২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরের জন্য ১ জুন ২০২৩ বৃহস্পতিবার ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে প্রস্তাব পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি শেখ হাসিনার চতুর্থ মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। পূর্বে তিনি পরিকল্পনা মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বপালন করেছেন। ‘উন্নয়নের অভিযাত্রায় দেড় দশক পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিযাত্রা’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে প্রস্তাবিত বাজেটে সন্তোষ প্রকাশ করেছে সরকারি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশের’ আরেক ধাপ ওপরে হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’।
বর্তমানে নানা রকম সংকটের মধ্যেও অর্থমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১ এর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদে বাজেটের ডিজিটাল উপস্থাপনা প্রদর্শিত হয়েছে। পহেলা জুন ২০২৩ বিকেলে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হয়। এরপর অর্থমন্ত্রী আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের বাজেট উপস্থাপন শুরু করেন। বাজেট একটি প্রামাণ্যচিত্র আকারে উপস্থাপন করা হয়। এতে স্বাধীনতার পর থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতির উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়। এরপর মূল বাজেট উপস্থাপন শুরু হয়।
অর্থমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের প্রথম ধাপ হিসেবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য বিশাল এই বাজেট পেশ করেন। এটি দেশের ৫২ তম বাজেট। এটি জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ। উচ্চ প্রবৃদ্ধিও প্রত্যাশা নিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে এবারের প্রস্তাবিত বাজেট। বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬ শতাংশ। জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩ ৬ লাখ ৭৮ হাজার ০৬৪ কোটি টাকার বাজেট ৯ জুন ২০২২ কোভিডের অভিঘাত পেরিয়ে উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় প্রত্যাবর্তন প্রতিপাদ্য দিয়ে ৫১ তম বাজেট খয়েরি ব্রিফকেসে নিয়ে কথামালার ফুলঝুরি মিশিয়ে পেশ করা হয়েছিল। এবার লাল রং এর ব্রিফকেস ডান হাতে নিয়ে অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে প্রবেশ করেছেন, বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করেছেন।
বাজেট পেশের আগে ১ জুন বেলা বারটায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বিশেষ বৈঠকে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নতুন বাজেট অনুমোদন করা হয়। সংসদ ভবনের মন্ত্রীসভা কক্ষে অনুষ্ঠিত বিশেষ এই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রীসভার বৈঠকে বাজেট অনুমোদনের পরে সংসদ ভবনের রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে নতুন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের নতুন বাজেট সংসদে উপস্থাপনের জন্য সম্মতিসূচক স্বাক্ষর করেন। সময় বাঁচাতেই এই দিন রাষ্ট্রপতি বঙ্গভবনের পরিবর্তে সংসদ ভবনের কার্যালয়ে অফিস করেন। নতুন বাজেটে রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরে অর্থমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে সংসদ অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রস্তাবিত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটকে ‘সংকটে ঘুরে দাঁড়ানোর বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেছেন, “সোনার বাংলার অভিমুখে যাত্রার প্রথম সোপান আমরা অতিক্রম করেছি। বাজেটটা এমনভাবে করা হয়েছে যে, মানুষের কষ্ট লাঘব হবে।” অন্যদিকে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমী খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, “সরকার ঋণ করে ঘি খাচ্ছে।” বাজেটে বড়ো বড়ো অঙ্ক দিচ্ছে আর বাংলাদেশের মানুষকে বড়ো বড়ো অবকাঠামোর কথা বলছে। বড়ো বড়ো অবকাঠামোর মধ্যে বড়ো বড়ো চুরি-ডাকাতি ছাড়া তো আমরা কিছু দেখছি না। বড়ো বড়ো অবকাঠামোর মধ্যে যে বিদেশে টাকা পাচার হয়েছে, সে জন্য আজকে ডলার সংকট; ব্যাংকে টাকা নেই, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা স্থায়ী হচ্ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির যেসব প্রলেপন করা হয়েছে তা অলীক এবং অর্জনযোগ্য নয়। তিনি বলেন, বাজেটে যেসব উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিরোধ করা সম্ভব নয়। আমদানি করা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর থেকে শুল্ক কমানোর পর্যাপ্ত কোন উদ্যোগ প্রস্তাবিত এই বাজেটে নেই। অর্থনৈতিক সংস্কারের কোনো উদ্যোগের কথা বাজেটে নেই। বাজেটে তিনবার আইএমএফ এর কথা বলা হয়েছে এবং আইএমএফ এর শর্ত পূরণের ইঙ্গিত রয়েছে। সামগ্রিকভাবে, প্রস্তাবিত বাজেটে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের কথা স্বীকার করা হয়নি এবং সংকট মোকাবিলার কোনো সমাধানও দেওয়া হয়নি।
প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বাজেটে চলমান সংকট সমাধানের পথরেখা নেই। নির্বাচনকালীন বাজেট হিসেবে এটি কোনো উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে পারবে বলে মনে হয় না। অর্থনীতিতে চলমান সংকট সমাধানের জন্য কোন সুস্পষ্ট পথরেখা এই বাজেটে দেওয়া হয়নি। আমদানি নিয়ন্ত্রন ইত্যাদি চলমান পদক্ষেপগুলোর বাইরে নতুন করে তেমন কোন ব্যবস্থা দেখা যায়নি। প্রস্তাবিত বাজেটে তেলের দামের ক্ষেত্রে উৎসে কর, আগাম আয়কর ৫ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর পরিবর্তে স্পেসিফিক ডিউটি আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া বিদ্যুতের মূল্য কমবে বলে মনে হয় না। বিশ^বাজারে পণ্যের দাম কমলে সেটির সুফল দেশের ভোক্তারা কিভাবে পাবেন, সেই বিষয়টিও সুস্পষ্ট নয়। আগামীতে টাকার মূল্যমানের আরও পতন হলে সেটিকে আটকানোর জন্য কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেই বিষয়টিও পরিষ্কার না। বেসরকারি চাকুরিজীবীদের বেতনের কোনো কিছু আলোকপাত করা হয়নি। তিনি বলেন, বিচলিত করার মতো বিষয়টি হলো দুই হাজার টাকার তথাকথিত ন্যূনতম সার্বজনীন কর ধরা হয়েছে, এটা অন্যায়। করযোগ্য আয় না থাকলে কেন কর দিতে হবে? যে যুক্তিতে এটা করা হয়েছে সেটা খুব একটা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না। একটা সরকার ১৫ বছর দেশ শাসন করার পর দুর্বলতম অর্থ বছর নিয়ে নির্বাচনে যাচ্ছে। সেটিকে কাটিয়ে উঠার জন্য যে অভিনবত্ব, সৃষ্টিশীলতা দরকার, সেটি এই বাজেটে না দেখে হতাশ হয়েছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবীদ ড. সালেহ উদ্দিন আহমদ বলেছেন, এটি নির্বাচনমুখী জনতুষ্টির বাজেট, জনকল্যাণের নয়। এটা উদ্ভাবনমূলক বাজেটও নয়। নির্বাচনের বছরে এ বাজেট বাস্তবায়নযোগ্য না, হবেও না। তিনি বলেন, বহির্বিশ্বে, আমরা ও অর্থনীতি আজ একটা চ্যালেঞ্জের মুখে। অর্থনীতিকে এই চ্যালেঞ্জের মুখে সামনে এগিয়ে নেওয়ার জন্য এই বাজেট যথেষ্ট নয়। বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল, সামনে দেশের জাতীয় নির্বাচন, এই সময়ে সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আগামী অর্থবছরের জন্য প্রাক্কলন করা হয়েছে এটা কখনোই অর্জন করা সম্ভব নয়। এটাকে উচ্চাভিলাষী বলব। এখন ৬ শতাংশের কাছাকাছি আছে। মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ রাখা সম্ভব হবে না। আলামতে দেখা যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসহ অন্যান্য জিনিসের দাম বাড়ছে। এ বাজেটের মাধ্যমে মানুষের কষ্ট কমবে না। আয় বৃদ্ধির জন্য বাজেট প্রস্তাবনায় কর্মসংস্থানের বিশেষ কোন পদক্ষেপ দেখছি না। আর কর্মসংস্থান যদি না বাড়ে, তাহলে কিভাবে মানুষের আয় বাড়বে। মূল্যস্ফীতির ধাক্কা যে লাগবে সেটা থেকে তাদেরকে কিভাবে রক্ষা করা হবে। তার মতে নির্বাচনের বছরে এই বাজেট বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন।
বর্তমান অর্থমন্ত্রীর এটি পঞ্চম বাজেট এবং আওয়ামী লীগ সরকারের ২৪ তম। ২০০৯ সাল থেকে টানা ক্ষমতায় থাকলেও ২০১৮ সালের রাতের ভোটের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর এটাই আওয়ামী লীগ সরকারের চলমান ৫ বছরের মেয়াদের শেষ বাজেট। এমন এক সময় এই বাজেট ঘোষণা হলো যখন খাদ্য থেকে জ¦ালানি ও পরিবহন ভাড়া থেকে শুরু করে ইউটিলিটি বিল পর্যন্ত প্রায় সব কিছুরই উচ্চমূল্যে হিমশিম খাচ্ছেন সাধারণ মানুষ শ্রমজীবী মানুষ। নি¤œবিত্ত তো বটেই মধ্যবিত্ত এবং সীমিত আয়ের শ্রমজীবী মানুষের খাদ্যপণ্য ক্রয়ই কঠিন হয়ে গেছে। মে ২০২৩ বিআইডিএস এর এক গবেষনায় বলা হয় রাজধানী ঢাকা শহরে দরিদ্রের সংখ্যা বাড়ছে। রাজধানীতে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৫১ শতাংশই ‘নতুন দরিদ্র’, এরা শ্রমজীবী। নতুন নতুন কর্মসংস্থানের বদলে কর্মহীনের সংখ্যা বাড়ছে।
রাজস্ব খাতে সংস্কার দরকার। এর পাশাপাশি সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিশেষ করে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রবাসী কর্মী, শ্রমজীবীদের পাঠানো রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি। রেমিটেন্সের গতি কমেছে। এমনকি কোভিডকালেও দেশে উল্লেখযোগ্য রেমিটেন্স এসেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭৬টি দেশে বাংলাদেশের এক কোটি ৫০ লাখের বেশী কর্মী/শ্রমজীবী কর্মরত রয়েছেন। নতুন নতুন শ্রমবাজারের সন্ধান আরও জোরদার করতে হবে। দেশের বেকার জনসংখ্যার জন্য নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, বিভিন্ন কারিগরি কোর্স এর উপর আরও জোর দিতে হবে। নারী শ্রমজীবীদের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।
একটি দেশের বাজেটের পরিধি অনেক ব্যাপক। বলা যায় বৃহৎ বাজেট। বাজেটের লক্ষ্য হলো দেশের জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বাংলাদেশবাসী কী চায়, শ্রমজীবী মানুষ, হতদরিদ্র অসহায় মানুষ, খেটে খাওয়া মানুষ, মধ্যবিত্ত মানুষ কী চায় তা জাতীয় বাজেটে থাকতে হবে। বৃহৎ বাজেট, অনিশ্চিত বাস্তবায়ন এমনটি হলে হবে না। দরিদ্ররা যেন আরও দরিদ্র না হয় সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সুনির্দিষ্ট কৌশল অন্তর্নিহিত থাকতে হবে। অতিরিক্ত কর আদায়ের বিরূপ প্রভাবে শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের কষ্ট বেড়ে যায়। প্রত্যক্ষ করের আওতা সম্প্রসারণের ফলে এ করের বোঝা শ্রমজীবী সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হয়।
লেখক: অর্থনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্যাংকার