এক.
ঈদের আর তিন দিন বাকি। মানে আজ সাতাশ রমজান। তিন দিন বাদেই ঈদ, তাই সবার মনে একটা খুশির আমেজ বিরাজ করছে, কিন্তু সকাল থেকেই ফাতেমার মনটা ভীষণ খারাপ। কারণ, তার খেলার সাথীদের সকলের ঈদের জামা কেনা হয়ে গেছে, কিন্তু তার নতুন জামা এখনো কেনা হয়নি। তাই মনটা আজ ভালো নেই ফাতেমার। ফাতেমার মা সুলতানা, সকাল হতে তাকে খাওয়ার জন্য বলছে, কিন্তু ফাতেমা নাছোড়বান্দা সে নতুন জামা না পেলে কিছুতেই খাবে না। মা বললেন, সুলতানার করার কিছুই নেই। কারণ, তিনি মানুষের বাড়ি কাজ করে যে ক’টা টাকা মাস গেলে পান তা নিয়ে আগেই খরচ করে ফেলেছেন। কিন্তু, ফাতেমা সাত বছরের বাচ্চা একটা মেয়ে, সে কি বুঝে তাদের সংসারের টানাপড়নের কথা! সংসারের এমন টানাপড়নের কারণে ফাতেমার বাবা সবুজ মিয়াও থাকেন ঢাকা শহরে। সেখানে তিনি ভাড়ায় রিকশা চালান। যে ক’টা টাকা দিনে রোজগার করেন তার বেশির ভাগই ভাড়া দিতে হয় রিকশার মালিককে। হাতে তেমন টাকা আর থাকে না, তাই শখ আহ্লাদগুলো অপূর্ণই থেকে যায়। ঈদ আর তিন দিন বাকি, কিন্তু সবুজ মিয়া ঈদে বাড়ি যাবে কি না এখনো ঠিক করেননি। তিনি ভাড়ার অপেক্ষায় রাস্তার ধারে রিকশাই চেপে বসে আছেন। এমন সময় ভাবলেন বাড়িতে একটা কল করে স্ত্রী আর মেয়ের সাথে কথা বলা যাক। সবুজ মিয়ার নিজের কোনো মোবাইল ছিল না। তবে তার পাশে বসে থাকা আরেকজন রিকশা চালক যোবায়ের, যার কাছে মোবাইল ছিল। সবুজ মিয়া মাঝে মধ্যেই যোবায়েরের মোবাইল থেকে বাড়িতে কল করে কথা বলেন। যোবায়েরে কাছে গিয়ে সবুজ মিয়া বললেন, যোবায়ের ভাই, আপনের মোবাইলটা একটু দিবেন! মাইয়াডার লগে একটু কথা কইতাম। বেশ ক’টা দিন হইয়া গেছে। মাইয়াডার লগে কথা হয় নাই।
যোবায়ের কখনোই সবুজ মিয়াকে মোবাইলে কথা বলতে না করেন না। সবুজ মিয়া চাইতেই যোবায়ের মোবাইল বের করে দিয়ে বললেন,
-লও সবুজ মিয়া লও, মাইয়ার লগে কথা কইবাতো কও। তাড়াতাড়ি কইরো কিন্তু বেশি টাকা নাই মোবাইলে ।
সবুজ মিয়া মোবাইল নিয়ে পাশের বাড়ির কারো নাম্বারে কলদিয়ে তার বউ আর মেয়েকে ডেকে দিতে বললেন। কিছুক্ষণ পর তার বউ সুলতানা ওপাশ থেকে বলল,
হ্যালো, ফাতেমার বাপ, কেমন আছো তুমি? -হ-আমি ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো? মাইয়া ভালো আছেতো?
–হ-ভালোই আছি। কিন্তু, তোমার মাইয়া ফাতেমার লইয়া আর পারতাছি না। সকাল থাইক্বা বাহানা ধরসে ঈদে লাল জামা ছাড়া কিছু খাইবো না। লও তোমার মাইয়ার লগে কথা
ফাতেমা মোবাইল কানে ধরে তার চিকন কণ্ঠে বলল, -হ্যালো বাবা, তুমি ঈদে আইবাতো? আমি কিন্তু লাল জামা ছাড়া ঈদ করমু না। তুমি মারে কও লাল জামা কিনা দিতে।
মেয়ের কণ্ঠ শুনে সবুজ মিয়ার মনে বড়োই শান্তি লাগে। তাই মেয়ের এমন অভিমানী কথা শুনে মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, -ঠিক আছে মা, আমি তোমার লাইগা লাল টুকটুক নতুন জামা লইয়া যামু। -ঠিক কইতাছো বাবা, তুমি আইবা নতুন জামা লইয়া?
