বর্তমান সময়ের এক আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু জ¦র। ২০২২ সালের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মে মাসে যেখানে সারা দেশে ১৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়, সেখানে জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৩৭ জনে। আর জুলাইয়ে সেই সংখ্যা ১ হাজার ৭১ জনে ঠেকেছে। যা আগের মাসের দ্বিগুণেরও বেশি। একই সঙ্গে ঐ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ১০ জনের নয়জনই মারা গেছেন জুলাইয়ে।
বাংলাদেশে ডেঙ্গু রোগের প্রকাপ অত্যধিক দেখা দেয় জুলাই এবং আগস্ট মাসে। তাই এখনই সময় ডেঙ্গু নিয়ে সতর্ক হওয়ার। ডেঙ্গু জ্বরে সতর্কতার জন্য এই রোগ সম্পর্কে জানার বিকল্প নেই। শরীরে কোন কোন লক্ষণ দেখলে আপনি বুঝবেন যে, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন এবং সে ক্ষেত্রে আপনার করণীয় কী হতে পারে, তা জেনে নিন।
ডেঙ্গু জ্বর সৃষ্টিকারী এডিস মশা
এডিস মশার দুইটি প্রজাতি-এডিস ইজিপ্টি এবং অ্যালবোপিকটাস মূলত ডেঙ্গু ভাইরাসের জীবাণু ছড়ায়। এডিস মশা বদ্ধ স্বচ্ছ পানিতে ডিম পারে। মশার জীবনকাল গড়ে ৪০ দিন, কিন্তু একবার এ মশা সংক্রমিত হলে পুরো জীবনকালই সংক্রমণ ঘটাতে থাকে। প্রতি ৩ দিন অন্তর ডিম পারে। কাজেই কম জীবনকাল হলেও একটু স্বচ্ছ পানি পাওয়া গেলে দ্রæত বংশ বিস্তারে এ মশার জুড়ি নেই। এক চায়ের চামচ বা একটা বোতলের ছিপির পানিই যথেষ্ট। এছড়া পুরোনো টায়ার, লন্ড্রি ট্যাংক, ঢাকনাবিহীন চৌবাচ্চা, ড্রাম বা ব্যারেল, অন্যান্য জলাধার, পোষা প্রাণীর পাত্র, নির্মাণাধীন ভবন, ফেলে রাখা বোতল ও টিনের ক্যান, গাছের ফোকর ও বাঁশ, দেয়ালে ঝুলে থাকা বোতল, পুরোনো জুত, ফুলের টব, পরিত্যক্ত খেলনা, ছাদে, অঙ্কুরোদগম উদ্ভিদ, বাগান পরিচর্যার জিনিসপত্র, ইটের গর্ত ও অপরিচ্ছন্ন সুইমিং পুল। তবে পানি জমে থাকা যেকোনো জায়গায় এরা ডিম দিতে পারে।
এডিস মশা কখন কামড়ায়
ডেঙ্গু জ্বরের জন্য দায়ী এডিস মশা অন্ধকারে কামড়ায় না। সাধারণত সকালের দিকে এবং সন্ধ্যার কিছু আগে এডিস মশা তৎপর হয়ে ওঠে। তাই দুপুরে ঘুমানোর সময় সতর্ক থাকা দরকার। বিশেষ করে শিশুদের সাবধানে রাখা প্রয়োজন। সম্ভব হলে দিনে ও রাতে ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করতে হবে।
কেমন হতে পারে রোগের লক্ষণ?
সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে
১. জ্বর ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে।
২. জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে। ৩. ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ শরীরে ব্যথা। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় লালচে দাগ বা র্যাশ থাকতে পারে।
৪. শরীর ঠান্ডা হচ্ছে মনে হতে পারে। ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করার লক্ষণও দেখা দিতে পারে।
কখনো কখনো ডেঙ্গু সংক্রমণ খুবই মারাত্মক অথবা প্রাণনাশক হয়ে থাকে। এটাকে বলে সিভিয়ার ডেঙ্গু ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণের ৩-৭ দিন পর সিভিয়ার ডেঙ্গুর লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। যেসব লোক আগে ডেঙ্গুতে সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের সিভিয়ার ডেঙ্গুর ঝুঁকি বেশি।
তাই কতগুলো বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে-
১. আগের চেয়ে শরীর বেশি অবসাদ লাগছে কি না?
