার ও আন্দোলনের ফলে আমেরিকার বিভিন্ন অঞ্চলে ৮ ঘণ্টা শ্রম সমিতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করলে আমেরিকার অনেক রাজ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অফিসে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নেওয়া হয়। ১৮৬৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন সভা এ মর্মে একটি আইন পাশ করে। ১৮৬৯ সালে আমেরিকার অবিসংবাদিত শ্রমিক নেতা সিলভিস ৪১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করে এবং কিছু দিনের মধ্যেই সংগঠনটি বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৮৭৫ সালে পেনসিল ভানিয়া অঞ্চলের কয়লাখনি মালিকেরা খনিঅঞ্চল থেকে জোর করে খনি শ্রমিকদের সকল শ্রমিক সংগঠন উচ্ছেদ করার চেষ্টা করে। শ্রমিকেরা কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে ফলে ১০জন খনিজ শ্রমিককে ফাঁসি দেওয়া হয়। আমেরিকার ফেডারেশন অব লেবার ১৮৮৪ সালের ৭ অক্টোবর চতুর্থ সম্মেলনে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবিতে প্রস্তাব গৃহীত হয় যে, ১৮৮৬ সালের ১ মে থেকে দৈনিক ৮ ঘণ্টাকেই কাজের দিন বলে আইনত গণ্য করা হবে। এ মর্মে আমরা সকল শ্রমিক সংগঠনকে নিজ নিজ এলাকায় এ দাবির বাস্তবায়নের জন্য তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবে। নাইট অব লেবার সংগঠনটি ৮ ঘণ্টা বাস্তবায়নের বিরোধীতা করে। ফলে তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তারা আন্দোলন থেকে ছিটকে পরে।
আমেরিকার সর্বত্র ৮ ঘণ্টা কাজের সময়ের আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। ১৮৮৬ সালের ১ মে ছিল শনিবার স্বাভাবিক কাজের দিন। ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে আমেরিকার সকল শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। এ ধর্মঘট ও আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র ছিল শিকাগো। আন্দোলনের ব্যাপক প্রস্তুতির মধ্যে অসহায় ক্ষতিগ্রস্ত চাকুরি হারা শ্রমিকদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করার ব্যাপারে গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সেন্টার লেবার ইউনিয়ন ১ মে তারিখের পূর্বের রবিবার শিকাগো শহরে একটি সমাবেশের আয়োজন করে। এ সমাবেশে ২৫ হাজার শ্রমিক অংশগ্রহণ করে। ১ মে শিকাগোর শ্রমিক অঞ্চলগুলোতে ধর্মঘট পূর্ণমাত্রায় সফল হয়। শিকাগোতে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখে। প্রত্যেক শ্রমিক তার পরিবারসহ মিশিগান এভিনিউর মিছিলে যোগদানে প্রস্তুতি নেয়। সরকার নাগরিক কমিটি গঠন করে শান্তি কমিটি ও শৃঙ্খলা রক্ষার অজুহাতে শহরের অলিগলি ও বহুতল বাড়ির ছাদে পুলিশ ও সরকারি বাহিনী মোতায়েন করে। সমাবেশে শ্রমজীবী মানুষকে বিপ্লবী চেতনায় উজ্জীবিত করার জন্য অগ্নিঝড়া বক্তব্য, মিছিল-মিটিং, ধর্মঘট ১ লা মে উত্তাল হয়ে উঠে। লুউলিং, পার্সনস, জোয়ান মোস্ট, আগষ্ট স্পিস সহ আরও অনেকেই বক্তব্য রাখেন। ১ মে ১৮৮৬ সন্ধ্যাবেলা শিকাগোর হে মার্কেটের বাণিজ্যিক এলাকায় শ্রমিকগণ মিছিলের উদ্দেশ্যে জমাটবদ্ধ হতে থাকে। আগস্ট স্পিস সমবেত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দিতে ছিলেন। হঠাৎ পুলিশের নিকট বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এতে এক পুলিশ নিহত হয় এবং ১১ জন আহত হয়। পরে আরও ৬জন নিহত হয়। পুলিশ বাহিনীও শ্রমিকদের উপর হামলা চালায়। সর্বমোট ১১ জন নিহত হয়। পুলিশ হত্যা মামলায় আগস্ট স্পিস সহ ৮ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৮৮৬ সালের ৯ অক্টোবর বিচারের রায়ে তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ প্রহসন বিচারের পর ১৮৮৭ সালের ১১ ই নভেম্বর উন্মুক্ত স্থানে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। লুই লিং একদিন পূর্বে জেলখানায় আত্মহত্যা করেন। একজনের পনের বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ফাঁসির মঞ্চে উঠাবার পূর্বে আগস্ট স্পিস বলেছিলেন ‘আজ আমাদের এ নীরবতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে।’ তাই আজ বিশ্বজুড়ে ১ লা মেয়ের আওয়াজ পৃথিবীর সর্বত্র বুলন্দ হচ্ছে আর সারা দুনিয়ায় কোটি কোটি শ্রমিক উজ্জীবিত হচ্ছে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। শ্রমিকেরা মালিকের কাজ করতে অস্বীকার করছে না। তারা বলে তোমাদের কাজ সেবা করাই আমাদের পেশা শুধু আমাদের মানুষের মত বেঁচে থাকার অধিকার দাও।
ঐতিহাসিক হৃদয় বিদারক ঘটনার তিন বৎসর পর ১৮৮৯ সালের ১৪ই জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশ। এ সমাবেশে প্রতিবছর মে মাসের প্রথম দিনকে অর্থাৎ ১ মে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর থেকে ১ মে বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়ে আসছে। পরবর্তীকালে ১৯১৯ সালে আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘আইএলও’ গঠিত হয়। প্রতিদিন দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময়ের নির্ধারণ করে কনভেনশন গৃহীত হয়। এ কনভেনশন পর্যায়ক্রমে পৃথিবীর প্রায় সকল রাষ্ট্র অনুসমর্থন লাভ করে। কনভেনশন মোতাবেক স্ব-স্ব দেশে কাজের সময়সীমা সম্পর্কে আইন প্রণীত হয়। ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নিয়ে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র একই কাতারে। আইএলও শ্রমিকদের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এ পর্যন্ত ১৮৩টি কনভেনশন প্রণয়ন করে। এর মধ্যে ৮টি কোন কনভেনশনসহ ৩৩টি কনভেনশন বাংলাদেশ অনুসমর্থন করে। এছাড়া বাংলাদেশ বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সরকার শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিতকরণে দায়বদ্ধ।
অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিত্য সাথী। যে শ্রমিক কোটি কোটি মানুষের জন্য কাপড় তৈরি করে তার পরিধানে বস্ত্র নেই। তার মৃত্যুর পর কাফনের কাপড়ের জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে হয়। এমন কি বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তাদের জামা কাপড় পরিষ্কার করার জন্য সাবান সংগ্রহ করতে পারে না তাই ময়লা কাপড় পরিধান করে এবং তাকে দেখলেই মনে হবে সে একজন শ্রমিক।
শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের দাবি আকাশে বাতাসে পৃথিবীর প্রতিটি কানায় কানায়। এ অধিকারের বাস্তবায়নের জন্য লক্ষ, কোটি সমাবেশ হচ্ছে। কোটি কোটি নেতা তৈরি হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তন হচ্ছে, মিছিল হচ্ছে, লক্ষ মানুষের মরণ মিছিল চলছে। শ্রমিকের মুক্তির স্লোগানকে পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করে ক্ষমতার সিড়ি বানিয়ে এক শ্রেণির নেতা, শোষক, ধোঁকাবাজ নিজেদের ভাগ্য বদল করেছে। কিন্তু হতভাগ্য শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তারা আধুনিক বিশ্বে অর্ধাহারে অনাহারে, অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন শ্রমজীবী মানুষের আহাজারি চলছে বিশ্বের দিকে দিকে। শ্রমিকের মুক্তির আলো অসহায় শ্রমজীবী মানুষ এখনও দেখতে পায়নি।
বাংলাদেশে ১ মে শ্রমিক দিবস
বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই ১ মে শ্রমিক দিবস ঘটা করে উদযাপিত হচ্ছে, মিছিল, মিটিং, সেমিনার ও সিম্পোজিয়াম অর্থাৎ সর্বপ্রকার আয়োজনের মাধ্যমে শ্রমিকগণ রাজপথে থাকে তাদের সাথে সরকারি কর্মকর্তাগণ থাকেন। সরকারের পক্ষ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং সারাদিনের জন্য প্রোগ্রাম প্রণয়ন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১ মে উপলক্ষ্যে ভাষণ দেন অর্থাৎ শ্রমিকদের জন্য ঐ দিন যা করা তার কোনটাই কমতি করা হয় না। কিন্তু ১ মে শেষ সকল আয়োজন শেষ। তারপর সারা বছর শ্রমিকদের দুঃখ কষ্টের কথা কোন সময়ই স্মরণ করা হয় না। ১ মে প্রত্যেক বৎসর আসে যায় কিন্তু শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন নেই। অন্নহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন হচ্ছে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিত্য সাথী। যে শ্রমিক কোটি কোটি মানুষের জন্য কাপড় তৈরি করে তার পরিধানে বস্ত্র নেই। তার মৃত্যুর পর কাফনের কাপড়ের জন্য মানুষের কাছে ভিক্ষা করতে হয়। এমন কি বাংলাদেশের শ্রমিকেরা তাদের জামা কাপড় পরিষ্কার করার জন্য সাবান সংগ্রহ করতে পারে না তাই ময়লা কাপড় পরিধান করে এবং তাকে দেখলেই মনে হবে সে একজন শ্রমিক। বেতনের পরিমাণ এত কম যে তা দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অর্ধাহারে, অনাহারে দিন কাটাতে হয়। অধিকার আদায়ের আন্দোলনে যোগ দিলে চাকরির আশা ত্যাগ করতে হবে। শ্রমিকদের উপর এসব জুলুমের কথা যারা বলবে এবং শ্রমিকদের জন্য মালিকের সাথে যারা মোকাবেলা করবে তারা অধিকাংশ মালিকের নিকট থেকে মাশওয়ারা পায়। কারণ অসহায় শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিতে যে চারিত্রিক বলিষ্ঠতা প্রয়োজন তা নেতাদের মধ্যে খুবই অভাব তাই শ্রমিকদের অধিকার আদায় হচ্ছে না।
বিবেকবান লোকদের নিকট একটি আবেদন
আমি আমার প্রবন্ধে শ্রমজীবী মানুষের উপর জুলুম ও অমানবিক আচরণের ইতিহাস তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আজ পর্যন্ত কোথাও তারা শান্তির সন্ধান পায়নি, মানুষ হিসেবে মর্যদাও পায়নি। অথচ মালিক শ্রমিকের মধ্যে সমবেদনা, ভ্রাতৃত্ব, সৌহাদ্য, ভালবাসা ও পারস্পরিক ইনসাফ গড়ে না উঠলে পৃথিবী অশান্তিতে ভরে উঠাই স্বাভাবিক তাই চলছে আজ বিশ্বব্যাপী অশান্তি, জুলুম, নিপীড়ন, মারামারি, হানাহানি। কারণ পৃথিবীতে গরিব ও শ্রমিক শ্রেণির লোকই বেশি এবং তাদের কর্মই পৃথিবীকে সচল রেখেছে। তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাদের উপর অমানবিক আচরণ করে পৃথিবীতে শান্তি আসতে পারে না। যারা পৃথিবীতে শান্তি চায় তাদের জন্য বিশ্ব নবী, বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানুষ আল্লাহর প্রেরিত রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা.) আদর্শ সকল মানুষকে মুক্তি দিতে পারে। তার আদর্শ বাদ দিয়ে যাকে নেতা মানা হবে সেখানেই অশান্তি নেমে আসবে।
রাসুল (সা.) জীবন ব্যবস্থা সকল মানুষের জন্য পরিপূর্ণ আমি তার প্রদত্ত অধীনস্ত মানুষের ও মালিকের জন্য কয়েকটি নীতিমালা পেশ করছি। যার প্রতিটি বাক্য পালন ও ধারণ করার মধ্যে মালিক শ্রমিক এর মধ্যে ভ্রাতৃত্ব গড়ে উঠবে তাদের দ্বন্দ্ব চিরতরের জন্য বিলুপ্ত হবে।
হযরত জায়েদ (রা.) রাসুল (সা.) এর গোলাম ছিলেন। তাকে রাসুল (সা.) ছেলের মর্যাদা দিয়েছেন এবং প্রত্যেক যুদ্ধে তাকে সাথে রাখতেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁকে মুতার যুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত করেন ও অবশেষে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তার ছেলে ওসামা (রা.) নবী করিম (সা.) শেষ নিযুক্ত সেনাপতি যিনি রোম বিজয় করেন। বেলাল (রা.) হাবশী গোলাম তাকে তিনি মসজিদে নববীর মুয়াজ্জেন ও মদিনা রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন।
আল্লাহর রাসুল (সা.) এর ঘোষিত স্থায়ী শ্রমনীতি