-হ’রে মা আমি ঠিক আমু নতুন জামা লইয়া। তুমি রাগ কইরো না। এবার তোমার মাইরে মোবাইলটা দাও।
-লাল জামা লইয়া আইবা কিন্তু, আমি পথ চাইয়া থাকুম। এই বলে ফাতেমা মাকে মোবাইলটা দিলো। সুলতানা মোবাইল কানে ধরে বলল,- ফাতেমার বাপ, তুমি কবে আইবা?
-আমি ঠিক কইবার পারতাছি না কবে আমু, তবে আমি আমু, মাইয়ার নতুন জামা লইয়া জামু। এবার রাখো, ভালো থাইকো কিন্তু।
সবুজ মিয়ার কথা শেষ না হতেই কলটা কেটে গেলো। হয়তো ব্যালান্স শেষ। মোবাইল যোবায়েরকে দিয়ে সবুজ মিয়া বলল, যোবায়ের ভাই, আপনের মোবাইল লন। যোবায়ের মিয়া মুচকি হেসে মোবাইল নিয়ে কোমরে গুঁজে রেখে দিলেন। মেয়ের সাথে কথা বলে সবুজ মিয়ার মনটা অনেক খুশি। কিন্তু, মেয়েকে নতুন জামা কিভাবে কিনে দিবেন তার চিন্তাই পড়লেন। যেই করে হোক মেয়ের জন্য ঈদে নতুন জামা কিনে নিয়ে যেতেই হবে। দরকার হলে ভাড়ার সময় একটু বাড়িয়ে দিবে।
দুই.
সারাদিন রিকশা চালিয়ে সবুজ মিয়া রিকশা গ্যারেজে রেখে ঘরে ফিরলেন। ঘরে ফিরেই তার আজকের সারাদিনের রোজগারের টাকাগুলো পকেটে থাকা একটি ভেজা প্যাকেট থেকে বের করে হিসাব করতে বসলেন। হিসাব করে দেখলেন, মালিকের রিকশার ভাড়া এবং তার খাওয়া খরচ বাদে মাত্র দুইশত পঞ্চাশ টাকা আছে তার কাছে। সবকিছুর দাম বেড়ে গেছে, মানুষের পকেটের পরিস্থিতি ভালো না। তাই আজকাল রিকশাই কেউ চড়ে না, তাই ভাড়াও তেমন পান না সবুজ মিয়া। এমনিতেও তার শরীরটা খুব খারাপ, তাই তিনি বেশি ভাড়া মারতে পারেন না। এই ক’টা টাকা হাতে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন। কীভাবে মেয়ের জন্য নতুন জামা কিনবে? এতদিন রোজগার করে যে ক’টা টাকা জমানো আছে তা দিয়ে তো এবার বাড়ি গিয়ে বাড়ির ভিটার দলিলখানা ছুটাতে হবে তাকে। এসব ভাবতে ভাবতে সবুজ মিয়া হালকা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
তিন.
ক্লান্ত শরীরে ঘুমানোর পর সবুজ মিয়ার একেবারে সকালে ঘুম ভাগুলো। ঈদ আসার আরেকটা দিন কেটে গেলো। যে করেই হোক আজ সবুজ মিয়াকে মেয়ের জামার টাকা জোগাড় করতেই হবে। এই ভেবে সকাল সকাল রিকশা নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন । সারাদিন ভাড়া মেরে আজ তিন শ’ টাকা মেয়ের জামার জন্য রাখলেন। এভাবে অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে সবুজ মিয়া মেয়ের জামা কিনলেন। এবার বাড়ি ফেরার পালা। বাড়ি ফিরে তার মেয়ের হাতে নতুন জামা তুলে দিবেন, ভাবতে তার খুব ভালো লাগছে।
চার.