২. আগের চেয়ে কম সময় দাঁড়িয়ে থেকেও কি ক্লান্তি লাগছে?
৩. তীব্র ক্ষুধামান্দ্য দেখা দিচ্ছে কি না।
৪. স্বাভাবিকের চেয়ে প্রস্রাব কম হচ্ছে কি না।
৫. সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব হওয়া।
৬. শরীরের নানা জয়েন্ট ফোলা ভাব আসা।
৭. পেটে পানি আসার লক্ষণ দেখা।
৮. চোখের সাদা অংশে রক্তক্ষরণের মতো দৃশ্যমান হওয়া।
৯. অচেতন লাগা।
১০. তীব্র পেট ব্যথা।
১১. মাত্রাতিরিক্ত বমি হওয়া (২৪ ঘণ্টায় তিনবারের বেশি হলে) ইত্যাদি।
ডেঙ্গুর চিকিৎসা কী?
এই রোগের জন্য তেমন কোন ওষুধ নেই। এ সব রোগীদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত যতœ নিতে হবে। প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এ সময় কোন খাবারে নিষেধাজ্ঞা নেই তবে পানি বেশি পরিমাণে পান করতে হবে। ফল খেতে হবে। রোগীকে পরিপূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে। জ্বর কমানোর জন্য প্যারাসিটামল গ্রুপের ওষুধ ছাড়া ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন বা ক্লোফেনাকজাতীয় ওষুধ সেবন করা উচিত নয়। এতে রক্তক্ষরণ বেড়ে যেতে পারে। রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা মাত্র হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে করণীয়:
১. বাড়ির আশপাশ যতটা সম্ভব পরিষ্কার রাখতে চেষ্টা করুন।
২. ঘরের ভেতরে থাকা ফুলের টব কিংবা ভাঙা প্লাস্টিকের বোতল, ডাবের খোসা, টায়ার অথবা পলিথিন থাকলে তা দ্রæত পরিষ্কার করে ফেলুন এবং ফুলের টব থেকে জমে থাকা পানি নিষ্কাশন করুন।
৩. মশা নিধনের জন্য সপ্তাহে অন্তত তিন বার স্প্রে বা ফগিং করুন।
৪. বাড়ির বাইরে যাওয়ার সময় মশা নিধনে ব্যবহৃত ক্রিম রাখতে পারেন সঙ্গে।
৫. সন্ধ্যার পর বাড়ির ছোট থেকে বড় সদস্যরা মশারি ব্যবহার করতে পারেন।
৬. যেখানে সেখানে জমে থাকা বৃষ্টির পানি পরিষ্কার করে ফেলুন কারণ এতে এডিস মশা ডিম পেড়ে থাকে এই সময়।
৭. অন্যদিকে মশার প্রকোপ থেকে বাঁচতে মশারির পাশাপাশি ম্যাট ব্যবহার করতে পারেন।
৮. এডিস মশা যেহেতু দিনের বেলা কামড়ায় তাই দিনের বেলা ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি টানিয়ে ঘুমানোর দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
আপনার আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলে এবং ছোট ছোট কিছু বিষয়ে সচেতন থাকলে ডেঙ্গুজ্বর থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে তেমনি আপনার আশপাশের মানুষরাও থাকবে সুস্থ্য এ সময়ের রোগবালাইয়ের প্রকোপ থেকে।
তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলে দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাওয়ার চেয়ে ন্যূনতম এমবিবিএস চিকিৎসককে দেখানো উচিত। ভুলেও ব্যথার ঔষুধ সেবন করা উচিত নয় নিশ্চিত না হয়ে।