আশুরা বা ১০ মুহাররম ইসলামের ইতিহাসে এক তাৎপর্যময় দিন। এ দিবসটি শুধু মুসলমানদের কাছেই নয়। ইয়াহুদি এবং খৃষ্টানদের কাছেও অনেক বেশি তাৎপর্যময়। কেননা বর্তমান যারা নিজেদের ইয়াহুদি এবং খৃষ্টান দাবি করে তারাও এক সময় আল্লাহর প্রেরিত পয়গম্বরের উম্মাত ছিল। পরবর্তীতে নবীর শিক্ষার মধ্যে নানা বিকৃতি এবং নিজেদের মর্জিমতো বহু পরিবর্তন সাধন করে তারা ইসলামের সরল পথ হতে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছে। তাদের ধর্মীয় রীতি নীতি এবং জীবনাচারে এখন ইসলামের বা নবীদের আনীত দীনের শিক্ষাকে তারা ধারণ করে না। নানা বিকৃতির মধ্য দিয়ে এ দুটি ধর্মের লোকেরা বর্তমান সময় পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে, তবে তারা এখনো ১০ মুহাররমকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে স্মরণ করে থাকে। এ দিবসটি ইসলামের ইতিহাসের সাথে অনেক বেশি সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে মুসলমানদের কাছে এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। ১০ মুহাররমের আলোচনা আসলে আমাদের সামনে কারবালার হৃদয় বিদারক ঘটনাই ভেসে ওঠে। তবে কারবালা হচ্ছে ইতিহাসের সর্বশেষ ঘটনা। এর আগে আরো অসংখ্য ঘটনা, ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোন থেকে এর গুরুত্ব ধারণ করে আছে।
১০ মুহাররম বা আশুরার যেমন গুরুত্ব আছে একইভাবে এ মাসেরও একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে। ইসলামে চারটি মাসকে বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ও পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, “নিশ্চয়ই আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে আল্লাহর বিধানে মাস গণনায় বারোটি। এর মধ্যে বিশেষ রূপে চারটি মাস হচ্ছে সম্মানিত। এটাই হচ্ছে সুপ্রতিষ্ঠিত দীন। অতএব তোমরা এ মাসগুলিতে (দীনের বিরুদ্ধাচরণ করে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করো না, আর মুশরিকদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ কর, যেমন তারা তোমাদের বিরুদ্ধে সকলে একযোগে যুদ্ধ করে। আর জেনে রাখো যে, আল্লাহ মুত্তাকিদের সাথে রয়েছেন” (সুরা তাওবাহ: ৩৬)। মুহাররম মাস সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, “এক বৎসরে বারো মাস, তন্মধ্যে নিষিদ্ধ হলো চারটি। তিনটি পর্যায়ে ক্রমিক যিলক্বদ, যিলহজ্জ ও মুহাররম। আর অন্যটি হল ‘মুদার’ গোত্রের রজব মাস, যার অবস্থান জুমাদা ও শা’বান মাসের মাঝখানে” (সহিহ বুখারি)।
কুরআন ও হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী মুহাররম মাসের গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়। এ মাসটিকে সম্মানিত মাস হিসেবে আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ এ সম্মানিত মাসে কেউ যুদ্ধ বিগ্রহ করবে না।
১০ মুহাররমের সাথে সম্পৃক্ত যতগুলো ঘটনার কথ্য পরম্পরা আমরা পাই, সেই সকল ঘটনা ঐতিহাসিক তথ্যপ্রমাণ দ্বারা প্রমাণিত হলেও ঠিক সেই ঘটনাগুলো ১০ মুহাররম তারিখেই সংঘটিত হয়েছে এমন প্রচলিত কথার আবার কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। বনি ইসরাঈল জাতি আশুরার দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করে থাকে। এর কারণ এ দিনে বনি ঈসরাঈল জাতিকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফেরাউনী শাসন ব্যবস্থার জুলুম নির্যাতন থেকে উদ্ধার করেছিলেন। নবী মূসা (আ.) যখন নবুওয়াত প্রাপ্ত হলেন, তখন মিশরে ফারাও সম্রাটদের শাসনকাল চলছে। ফেরাউন নিজেকে স্রষ্টা ঘোষণা করে দেশের সকল জনগণকে তার পূজা অর্চনা করতে বাধ্য করেছিলো। একটি স্বপ্নের তাবিরের মাধ্যমে সে যখন জানতে পারলো, বনি ইসরাঈল জাতির মধ্য হতে এমন এক শিশুর জন্ম হবে যে, তাকে হত্যা করবে। এর পর থেকে সে বনি ইসরাঈলীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে। সদ্য জন্ম নেওয়া ছেলে শিশুদের হত্যা করতো এবং মেয়েদের জীবিত রাখতো। কিন্তু আল্লাহর অপার মহিমায় ফেরাউনের ঘরেই মূসা (আ.) লালিত পালিত হলেন। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্ত হওয়ার পর যখন দীনের দাওয়াত দেওয়া শুরু করলেন, তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাঁকে নির্দেশ দিলেন। তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, সে সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে গেছে। মূসা (আ.) এর দাওয়াতে ফেরাউনের দুশমনী কমার পরিবর্তে বরং বেড়েছে। সে বনি ইসরাঈল সম্প্রদায় ও ঈমানদারদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করছিলো। আল্লাহ এই দিনে ফেরাউনের নির্যাতন থেকে বনি ইসরাঈলকে উদ্ধার করেছেন এবং ফেরাউনকে নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছেন। আল্লাহ বলেন, “‘আর বনি ইসরাঈলকে সমুদ্র পার করিয়ে নিলাম। আর ফেরাউন ও তার সেন্যবাহিনী ঔদ্ধত্য প্রকাশ ও সীমালঙ্ঘনকারী হয়ে তাদের পিছু নিল। অবশেষে যখন সে ডুবে যেতে লাগল, তখন বলল, ‘আমি ঈমান এনেছি, সেই সত্তা ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, যার প্রতি বনি ঈসরাঈল ঈমান এনেছে। আর আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’ এখন অথচ ইতঃপূর্বে তুমি নাফরমানী করেছে, আর তুমি ছিলে ফাসাদকারীদের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং আজ আমি তোমার দেহটি রক্ষা করব, যাতে তুমি তোমার পরবর্তীদের জন্য নির্দশন হয়ে থাক। আর নিশ্চই অনেক মানুষ আমার নিদর্শনসমূহের ব্যাপারে গাফেল’” (সুরা ইউনুস: ৯০-৯২)।
এই দিনে নবী মুসা (আ.) ও তার অনুসারী ঈমানদারদেরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফেরাউনের জুলুম থেকে উদ্ধার করেছিলেন এবং ফেরাউনকে তার বাহিনীসহ নীলনদে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। শুকরিয়া আদায়স্বরূপ ইয়াহুদিরা এ দিনটিকে বিশেষ মর্যাদার সাথে পালন করতো। এমনকি রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার আগে তাদের জন্য এ দিনে রোজা রাখা ফরজ ছিলো। হাদিসে এসেছে, ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় এসে দেখলেন যে, ইহুদিরা আশুরার দিনে রোজা পালন করছে। তিনি তাদের জিজ্ঞেস করলেন “এটা কোন দিন যে তোমরা রোজা পালন করছ? তারা বলল, এটা এমন এক মহান দিবস যেদিন আল্লাহ মুসা (আ.) ও তার জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরআউনকে তার দলবলসহ ডুবিয়ে মেরেছিলেন। মুসা (আ.) শুকরিয়া হিসেবে এ দিনে রোজা পালন করেছেন, তাই আমরাও রোজা পালন করি। এ কথা শুনে রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের চেয়ে আমরা মূসা (আ.) এর অধিক নিকটবর্তী। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সা.) রোজা পালন করলেন ও অন্যদেরকে রোজা পালনের নির্দেশ দিলেন” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।
আশুরার রোজার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় হিজরতের পর প্রতি বছর এ দিনে রোজা রাখতেন। সাহাবায়ে কেরামও এ রোজা থেকে বিরত থাকতেন না। নবী (সা.) বলেছেন, যে এই দিনে রোজা রাখে তার এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আবু হুরাইরাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজানের পর সর্বোত্তম রোজা হলো মুহাররম মাসের রোজা এবং ফরজ সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত” (সহিহ মুসলিম)।