এ দিকে ফাতেমা বাবার জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত। দেখতে দেখতে ঈদের দিনটাও ঘনিয়ে এসেছে। কালকেই ঈদ, কিন্তু তার বাবা এখনো নতুন জামা নিয়ে আসেনি। যদি বাবা নতুন জামা নিয়ে না আসে, তাহলে ঈদের দিন সে কী পরবে? এসে বলল, এমন হাজার প্রশ্ন মনের মধ্যে জাগতে লাগলো ফাতেমার। সে কিছুক্ষণ পরপর মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো, নতুন জামা নিয়ে বাবা কখন বাড়ি ফিরবে? সুলতানা মেয়েকে বারবার সান্ত্বনা দিয়ে পাঠালেন। কিন্তু, ফাতেমার মন আর মানছে না। খেলার সাথীদের ঈদের জন্য নতুন জামা অনেক আগেই কেনা হয়ে গেছে। একটু আগেই পাশের বাড়ির সুমি। তার নতুন জামাটি তাকে দেখিয়ে গেছে। ফাতেমাও সুমিকে বলে দিয়েছে যে, তার বাবাও তার জন্য নতুন জামা নিয়ে। আসছে। সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল, বিকেল থেকে সন্ধ্যা নেমে এলো, কিন্তু ফাতেমার বাবা এখনো এলো না। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে চারিদিকে চাঁদ দেখার হই-চই লাগছে না তাই চাঁদ দেখতে গেলো না। সে মনের দুঃখে বাবার আসার পথের দিকে চেয়ে রইলো। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, সেই সাথে ফাতেমার বাবার আসার পথও অন্ধকার হয়ে আসছে ফাতেমার চোখে। ঈদের আনন্দে চারদিকে ফটকা আতশবাজির শব্দে মুখর। কিন্তু, ফাতেমার চোখে পানি। তার চোখেমুখে নেই কোনো আনন্দের ছিটেফোঁটা। এক টুকরো মেঘ যেন তার মুখটা ঢেকে রেখেছে। এমন সময় দূর হতে ছোট্ট একটা আলো ফাতেমার চোখে পড়লো। আলোটা তার বাবা আসার পথ থেকেই আসছে। আস্তে আস্তে আলোটা তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। তা দেখে ফাতেমা মনে একটু আশার আলো খুঁজে পেলো। এটা নিশ্চয়ই তার বাবা আসছেন, এই ভেবে সে অধীর আগ্রহে আলোটার দিকে চেয়ে রইলো। কিছুক্ষণের মধ্যে আলোটা ফাতেমার খুব কাছে এসে পৌঁছালো। কিন্তু, একি! তার বাবা কোথায়? এটাতো একটা ভ্যান, যাতে একজন অপরিচিত লোক বসে এবং তার পাশে ভ্যানের ওপর কি যেন একটা শোয়ানো আছে, যেটা একটা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। ফাতেমা কিছুই বুঝতে পারল না। তবে একি! ভ্যানটা তাদের বাড়ির সামনেই এসে দাঁড়ালো। ফাতেমা কিছু বুঝতে না পেরে বাড়িতে ছুটে গেলো। বাড়িতে গিয়ে তার মাকে সব জানালো। ফাতেমার মা শুনে ফাতেমাকে নিয়ে ছুটে বাড়ির বাহির হলেন। বাইরে গিয়ে দেখলেন, কয়েকজন মিলে ভ্যান থেকে একটা লাশ নামিয়ে তাদের বাড়ির ভেতরে নিয়ে আসছেন। তা দেখে সুলতানার বুকটা চিন চিন করে উঠলো। ভয়ে ফাতেমাকে শক্ত করে কাছে টেনে ধরলেন। লোকগুলো লাশটাকে তাদের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে রাখলেন। সুলতানা তার মেয়ে ফাতেমার হাত ধরে ধীরে ধীরে বারান্দার কাছে গিয়ে খুব ভয়ে ভয়ে লাশের কাপড়টা উঠিয়েই কেঁদে উঠলেন। কারণ, লাশটা ছিল ফাতেমার বাবা সবুজ মিয়ার। সবুজ মিয়ার রক্তাক্ত লাশ দেখে স্ত্রী সুলতানা ও সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে ফাতেমা কান্নায় ভেঙে পড়লো। আশপাশের অনেক লোকজন এসে ভিড় জমালো তাদের বাড়িতে। যে লোকটি লাশের সাথে এসেছিলো, সেই লোকটি সুলতানার কাছে এসে বললো,
-সবুজ ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমার সাথে পরিচয় হয়। আমিও উনার সাথে একি বাসের ছাদে করে বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ আমাদের বাসটা একটা খাদে পড়ে যায়। আর সবুজ মিয়া আমার চোখের সামনেই মারা যান। কিন্তু, তিনি মারা যাবার আগে আমাকে একটা লাল জামা দিয়ে বলে গেছেন, আমি যেন তার মেয়ে ফাতেমাকে জামাটি পৌঁছে দেই।
এই বলে লোকটি ফাতেমার হাতে তার বাবার কেনা জামাটি তুলে দিলেন। জামাটি হাতে নিয়ে ফাতেমা কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো, -বাবা, আমার নতুন জামা লাগবো না, তুমি ফিরা আসো বাবা।
লেখক: কবি ও সাহিত্যিক