আমি মহান আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক তোমাদেরকে বলছি যে-
১.তোমরা অধীনদেরকে তোমাদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করবে।
২.তোমরা তাদের থেকে এতটুকু কাজ নিবে যা তাদের জন্য সহজ।
৩.তোমরা তাদেরকে তাই যেতে দিবে যা তোমরা নিজেরা যাও। অর্থাৎ এমনভাবে তাদের মজুরি দিবে যাতে মালিকের মত সবই শ্রমিক খেতে পারে।
৪.তোমরা তাদেরকে সেই মানের বস্ত্র দিবে যে মানের পোষাক মালিক পরিধান করে।
৫.তোমরা তাদের সাথে যে রকম আচরণ করবে সে ধরণের আচরণ তোমাদের প্রিয়জনদের সাথে করে থাকো।
৬.তোমরা তাদের জন্য তাই পছন্দ করবে যা তোমাদের প্রিয়জনদের জন্য পছন্দ করো।
৭.তোমরা তাদেরকে হীন মনে করবে না কখনও।
৮.শ্রমিকদেরকে তোমার বাহনে তুলে নাও
৯.তারা মানুষ হিসাবে তোমাদের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। তোমাদের যেমন একটি অন্তর আছে তেমনি তাদেরকে একটি অন্তর আছে।
১০.তোমরা মানবজাতি আদমের সন্তান এবং আদম হচ্ছে মাটির তৈরি। অতএব অহংকার করার কি কারণ থাকতে পারে।
১১.গোলাম বা অধীন যদি কোন অন্যায় করে তাহলে প্রতিদিন সত্তরবার তাদেরকে ক্ষমা করে দাও। এজন্য যে, তোমার প্রভু তোমাদের হাজারও অন্যায় ক্ষমা করে দিচ্ছেন।
১২.স্মরণ করো যে ব্যক্তি অধীনদের উপর এমন অভিযোগ উত্থাপন করবে মূলত সে তা করেনি তাহলে কেয়ামতের দিন সে ব্যক্তিকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে।
রাসুল (সা.) বাস্তব জীবনের দৃষ্টান্ত গোলামদের সাথে
নবী করিম (সা.) যে কথা বলতেন তা নিজেই সকলের আগে আমল করতেন। তিনি তার নিজের ঘরে তিনজন গোলাম একজন দাসী লালন-পালন করেছেন। হযরত বারাকা তিনি ছিলেন তার পিতার দাসী, খাদেমা। তিনি তার মা আমেনার পরে আল্লাহর রাসুল (সা.) কে লালন-পালন করেছেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাকে মা বলে ডাকতেন এবং মায়ের মত সম্মান দিতেন পৃথিবীর সর্বোচ্চো সম্মান তাকে দিয়েছেন। হযরত জায়েদ (রা.) রাসুল (সা.) এর গোলাম ছিলেন। তাকে রাসুল (সা.) ছেলের মর্যাদা দিয়েছেন এবং প্রত্যেক যুদ্ধে তাকে সাথে রাখতেন। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁকে মুতার যুদ্ধে সেনাপতি নিযুক্ত করেন ও অবশেষে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তার ছেলে ওসামা (রা.) নবী করিম (সা.) শেষ নিযুক্ত সেনাপতি যিনি রোম বিজয় করেন। বেলাল (রা.) হাবশী গোলাম তাকে তিনি মসজিদে নববীর মুয়াজ্জেন ও মদিনা রাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। মদিনায় ৭০ জন আসহাবে সুফফা যাদের কিছুই ছিল না এমনকি পরিধানের কাপড়ের অভাব ছিল। তাদেরকে নিজের ঘরের নিকট বসবাস করার স্থান করে দিয়েছিলেন যাতে সবসময় তাদের খাওয়া-দাওয়া এবং সর্ববিষয় খোঁজখবর নিতে পারেন।
আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদেরকে মূল্যায়ন করতেন, মর্যাদা দিতেন, নিজের সন্তানদের মতো ভালবাসতেন। তাদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় স্থান করে দিয়েছিলেন। তাকে আল্লাহ বিশ্বের জন্য রহমত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। তাই তিনি ধনী-গরিব, মালিক, শ্রমিক, রাজা-প্রজা সকল মানুষের জন্য আদর্শ তাকে অনুসরণের মধ্যেই পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য কল্যাণ ও শান্তি। আসুন সূর্যের আলো, চন্দ্রের আলো, বৃষ্টি, রাত্র যেমন সকল মানুষের জন্য সমানভাবে কল্যাণ করে যাচ্ছে, সেবা দিয়ে যাচ্ছে। রাসুল (সা.) আদর্শ জাতি ধর্ম, ভৌগলিক সীমা, ভাষাভাষী লোকদের জন্য কল্যাণকর বিশেষ করে বিশ্বের বঞ্চিত অসহায় মানুষের জন্য বাতিঘর। তাই বিশ্বের বিবেকবান সমাজ তার আদর্শ কায়েমের জন্য এগিয়ে আসার মধ্যেই মহা বিশ্বের সকল মানুষের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন