১
বছর দুয়েক আগের ঘটনা। বর্ষাকাল চলছে। গোধূলিলগ্ন। নীলাকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে টুপ করে আষাঢ়ে বৃষ্টি নেমে আসবে। রাজধানীর গুলিস্থান থেকে নীলক্ষেতে রওয়ানা হয়েছি। বাহন লেগুনা। এখনকার সময় এই রুটে লেগুনায় হেল্পার না থাকলেও, সে দিন ছিল। চালকের বয়স বড়োজোর ১৭-১৮ হবে। আর হেল্পার? সে তো নিতান্তই নাদান বাচ্চা।
নীলক্ষেতে পৌঁছানোর পূর্বেই মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এলো। আগেই একজন যাত্রী নেমে যাওয়া লেগুনায় একটি সিট খালি ছিল। হেল্পার ছেলেটি কিনারার সিটে বসা ভদ্রলোককে বললেন, “একটু চাপেন, আমি বসবো।” ভদ্রলোক বললেন, “বৃষ্টিতে তোর কিছু হবে না, দাঁড়িয়ে থাক।” আমিসহ লেগুনার যাত্রীরা ভদ্রলোকের কথার নীরব সম্মতি জ্ঞাপন করলাম।
প্রবাল প্রাচীরের দ্বীপ সেন্টমার্টিন। কিছুক্ষণ পর টেকনাফের উদ্দেশ্যে জাহাজ ছেড়ে দিবে। হুইসেল বেজে চলছে। হোটেল ও রিসোর্টগুলো থেকে মানুষ পঙ্গপালের মতো বেড়িয়ে আসছে। আমরা যে রিসোর্টে উঠেছি, সেখানে পুরান ঢাকার একটি একান্নবর্তী পরিবার বেশ কয়েকদিন ছিল। আজ তারা চলে যাচ্ছে।
তাঁদের অসংখ্য ব্যাগ ও লাগেজ। মনে হলো মানুষের তুলনায় ব্যাগ-লাগেজ অনেক বেশি। সাধারণত সেন্টমার্টিনে ব্যাগ-লাগেজসহ যাতায়াতের জন্য এক ধরনের ভ্যান চলাচল করে। শেষ মুহূর্তে ভ্যান পাওয়া দুস্করের পাশাপাশি ভাড়াও অনেক বেশি। পর্যটকদের সাহায্য করার জন্য স্থানীয় শিশু-কিশোররা ভ্যানের থেকে অর্ধেকের কমমূল্যে ব্যাগপত্র টানার কাজ করে। যাঁদের শক্তি সামর্থ্য আছে তারা নিজেরাই ব্যাগপত্র টেনে জাহাজে উঠে যায়। আর যাঁরা একটু দুর্বল অথবা আর্থিকদিক থেকে শক্তিশালী তারা ভ্যান বা শিশুদের সহায়তা নেয়। যাই হোক ভদ্রলোকের কাছে ৩-৪ টা শিশু আসল। শিশুরা প্রতিটি লাগেজ বহন করার জন্য ১০০ টাকা করে দাবি করলো। ভদ্রলোক বহুত ভালো মানুষ! তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, একটি করে লাগেজ মাথায় ও একটি হাতে করে নিতে হবে; তিনি প্রত্যেক সর্বসাকুল্যে ২০ টাকা করে দিবেন! শিশুরা অনেক গড়িমসি করলো। ওদের সর্বশেষ দাবি ৫০ টাকা করে দিতে হবে। ভদ্রলোকের এক কথা, একশো কথার সমান।
শিশুটির নাম হিরা। দেখলাম সদরঘাটের লালকুঠি ঘাটে লোহার পিলার ধরে ফুঁপিয়ে কান্না করে যাচ্ছে। ডাক দিয়ে কান্নার কারণ জিজ্ঞাসা করলাম। উত্তরে যা বললো, তাতে হতবাক না হওয়ার উপায় নেই।
হিরা লালকুঠি ঘাটে পান ও সিগারেট বিক্রি করে। এক ক্রেতা দুটি সিগারেট কিনেছে তাঁর কাছ থেকে। দাম ১৪ টাকা। হিরার কাছে ৫ টাকা আছে, আর ভাঙতি টাকা নেই। ক্রেতার কাছ থেকে এক টাকা বেশি রাখার অপরাধে, ঐ ক্রেতা একটি সিগারেটের জ¦লন্ত আগুনের ছ্যাঁকা হিরার গায়ে দিয়েছে।
শিশু শ্রম নিয়ে কিছু লেখার আগে, দেশে শিশু শ্রম কতটা নিষ্ঠুর; তা বোঝানোর চেষ্টা করলাম। উপরিউক্ত ঘটনাগুলো প্রত্যেকটি লেখক স্ব চোখে দেখেছেন। পাঠক! হয়তো আপনিও এই রকম অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী। এছাড়াও দেশের গণমাধ্যমে শিশু শ্রমে নিয়োজিত শিশুদের ওপর কী রকম নির্যাতন চলে তা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকি সামান্য ভুলের কারণে অনেক শিশুকে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।
কোনো সন্দেহ নেই শ্রম হচ্ছে কষ্টসাধ্য। এটা যেকোনো বয়সী মানুষের জন্য প্রযোজ্য। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের শ্রম কষ্টসাধ্য হলেও তার শরীরের সক্ষমতা থাকে কষ্টকে সহ্য করার। কিন্তু শিশুদের পক্ষে শ্রম সহ্য করা সম্ভব নয়।
তাই যে ভাষায় শিশু শ্রমকে সংজ্ঞায়িত করা হোক অথবা যে বাস্তবতায় শিশু শ্রমকে বৈধ্যতা দেওয়া হোক; আমাদের সর্বপ্রথম স্বীকার করতে হবে, শিশু শ্রম মানবতার ওপর বড়ো ধরনের আঘাত এবং শিশু শ্রম অর্থই হচ্ছে চরম নিষ্ঠুরতা।
২
দেশের শ্রম আইন ২০০৬ অনুযায়ী, ‘১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কাজ করানো হলে, তা শিশু শ্রমের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে।’ অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী ‘যখন কোনো শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে তখন তা শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য হবে।’
শিশু শ্রম কি, তা আমরা সকলে বুঝি। দেশের বিভিন্ন আইনে অন্তত ১০টি জায়গায় শিশু শ্রমকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। এসব আইন প্রণয়ন করার মূল উদ্দেশ্য শিশু শ্রম নিরুৎসাহিত করা অথবা বন্ধ করা। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কাগুজে কলমের আইন-কানুন শিশু শ্রম বন্ধ করতে পারেনি। বরং দিনের পর দিন শিশু শ্রম অপ্রতিরোধ্য গতিতে বেড়েই চলছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০২১ সালের প্রকাশিত জরিপে বলা হয়েছে, দেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৩৪ লাখ ৫০ হাজার। জরিপের তথ্য অনুযায়ী যা মোট শিশুর অর্ধেক! সরকারি সংস্থার জরিপকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা সত্তে¡ও বলা হয়, সরকারি জরিপে যা উঠে আসে তা বাস্তবতার নিরিখে খুবই কম।
দেশে শিশু শ্রমিক আসলে কত, তা বুঝতে হলে নিজেদের ঘর থেকে হিসেব করতে হবে। ঢাকাসহ বড়ো বড়ো শহরগুলোতে মধ্যবিত্ত হতে শুরু করে উচ্চবিত্তদের ঘরে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের অধিকাংশই শিশু শ্রমিক। ঘরে বাহিরে শিশুরা অন্তত ৩৪৭ ধরনের অর্থনৈতিক কাজের সাথে জড়িত। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-বিভিন্ন রাসায়নিক কলকারখানা, চলন্ত রাজপথে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিয়ে হকারি করা, কৃষি, ওয়েল্ডিং, ট্যানারি শিল্প, যানবাহনের হেল্পার, বিড়ি ও তামাক কারখানা, নির্মাণ কাজ, প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি, বর্জ্য অপসারণ, মোটর ওয়ার্কশপ, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, জাহাজ ভাঙা শিল্প, লবণ কারখানা, ইটভাটা, পাথর ভাঙা, রিকশা-ভ্যান চালানো, কাঠমিস্ত্রি, জুয়েলারি শিল্প, অ্যালুমিনিয়াম, চাল কল, বিস্কুট কারখানা, কাচ, সাবান, মশলার কারখানা, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সিরামিক শিল্প, লেদ মেশিন ও ওয়েল্ডিংয়ের কাজ, ম্যানুফ্যাকচারিং ও মাদকের মত ইত্যাদি কাজে দেশের শ্রমিকরা সম্পৃক্ত।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ কাউন্সিল ও লেবার রাইটস সাংবাদিক ফোরাম (আইটিইউসি) ২০২২ সালের ২২ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) তে সংবাদ সম্মেলন করে জানায় দেশে শ্রমিকের সংখ্যা ৪৭ লাখ। দুটি সংস্থার জরিপের মধ্যে পার্থক্য প্রায় ১৩ লাখ। এক সময় গার্মেন্টস শিল্পে প্রচুর শিশু শ্রমিকরা কাজ করলেও এখন তা হ্রাস পেয়েছে। গার্মেন্টস পণ্যের পশ্চিমা ক্রেতারা চাপ প্রয়োগ করে মালিকদের বাধ্য করেছে শিশু শ্রমিক নিয়োগ না দিতে। ফলে এক সময় কোটির কাছাকাছি শিশু শ্রমিক থাকলেও তা এখন অর্ধেকে নেমে আসছে।
৩
কোনো সন্দেহ নেই শ্রমের ওপর দেশের অর্থনীতি সচল থাকে। শ্রমের বদৌলতে বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। তবে বিজ্ঞলোকেরা বলে, এটিও কাগুজে কলমে। বাস্তবে দেশের উন্নতি বন্দি হয়ে আছে গুটি কয়েক মানুষের কাছে। দেশ যে উন্নতির শিখরে এখনো যেতে পারেনি তার কড়কড়ে উদাহরণ হচ্ছে, মোট শিশুর অর্ধেক শিশু শৈশবে জড়িয়ে পড়ছে অর্থ উপার্জনে।
শিশু শ্রমের প্রধানতম কারণ দারিদ্রতা। একটি দরিদ্র পরিবারের পক্ষে সন্তানের ভরণপোষণ যেখানে মিটানো দায় সেখানে পড়ালেখা করানো যেন বিলাসিতা। ফলে এদেশের অভিভাবকরা একটি নির্দিষ্ট বয়সে গিয়ে তাঁর সন্তানকে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কল-কারখানায় পাঠাতে বেশি উৎসাহবোধ করে। শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তাৎক্ষণিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য মনোযোগ দেয়।
সবকিছুর একটি নির্দিষ্ট নিয়ম বা পদ্ধতি আছে। ভাত যদি অর্ধসিদ্ধ করে খাওয়া হয়, তাৎক্ষণিক হয়ত ক্ষুধা নিবারণ হবে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে একটি ক্ষতিকর প্রভাব শরীরের ভেতর সৃষ্টি হবে। শিশু শ্রম এমনি জটিল ও স্পর্শকাতর বিষয়। আজকে যে শিশুকে অর্থ উপার্জনের জন্য ঘরের বাহিরে পাঠানো হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে এই শিশু বেশ কয়েকদিন অর্থ উপার্জন করে ঘরে ফিরলেও কিছুদিন পর আর ঘরে ফিরছে না। সে নিজেকে সমাজের চোরাবালিতে হারিয়ে ফেলছে।
একজন মানব সন্তানের বেড়ে উঠার সময় শিশুকাল তথা শৈশব। শিশুর শৈশবকে নরম মাটির সাথে তুলনা করা যায়। নরম মাটি দিয়ে যেমন একজন কুমার মনের ইচ্ছে-মর্জি মত বিভিন্ন তৈজসপত্র তৈরি করতে পারে। ঠিক একইভাবে একজন মাতা-পিতা শিশুকালে তাঁর সন্তানকে মনের মত করে গড়ে তুলতে পারে। যা শিশুকাল পেরিয়ে গেলে অনেকাংশে সম্ভব হয় না। অপরদিকে একজন মানুষের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নৈতিক, মানসিক বুদ্ধি ভিত্তিক বিকাশের প্রয়োজন পড়ে। একটি শিশুর নৈতিক ও মানসিক বিকাশের সময় শিশুকাল। তাই তো নেপোলিয়ান বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো।
দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের দেশের শিশুরা তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের সময় পাচ্ছে না। যে বয়সে একজন শিশুর বিদ্যালয়ের ক্লাসে থাকার কথা সে বয়সে ঐ শিশু লেগুনার হেল্পার হয়ে যাত্রী ডাকছে। যে বয়সে একজন শিশুর বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খেলায় মেতে উঠার কথা সে বয়সে ঐ শিশু পাথর ভাঙার মত ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে গেছে। যে বয়সে একজন শিশুর দুধে ভাতে বেড়ে উঠার কথা সে বয়সে একজন শিশু অপরের ভাত বেড়ে দেওয়ার জন্য হোটেলে কাজ করছে।
বলা হচ্ছে শিশু শ্রমে কিছু কাজ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমরা মতে শিশু শ্রমের সব কাজই ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা যে সময় চলে যায় সে সময় আর ফিরে আসে না। আজকে যে সকল শ্রমিকরা শিশু শ্রমে জড়িয়ে আছে তাঁরা চাইলেও তাঁদের শৈশব ফিরে পাবে না। ফিরে পাবে না তাঁদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতির সময়।
৪
শিশু শ্রমের প্রধানতম কারণ দারিদ্রতা। একটি দরিদ্র পরিবারের পক্ষে সন্তানের ভরণপোষণ যেখানে মিটানো দায় সেখানে পড়ালেখা করানো যেন বিলাসিতা। ফলে এদেশের অভিভাবকরা একটি নির্দিষ্ট বয়সে গিয়ে তাঁর সন্তানকে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে কল-কারখানায় পাঠাতে বেশি উৎসাহবোধ করে। শিশুর ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে তাৎক্ষণিক ক্ষুধা নিবারণের জন্য মনোযোগ দেয়।
দেশের আর্থ সামজিক দুরবস্থা শিশু শ্রমকে বন্ধ হতে দিচ্ছে না। দেশের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ শ্রমজীবী। যাঁদের অধিকাংশ দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। আরেকটি অংশ আছে, যাঁরা দিনে এনে দিনে খায়। অন্যদিকে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। আবার পরিবারের কর্তার মৃত্যু অথবা মায়ের মৃত্যুর অথবা পরিবারের ভাঙনের কারণে শিশুরা বিচ্ছিন্ন হয়ে শৈশবে কাজে নেমে পড়ে।
সর্বোপরি পিতামাতার স্বল্প শিক্ষা, দরিদ্রতা এবং অদূরদর্শী চিন্তার কারণে শিশুশ্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা জাতীয় ভাবে দেশের অর্থনীতিকে দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকিতে ফেলছে। আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা হচ্ছে অর্থকে কেন্দ্র করে সমাজ ব্যবস্থা। প্রথমত আজকে যারা শিশু শ্রমে জড়িয়ে আছে তাদের অর্থনৈতিক উপার্জন ক্ষমতা খুব স্বল্প মেয়াদি। তাঁরা জীবনের একটি পর্যায়ে গিয়ে অর্থ উপার্জন করার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অপর দিকে দক্ষ জনশক্তি না হওয়ার কারণে তাঁরা আজকে যে সকল শিশু যথাযথ প্রক্রিয়া বেড়ে উঠছে তাঁদের তুলনায় পেছনে পড়ে যায়। সময়ের পরিক্রমায় উভয় শিশুর অর্থ উপার্জন ক্ষমতার মধ্যে ব্যাপক ফারাক দেখা যায়। ফলাফল হিসেবে এই সমস্যা ধীরে ধীরে পরিবার ও রাষ্ট্রের ওপর চরম সংকট সৃষ্টি করে।
দুর্যোগে দুর্বিপাকে অর্থনৈতিকভাবে অস্বচ্ছল জনগোষ্ঠীকে রাষ্ট্রকে বহন করতে হয়। তাদের মৌলিক অধিকার (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ক্ষেত্রে) বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্ধ দিতে হয়। যা দিতে গিয়ে আবার অন্য জনগোষ্ঠীর ওপর করের বোঝা চাপাতে হয়।
সর্বোপরি রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণমুখী শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। এই ব্যবস্থায় সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নয় বরং যার যতটুকু সুযোগ দরকার ঠিক ততটুকু যেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিতে পারে সে দিককে গুরুত্ব দিতে হবে।
একটি পর্যায়ে এই শিশুরা অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল হতে গিয়ে অনৈতিক পথে পা বাড়ায়। তাঁরা মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী বিভিন্ন কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। তাঁরা সমাজে নানা ধরনের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ফলে রাষ্ট্রকে তাঁদের নিয়ন্ত্রণের জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ, সময় ও লোকবল নিয়োগ করতে হয়। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র যেমন অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ঠিক অনুরূপভাবে সমাজে স্থায়ী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। উভয়ের সংঘর্ষে আর্থ সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে।
৫
শিশু শ্রমে রাষ্ট্রের দায় আসলে কী? বিজ্ঞলোকেরা ঝড় আসার পূর্বেই নিজের ঘরের খুঁটি শক্ত করে। একইভাবে রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে আজকে যাঁরা শিশু শ্রমে জড়িয়ে যাচ্ছে তাঁরা এক সময় রাষ্ট্রের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং এই বিশাল সংখ্যক শিশুকে বোঝা হিসেবে তৈরি না করে সম্পদে পরিণত করা সবচেয়ে উত্তম উদ্যোগ হবে।
যেহেতু শিশু শ্রমের প্রধান কারণ দারিদ্রতা সেহেতু দারিদ্র নিরসন করা হবে রাষ্ট্রের প্রধান কর্তব্য। সর্বজনীন শিশু শিক্ষা বিনামূল্যে প্রদান করতে হবে। এই শিক্ষা হতে হবে মানসম্মত। প্রয়োজনের তাগিদে শিশুকে দক্ষ ও যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে যতটুকু শিক্ষার প্রয়োজন ততটুকু রাষ্ট্র বহন করবে। শিশুর পরিবারের সামাজিক সুরক্ষা ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। বিভিন্ন দুর্যোগে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের পাশে রাষ্ট্রকে সর্বদা দাঁড়াতে হবে। বিদ্যালয় থেকে যেন শিশুরা পারিবারিক অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য ঝড়ে না পড়ে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের সন্তানদের প্রয়োজনের তাগিদে আবাসিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। শহর ও গ্রামগঞ্জে শিশুরা যেন মাদকের ছোবলে আক্রান্ত না হয় সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে।
সর্বোপরি রাষ্ট্রকে একটি কল্যাণমুখী শাসন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। এই ব্যবস্থায় সকল নাগরিকের সমান সুযোগ নয় বরং যার যতটুকু সুযোগ দরকার ঠিক ততটুকু যেন রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিতে পারে সে দিককে গুরুত্ব দিতে হবে। অর্থনৈতিকভাবে কোনো পরিবার বা জনগোষ্ঠী যেন দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস না করে সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সজাগ হতে হবে। বেকারত্ব তৈরির করার শিক্ষা ব্যবস্থা নয় কর্মমুখী নৈতিক মূল্যবোধ ও বিজ্ঞান সম্মত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে।
নাগরিকের একার পক্ষে অনেক কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্র চাইলে তাঁর বিভিন্ন যন্ত্রকে কাজে লাগিয়ে একটি সুখী, সমৃদ্ধ সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। আমরা চাই বাংলাদেশ এমন একটি উন্নত দেশ হোক। যে দেশে শিশু শ্রম শূন্যের কোঠায় থাকবে। যে দেশে শিশুরা বিদ্যালয়ের মাঠে উৎসবমুখর পরিবেশে খেলায় মেতে উঠবে। যে দেশের শিশুরা আগামীর বাংলাদেশ বির্নিমাণের স্বপ্ন শৈশবে অঙ্কন করবে। হয়ত একটু সদিচ্ছা ও উদ্যোগ নিলে এই বাংলাদেশ স্বপ্নের সোনালী দেশে পরিণত হবে।