আবু কাতাদাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আশুরার দিনের রোজাকে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের গুনাহের কাফফারা হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন” (সহিহ মুসলিম)। তবে যখন রমজান মাসের রোজা ফরজ করা হলো, “তখন তিনি বললেন, যার ইচ্ছা সে মুহাররমের রোজা রাখতে পারে আবার ইচ্ছে করলে নাও রাখতে পারে।”
মহাগ্রন্থ আল কুরআনে যতগুলো বিষয় এসেছে এর মধ্যে শুধুমাত্র মূসা (আ.) এবং তাঁর জাতির ঘটনার প্রেক্ষাপট হাদিস থেকে জানতে পারা যায় যে, মূসা (আ.) এবং তার জাতির লোকেরা ফেরাউনের নির্যাতন থেকে মুক্তি পেয়েছিলো। আর বাকি যতগুলো বিষয়ের সাথে ১০ মুহাররমকে সম্পৃক্ত করা হয়। তার কোনো নির্দিষ্ট তারিখ কুরআন হাদিসে কোথাও উল্লেখ নেই। ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনাই অত্যধিক তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্ত ঠিক এ দিবসেই এ ঘটনাগুলো সংগঠিত হয়েছে এমন কোনো তথ্য প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। যেমন বলা হয়ে থাকে ১০ মুহাররম পৃথিবী সৃষ্টি করা হয়েছে।
কুরআন হাদিসে কোথাও ১০ মুহাররম পৃথিবী সৃষ্টির কথা উল্লেখ নেই। কিছু কিছু ইসরাঈলী বর্ণনায় এমন তথ্য পাওয়া যায়। এই ইসরাঈলী বর্ণনা যে সঠিক তারও কোনো সঠিক সূত্র আমাদের কাছে নেই। এটি সত্যি হতেও পারে, নাও হতে পারে। পৃথিবী কত তারিখে সৃষ্টি হয়েছে এ বিষয়ে জানা বা না জানা মধ্যে ঈমানের সাথে সম্পৃক্ত আবশ্যিক কোনো বিষয় নয়। আমার যা বিশ্বাস করি তা হচ্ছে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। তিনিই একে সুন্দরভাবে সাজিয়েছেন। মানুষের জন্য নাজ নেয়ামতের ব্যবস্থা করেছেন। পৃথিবী সৃষ্টি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “পৃথিবীর সবকিছু তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আকাশের দিকে মনোসংযোগ করেন এবং তা সপ্তাকাশে বিন্যস্ত করেন, তিনি সকল বিষয়ে বিশেষভাবে অবহিত” (বাকারা: ২৯)।
“তিনি আকাশমণ্ডলীকে সাত আকাশে বিন্যস্ত করলেন দুদিনে আর প্রত্যেক আকাশকে তার বিধি-ব্যবস্থা ওহির মাধ্যমে প্রদান করলেন। আমি আলোকমালার সাহায্যে দুনিয়ার আকাশের শোভাবর্ধন করলাম আর সুরক্ষার (ও ব্যবস্থা করলাম)। এ হল মহা পরাক্রমশালী সর্বজ্ঞ আল্লাহর সুনির্ধারিত” (হামীম সাজদাহ: ১২)।
যেহেতু আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে কোথাও পৃথিবী সৃষ্টির কোনো দিন তারিখ উল্লেখ করেননি। কুরআন এবং হাদিসে রাসুলের মাধ্যমে জানতে পারি যে, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সীমাহীন শক্তি, ক্ষমতা ও কুদরতের আঁধার। তাঁর কোনো কাজ স্থান, কাল এবং সময়ের ফ্রেমে বাঁধা নয়। তিনি কুন ফায়াকুনের মালিক; আল্লাহ যখন কোনো কিছুর ইচ্ছা করেন, তখন নির্দেশের সাথে সাথে সাথে তা হয়ে যায়। তবে আল্লাহর কেন বললেন, তিনি ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। এটা আল্লাহ এ জন্য করেছেন, মানুষকে বোঝানোর জন্য যে মানুষকে তিনি পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন, সেই মানুষের পৃথিবীতে বসবাস, তার কর্ম প্রক্রিয়া, তাঁর জীবন ধারণ একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হবে। দুনিয়ার জীবনে তাকে কিছু সময় অতিবাহিত করতে হবে। একজন শিশু হিসেবে মানুষ পৃথিবীতে আগমন করে। এরপর শৈশব, কৈশোর, যৌবন এবং বার্ধক্য তার জীবনে আসে। এক সময় তার দুনিয়ার জীবনের সফর শেষ হয়। এ দুনিয়ার জীবনই তার শেষ নয়। এরপর তার জন্য আর একটি জীবন আছে। যে জীবনের শুরু আছে শেষ নেই। সেই জীবনের পাথেয় মানুষ এ পার্থিব জীবনেই অর্জন করবে। এভাবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম পৃথিবীতে আসতে থাকবে এবং এক সময় আবার পৃথিবী ধ্বংস হবে। এই যে একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অবলম্বন করছেন। এটা বোঝানোর জন্যই তিনি পৃথিবী তিনি ছয় দিনে পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। প্রচলিত ধারণা ও বক্তব্যের আলোকে এবং ওয়াজে এ তারিখ উল্লেখ করা হয়ে থাকে।
মানব জাতির আদি পিতা প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে এই দিন পৃথিবীতে প্রেরিত হয়েছেন, বলে কিছু অসমর্থিত সূত্রে বলা হয়ে থাকে। মহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেন। এটিও ইসরাঈলী বর্ণনা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম ও হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করার পর তাদেরকে জান্নাতে বসবাস করার জন্য বলেন। এবং একটি গাছের কথা বলে সতর্ক করে দেন যে, তোমরা কখনো এ গাছের কাছে যাবে না এবং এ গাছের ফল খাবে না। কিন্তু ইবলিসের প্ররোচনায় তারা দুজন এ গাছের ফল ভক্ষণ করেন। সেই গাছের ফল ভক্ষণ করার সাথে সাথে তাদের শরীরে জান্নাতি যে পোশাক ছিল তা খুলে যায় এবং তাদের শরীরের অবয়ব উম্মুক্ত হয়ে যায়, তখন তারা গাছের পাতা দিয়ে শরীর আবৃত্ত করেন। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা আল্লাহর হুকুম অমান্য করার ফলে আল্লাহ তাদেরকে জান্নাত হতে নেমে যেতে বলেন। আল্লাহর নির্দেশে তাদেরকে পৃথিবীতে অবতরণ করানো হয়। এ সময় আল্লাহ তাদেরকে একটি দোয়া শিখিয়ে দেন। দোয়াটি হচ্ছে: “তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের রাব্ব! আমরা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছি, আপনি যদি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি রহম না করেন তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদর অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বো” (সুরা আ‘রাফ: ২৩)। আদম (আ.) এর সৃষ্টি, তাঁর পৃথিবীতে আগমন সবই জাজ¦ল্যমান সত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বিষয়। কিন্তু এগুলো ১০ মুহাররম তারিখে অনুষ্ঠিত হয়েছে, এ সম্পর্কে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে কিছু জানাননি, নবী (সা.)ও এর তারিখ সম্পর্কে কিছু বলেননি। একজন বিশ্বাসী মুমিন হিসেবে আমাদেরকে বিশ্বাস রাখতে হবে। আদম ও হাওয়া (আ.) পৃথিবীর প্রথম মানুষ এবং মানব জাতির আদি পিতা মাতা। তিনিই প্রথম নবী।
আল্লাহর নবী হযরত নূহ (আ.) সম্পর্কে যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হচ্ছে, হজরত নূহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন। হযরত নূহ (আ.) এবং তাঁর জাতি সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে অবহিত করেছেন, কিন্তু নূহ (আ.) এর জাতির জীবনে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনা যে, ১০ মুহাররম তারিখে ঘটেছে এর সম্পর্কে কুরআন বা হাদিসে কিছু বলা হয়নি। এটিও ইসরাঈলী বর্ণনা হতে বিভিন্ন গ্রন্থকার সংগ্রহ করেছেন, যা আমাদের কাছে এসে পৌঁছেছে। ঈসরাঈলী বর্ণনাগুলো সঠিক হতে পারে আবার নাও হতে পারে।
হযরত নূহ (আ.) কে ঐতিহাসিকগণ দ্বিতীয় আদম হিসেবে অভিহিত করেছেন। তার সময়ে যে সর্বপ্লাবী বন্যা হয়েছিলো, সে বন্যায় ঈমানদারগণ ব্যতীত সকল মানুষ এবং প্রাণী মারা গিয়েছিলো। ‘আবুল বাশার ছানী’ (ابوالبشرالثانى ) বা মানবজাতির দ্বিতীয় পিতা বলে খ্যাত নূহ আলাইহিস সালাম ছিলেন পিতা আদম আলাইহিস সালাম এর দশম অথবা অষ্টম অধস্তন পুরুষ। নূহ (আ.) যখন নবুওয়াত লাভ করেন, তখন পৃথিবীতে কোনো তাওহিদ বিশ্বাসী মানুষ জীবিত ছিলো না। তিনি নবুওয়াতি দাওয়াত শুরু করলে তার জাতির লোকেরা বললো, “হে নূহ! যদি তুমি বিরত না হও, তবে পাথর মেরে তোমার মস্তক চূর্ণ করে দেওয়া হবে” (সুরা শু‘আরা: ১১৬)। তবুও বারবার আশাবাদী হয়ে তিনি সবাইকে দাওয়াত দিতে থাকেন। আর তাদের জন্য দোআ করে বলতে থাকেন। কিন্তু তার জাতির লোকদের অবাধ্যতা বাড়তেই থাকে। নূহ (আ.) আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করে বললেন, হে রাব্বুল আলামিন! আমি এই জাতির লোকদের কাছে গিয়েছি, দিনে এবং রাতে, সকাল এবং সন্ধ্যায়, প্রকাশ্যে এবং গোপনে, একাকী এবং সম্মিলিতভাবে, কিন্তু তাদের অবাধ্যতা শুধু বেড়েই গিয়েছে।” এরপর তিনি এভাবেই আল্লাহর দরবারে দোয়া করলেন, ‘‘হে রাব্বুল আলামিন! পৃথিবীতে একজন কাফের গৃহবাসীকেও তুমি ছেড়ে দিয়ো না। যদি তুমি ওদের রেহাই দাও, তাহলে ওরা তোমার বান্দাদের পথভ্রষ্ট করবে এবং ওরা কোনো সন্তান জন্ম দিবে না পাপাচারী ও কাফের ব্যতীত” (সুরা নূহ: ২৬-২৭)।
নূহ (আ.) এর দোয়া আল্লাহ কবুল করেছিলেন এবং একটি নৌকা তৈরি করে যে কয়জন ঈমানদার ছিলো তাদেরকেসহ প্রত্যেক প্রাণীর এক জোড়া করে নৌকায় উঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর চল্লিশ দিন ব্যাপী ভয়াবহ বন্যা হয়, যে বন্যায় নূহ (আ.) এর জাতির অবাধ্য সকল লোক মারা যায় এমনকি তার এক অবাধ্য সন্তান ‘কেনান’সহ কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিলো না। নূহ (আ.) এর জাতির ঘটনা কুরআন সবিস্তারে বর্ণনা করেছে। তবে কুরআন এবং হাদিসে এর কোনো দিন তারিখ উল্লেখ করেনি। ইসরাঈলী বর্ণনায় যে দিন তারিখের কথা বলা হয়েছে, তাকে আমরা সত্য কিংবা মিথ্যা কিছুই বলছি না। আমরা শুধু নূহ (আ.) এবং তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সামগ্রিক ঘটনার প্রতি ঈমান আনবো।
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) তার জীবনে অসংখ্যবার অনেকগুলো কঠিন পরীক্ষা দিয়েছেন। নিজ দেশ থেকে বিতারিত হওয়া। শিশু সন্তানকে মরুভূমিতে সহায় সম্বলহীনভাবে রেখে আসা, অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়া। এ সকল প্রতিটি ঘটনাই তার জীবনের অনন্য ঘটনা। ইবরাহীম (আ.) এর অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার ঘটনাকে ১০ মুহাররমের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। ইবরাহীম (আ.) কে আগুনে নিক্ষিপ্ত করার পর আল্লাহ আগুনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, “হে আগুন! ঠান্ডা হয়ে যাও এবং ইবরাহীমের উপরে শান্তিদায়ক হয়ে যাও” (সুরা আম্বিয়া: ৬৯)। বিভিন্ন বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ৭/১০ কিংবা চল্লিশ দিন আগুনের কুণ্ডলীর মধ্যে অবস্থানের পর সেখান হতে সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসলেন। কোনো কোনো ইসরাঈলী বর্ণনায় বলা হয়েছে, তিনি এই তারিখেই আগুন থেকে মুক্তি লাভ করেছেন।
ঈমানদার মাত্রই তাঁকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন, যা পবিত্র কুরআনে বিভিন্নভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈমানদারদের মধ্যে নবীরা সর্বাগ্রে অবস্থানকারী। তাদের জীবনের পরীক্ষাগুলোও তাই অনেক কঠিন এবং বিরাট। আল্লাহর নবী হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করেছিলেন। তার সকল সন্তান সন্ততি মারা গিয়েছিল, সম্পদ সহায় হারিয়ে কপর্দকহীন হয়েছিলেন, দূরারোগ্য ব্যধির কারণে সমস্ত শরীরে পঁচন ধরেছিলো। এমনকি তাঁর স্ত্রীও শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। এ সকল পরীক্ষার পরও তিনি কখনও আল্লাহর স্মরণ থেকে নিজেকে গাফিল হননি। তার সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন, ‘‘নিশ্চয়ই আমি তাকে ধৈর্যশীল পেয়েছি।’’ কুরআন এবং হাদিসে তাঁর সুস্থ হওয়া সম্পর্কে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। কিছু কিছু ইসলামী বইয়ের লেখক বনি ঈসরাঈল জাতির বর্ণনা থেকে উল্লেখ করেছেন যে, আইউব (আ.) ১০ মুহাররম তারিখে অসুস্থতা হতে মুক্তি লাভ করেছেন।
এ ব্যতীত হযরত ঈসা (আ.) এর উর্ধ্বকাশে আরোহন, ইউনুস (আ.) এর মাছের পেট হতে মুক্তি লাভসহ নানা ঐতিহাসিক ঘটনার সাথে এ দিবসকে সম্পৃক্ত ইসরাঈলী বিভিন্ন বর্ণনা পাওয়া যায়। সকল বিষয়ে আল্লাহই ভালো জানেন। এ সকল কারণে এ মাস এবং দিনটি অনেক বেশি তাৎপর্যমণ্ডিত এবং গুরুত্বপূর্ণ। এদিনে বেশ কয়েকজন নবী আল্লাহর সাহায্য লাভ করেছেন, বড়ো ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন এবং কঠিন বিপদ-আপদ থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। এ সকল কারণে অতীতের নবী রাসুল ও তাঁদের উম্মতরা এদিনে রোজা পালন করতেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) মদিনায় এসে দেখেন, ইহুদিরা আশুরার দিন রোজা পালন করছে। তিনি জানতে পারলেন, এদিনে মুসা (আ.) তাওরাত কিতাব লাভ করেন। এদিনে তিনি ও তাঁর জাতির লোকেরা নীলনদ পার হয়ে ফেরাউনের অত্যাচার থেকে মুক্তি লাভ করেন। তাই এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য মুসা (আ.)-এর অনুসারী ইহুদিরা এদিন রোজা রাখে। তখন মহানবী (সা.) ইহুদিদের লক্ষ্য করে বলেন, “তোমাদের তুলনায় মুসা (আ.)-এর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অধিকতর বেশি। সে হিসেবে এ ব্যাপারে আমরাই এর বেশি হকদার। তখন থেকে মুহাম্মদ (সা.) নিজেও আশুরার রোজা পালন করতেন এবং উম্মতকেও তা পালনের নির্দেশ দিলেন।” তবে নবী (সা.) ১০ মুহাররমের সঙ্গে ৯ বা ১১ তারিখের যে কোনো একটি দিন মিলিয়ে দুটি রোজা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। রাসুল (সা.) বলেন, “আশুরার রোজা রাখতে হলে, তার আগে বা পরেও একটি রোজা রাখবে। কারণ এটি যেন ইহুদিদের অনুকরণে না হয়” (সহিহ মুসলিম)।
অন্য এক হাদিসে আশুরার রোজা পালনে মহানবী (সা.)-কে উৎসাহিত করতে দেখা যায়। একবার কয়েকজন সাহাবি মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞেস করেন, ইহুদি ও খৃস্টানরা আশুরাকে বড়ো মনে করে। আমরা কেন এটিকে বড়ো মনে করব। উত্তরে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, “আগামী বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকলে আমি মহররমের ৯ তারিখেও রোজা পালন করব।” হাদিস শরিফে আরও বর্ণিত হয়েছে যে, “আশুরার দিন যে ব্যক্তি নিজের পরিবারবর্গকে পরিতৃপ্ত করে খেতে ও পরতে দেবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সারা বছর পরিতৃপ্তিসহকারে খেতে ও পরতে দেবেন।” (বায়হাকি) সহিহ বুখারি বর্ণনা মতে, মহররম মাসের প্রথম ১০ দিন রোজা পালন করা পূর্ববর্তী উম্মতদের ওপর ফরজ ছিল। বিশেষত আশুরার দিন পূর্ববর্তী উম্মতরা রোজা পালন করতেন। কিন্তু রমজানুল মোবারকের রোজা ফরজ হওয়ার পর এর অবশ্যকতা রহিত হয়ে যায়। ফলে মহানবী (সা.) এর পর থেকে আশুরার রোজা পালনের জন্য সাহাবিদের আর কোনো নির্দেশ দেননি কিংবা নিষেধও করেননি। তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে আশুরার রোজা রাখতেন। মহানবী (সা.) আশুরার রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে বলেন, “রমজানের রোজার পর সর্বোত্তম রোজা হলো মহররমের রোজা” (মিশকাতুল মাসাবীহ)। আশুরার রোজার গুরুত্ব সম্পর্কে অন্য এক হাদিসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, “আশুরার রোজার ব্যাপারে আমি আশাবাদী, আল্লাহ তাআলা এর অসিলায় অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেবেন” (তিরমিজি শরিফ)।
ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব কিংবা ক্ষমতা আরোহণের লোভ থেকে ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বিরোধিতা করেননি। ইমাম হোসাইন (রা.) এর জন্য অনেক বেশি নিরাপদ ছিলো মদিনায় সম্মান এবং নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপনের। কুফায় গমনের পর ভয়াবহ কোনো বিপদ ঘটতে পারে এটা জেনেও ইমাম হোসাইন কেন মদীনা নগরী ছেড়ে কুফার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলেন, তার কারণ ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং ন্যায় ও ইনসাফের পতাকাকে উড্ডীন করে ধরে রাখাই ছিলো তার লক্ষ্য।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা আশুরার দিনে সংঘটিত কতগুলো ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে আশুরার গুরুত্ব ও মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারলাম। তবে এসব ঘটনার কোনো-কোনোটির বর্ণনা সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা বিষয়ে কারো কারো দ্বিমত আছে। কিন্তু এ বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই যে মুসলিম উম্মাহর মধ্যে এই দিনটি মহিমান্বিত ও তাৎপর্যময়। এ দিনটিকে মুসলমানরা পবিত্র ও বরকতময় হিসেবে পালন করছেন। কিন্তু অতীতের সব ঘটনা ছাপিয়ে ৬১ হিজরি সনের ১০ মহররম এমন একটি দুঃখজনক ও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার অবতারণা হয়, যার কাছে সব ঘটনা স্লান হয়ে যায়। ফলে এ দিনটি অনন্য ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের রূপ নেয়। ১০ মহররম মহানবী (সা.)-এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র, খাতুনে জান্নাত হজরত ফাতেমা (রা.)-এর কলিজার টুকরা হজরত হোসাইন (রা.) কারবালা প্রান্তরে ইয়াজিদবাহিনীর হাতে অত্যন্ত নির্মম ও নৃশংসভাবে শাহাদাতবরণ করেন। ফোরাত নদীর তীরে ঐতিহাসিক কারবালা প্রান্তরে হযরত ইমাম হোসাইনের শাহাদাত আমাদের ঈমানী চেতনায় নব উদ্দীপনার মশাল জেলে দিয়েছে। ইমাম হোসাইনের শাহাদাত কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিলো না। খেলাফত ব্যবস্থা যখন ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে ধাবিত হচ্ছিল তখন ইমাম হোসাইন (রা.) তাকে আবার খোলাফায়ে রাশেদার সোনালী ঐতিহ্যের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। হযরত আমীরে মুয়াবিয়ার শাসনামলে হযরত ইমাম হাসান (রা.) এর সাথে একটি চুক্তি হয়েছিলো যে, আমীরে মুয়াবিয়ার পর খিলাফতের দায়িত্ব হযরত হোসাইন (রা.) এর হাতে অর্পণ করা হবে। কিন্তু তার ইন্তেকালের পর ইয়াজিদ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। ইয়াজিদ ক্ষমতায় আরোহনের পর প্রথম শ্রেণির ঈমানদার ব্যক্তিগণসহ মদীনার আলেমগণ কেউই তার কাছে বাইয়াত গ্রহণ করেনি। এমনকি তখনকার রাজধানী কুফার জনগণও ইমাম হোসাইন (রা.) কে আহ্বান করেছিলো যে, আপনি কুফা নগরীতে আসুন, আমরা আপনার বশ্যতা স্বীকার করে নিবো। কুফাবাসীর আহ্বানের প্রেক্ষিতে ইমাম হোসাইন (রা.) সেখানে যাওয়ার পথে পথিমধ্যে ইয়াজিদের নির্দেশে তার সেনাবাহিনী তাকেসহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে হত্যা করে। ইতিহাসের এ বিয়োগান্ত ঘটনার মাধ্যমে রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। যা ইসলাম সম্মত নয়। রাজতন্ত্রের এ ধারাবাহিকতায় যিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন থাকেন তার মধ্যে যে একনায়কতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী মনোভাব তৈরি হয় তা কেউ রোধ করতে পারে না। এই একনায়কতান্ত্রিকতা সকল অন্যায় এবং অপরাধের দুয়ার খুলে দেয়। খেলাফত ব্যবস্থা এবং ইসলামী পরামর্শ সভার (মজলিশে শুরা) বিলুপ্তি একটি রাষ্ট্রকে চরম স্বেচ্ছাচারীতায় পর্যবসিত করে। যা আমরা আজ গোটা দুনিয়ায় দেখতে পাচ্ছি। ইসলামী খেলাফত ব্যবস্থায় যেখানে খলিফার বক্তব্য থামিয়ে দিয়ে একজন নাগরিক প্রশ্ন করতে পারেন, সকল নাগরিকের একটি কাপড় আপনি দুইটি কাপড় কোথায় পেলেন? সেখানে ইসলামী খেলাফতের বিলুপ্তি এক নায়কতান্ত্রিকতা এবং জুলুমের সকল দড়জা খুলে দেয়। ইমাম হোসাইনের শাহাদাত পরবর্তী ইতিহাসের ধারবাহিকতা আমাদের সামনে এ সত্যই তুলে ধরে।
ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ, ক্ষমতার দ্ব›দ্ব কিংবা ক্ষমতা আরোহণের লোভ থেকে ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদের বিরোধিতা করেননি। ইমাম হোসাইন (রা.) এর জন্য অনেক বেশি নিরাপদ ছিলো মদিনায় সম্মান এবং নির্ঝঞ্জাট জীবন যাপনের। কুফায় গমনের পর ভয়াবহ কোনো বিপদ ঘটতে পারে এটা জেনেও ইমাম হোসাইন কেন মদীনা নগরী ছেড়ে কুফার উদ্দেশে রওয়ানা দিয়েছিলেন, তার কারণ ইসলামী খিলাফত ব্যবস্থা, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং ন্যায় ও ইনসাফের পতাকাকে উড্ডীন করে ধরে রাখাই ছিলো তার লক্ষ্য। ইমাম হোসাইনের শাহাদাত উম্মাতে মুহাম্মদীকে এ শিক্ষাই প্রদান করছে যে, জীবন চলে যেতে পারে কিন্তু ইসলামের নির্দেশের বাইরে জীবন যাপনের কোনো সুযোগ নেই। যত বড়ো ক্ষমতাধর ব্যক্তি হোক, তার সামনে কিংবা অন্যায়ের সামনে মাথা নত করার কোনো অনুমতি ইসলাম দেয়নি। জালিমের বিরুদ্ধে জীবন দিয়ে হলেও লড়াই করে যেতে হবে। এর জন্য কোনো বিপদ, বাঁধা, প্রতিবন্ধকতার পরোয়া করা যাবে না।
মুহাররম মাসে তাজিয়া মিছিল বের করা, হায় হোসাইন মাতম করা, রক্ত ঝড়ানো, কান্নাকাটি চিৎকার করা। এগুলোর কোনোটিই ইসলামের মূল চেতনার সাথে সঙ্গতিশীল নয়। কারবালা আমাদেরকে সে শিক্ষা প্রদান করেও না। কারবালার শিক্ষা হচ্ছে অন্যায়ের সামনে মাথা নত না করার, জালেমের জুলুমের পরোয়া না করার। একইভাবে ১০ মুহাররমের সাথে সম্পৃক্ত ঘটনাগুলো আমাদেরকে এই শিক্ষাই প্রদান করছে যে, ঈমানদাররা আল্লাহ ব্যতীত আর কারো কাছে মাথা নত করবে না। কোনো অন্যায় জুলুমের কাছে আত্মসমর্পণ করা যাবে না। আল্লাহ ব্যতীত আর কাউকে ইলাহ হিসাবে মানা যাবে না। দুনিয়ায় যতবড়ো ক্ষমতাধর ব্যক্তি হোক, সে কখনো আল্লাহর সমক্ষ হতে পারে না। দুনিয়ার সকল রাজা বাদশাহের ক্ষমতা অস্থায়ী একমাত্র আল্লাহই চিরস্থায়ী। পৃথিবীর সকল শক্তি মিলে কারো ক্ষতি করতে চাইলেও পারবে না, যদি আল্লাহর অনুমোদন না থাকে। যত বড়ো রাজা বাদশাহ হোক তার ক্ষমতার এক সময় পরিসমাপ্তি আছে কিন্ত চিরস্থায়ী ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করলে আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় অবশ্যই আসবে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে আশুরার চেতনাকে ধারণ করে জীবন পরিচালনার তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।